আবারো কমে যাচ্ছে রিজার্ভ
পণ্য আমদানি কমছে, প্রভাব কর্মসংস্থানে- আশরাফুল ইসলাম
- ০৭ জুলাই ২০২৪, ০২:৩১
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারো কমে যাচ্ছে। আগামীকাল এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের দায় পরিশোধ করতে হবে ১৪০ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ ১৫ বিলিয়নের ঘরে নেমে যেতে পারে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রকৃত রিজার্ভ খুব বেশি কমবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথমবারের মতো আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ ৩০ জুনে ঘোষণা করেছিল ১৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। সূত্র জানিয়েছে, ডলার সঙ্কটের কারণে আমদানি ব্যয় অস্বাভাবিক হারে কমে যাচ্ছে। গত দুই বছরের ব্যবধানে সামগ্রিক আমদানি অর্ধেকে নেমে গেছে। অপর দিকে, ডলার আন্তঃপ্রবাহের চেয়ে বেশি ব্যয় হওয়ায় নিট রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বর্তমান কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে বৈদেশিক দায় মেটাতে চাপে পড়ে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
জানা গেছে, আঞ্চলিক দেশগুলোর লেনদেনের নিষ্পত্তির একটি মাধ্যম হলো আকু। তেহরানভিত্তিক এ সংস্থার সদস্য দেশ হলো ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তান। সদস্য দেশগুলো প্রতি ২ মাস অন্তর অর্থ পরিশোধ করে। আকুর দায় পরিশোধের পর সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়। প্রতি দুই মাসের দায় পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধ করে এসব দেশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মার্চ-এপ্রিল মাসের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ১৬০ কোটি ডলার বা ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়। ফলে ওই দিন নিট রিজার্ভ ১ হাজার ৮২৩ কোটি ডলার বা ১৯ দশকি ২৩ বিলিয়নে নেমে এসেছে, যা আগের দিন অর্থাৎ ৮ মে ছিল ১ হাজার ৯৮৩ কোটি ডলার বা ১৯ দশকি ৮৩ কোটি বিলিয়ন ডলার।
গত মে ও জুন মাসের আকুর দায় চলতি সপ্তাহের সোমবারে পরিশোধ করতে হবে। গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের রিজার্ভ ব্যাংক বন্ধ ছিল। আজ রোববার যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক ছুটি। ফলে আগামীকাল সোমবারই আকুর দায় পরিশোধ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই রিজার্ভ নিচে নামার গতি থামানো যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা ধার নেয়া শুরু হয়। কোনো ব্যাংকের হাতে বাড়তি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নির্ধারিত সময়ের জন্য ধার দিতে পারে। তবে, বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ টাকা পাবে। আবার নির্ধারিত সময় শেষে ব্যাংকগুলোর প্রয়োজন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে রাখা বৈদেশিক মুদ্রা স্থানীয় মুদ্রার বিপরীতে ফেরত নিতে পারবে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে পৌনে তিন শতাংশ চার্জ পরিশোধ করতে হবে। তবে, ব্যাংকগুলোর যখন সাময়িক সময়ের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করবে, ওই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে। যেমন, গত এপ্রিল শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ব্যাংকগুলো ধার দিয়েছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার দরে সমপরিমাণ স্থানীয় মুদ্রা পরিশোধ করে। আর এ সুবাদে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৮৩ বিলিয়নে উঠেছিল। কিন্তু এ ডলার বিক্রি করা হয়েছিল এক মাসের জন্য। গত মে মাসেই এ অর্থ রিজার্ভ থেকে ফেরত দিতে হয়। ফলে আবারো কমে যায় বৈদেশিক মুদ্রা। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
এ দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়েই কমছে। এ পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে সরকারি কেনাকাটার ব্যয় মেটানোর জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেয়। তবে, এর বিপরীতে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকসহ অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সরকারি কেনাকাটায় বকেয়া এলসির দায় মেটাতে বলা হয়। এমনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে সোনালী ব্যাংকের কাছে গত মাসে ৯ কোটি ২০ লাখ ডলার বিক্রি করতে হয়েছে। এভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারি কেনাকাটায় সরকারি ব্যাংকের দায় না মিটিয়ে অন্যান্য ব্যাংকগুলোর উপর দেয়া হয়।
এ দিকে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই প্রথমবারের মতো, গত ৩০ জুনভিত্তিক হিসেবে আইএমএফের রিজার্ভ গণনার প্রকৃত হিসাব প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ৩০ জুনে বাংলাদেশে প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ১৬ দশমিক ৭৭ কোটি ডলার। আগামীকাল আকুর দায় পরিশোধ করতে হবে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারো ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যেতে পারে। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আইএমএফ বৈদেশিক দায়দেনা বাদ দিয়ে রিজার্ভ হিসাব করে। ১৬ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার যে হিসাব দেয়া হয়েছে এর মধ্যে আকুর দায়ও ছিল। আর এ কারণেই আকুর দায় পরিশোধ করলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বাজারে ডলার সঙ্কট কাটছে না। যে পরিমাণ ডলার আহরণ করা হচ্ছে ব্যয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি। আর এ কারণে একদিকে কাক্সিক্ষত হারে পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। এতে আমদানি ব্যয় ৫ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ সামগ্রিক পণ্য আমদানি প্রতি মাসে ৮৫০ কোটি ডলারে উঠেছিল। কিন্তু দুই বছরের ব্যবধানে সেই পণ্য আমদানি এখন ৫ বিলিয়ের ঘরে নেমে গেছে। পণ্য আমদানি ভয়াবহ আকারে কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো ডলার সঙ্কট। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ডলার সঙ্কটের কারণে তারা কাক্সিক্ষত হারে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ কাঁচামাল আমদানি করতে পারছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাহিদার এক-তৃতীয়াংশও এলসি খোলা যাচ্ছে না। কাক্সিক্ষত হারে এলসি খুলতে না পারায় শিল্পের উৎপাদন অনেক ক্ষেত্রেই অর্ধেকে নেমে গেছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় এক দিকে স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়ছে, তেমনি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। লোকসানের ধকল কাটাতে না পেরে অনেক প্রতিষ্ঠান থেকেই শ্রমিক ছাঁটাই করতে হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে ব্যাংকের ওপর। ব্যাংক বিনিয়োগ নিয়ে গড়ে উঠা শিল্প কারখানাগুলোর আয় দিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে পণ্য আমদানি করতে পারছে না। এক পর্যায়ে রুগ্ন শিল্পের কাতারে শামিল হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা