১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পাস ফেল না থাকলে সেই পরীক্ষার দরকার কী

-

- নতুন পরীক্ষা পদ্ধতিতে অভিভাবকদের অসন্তোষ
- পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ও উত্তর মিলছে গুগলে
- দেখাদেখি করে লেখাতেও নেই বাধা নিষেধ

নতুন কারিকুলামের আলোকে বুধবার (৩ জুলাই) থেকে শুরু হয়েছে শিক্ষার্থীদের ষাণ¥াষিক মূল্যায়ণ। নতুন পদ্ধতির এই মূল্যায়ন পরীক্ষায় যে প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই হচ্ছে তাতে কেউই ফেল করবে না সবাই পাস। তবে সাতটি ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীদের বিভাজন করা হবে মাত্র। অবশ্য নতুন কারিকুলাম চালু এবং পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে প্রস্তাবনার শুরু থেকেই অভিভাবকদের মধ্যে এ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ ছিল। সর্বশেষ প্রথম মূল্যায়ন পরীক্ষা শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই ব্যাপকভাবে প্রশ্নফাঁস এবং এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের পর দেশজুড়েই তীব্র সমালোচনাও শুরু হয়েছে। অভিভাবকদের বক্তব্য হচ্ছে পরীক্ষায় যদি পাস বা ফেল না থাকে তাহলে সেই পরীক্ষারই বা দরকার কী?
এর আগে ২০২৩ সালে মাধ্যমিকের দু’টি শ্রেণীতে (ষষ্ঠ ও সপ্তম) এবং ২০২৪ সাল থেকে মাধ্যমিকের চারটি শ্রেণীতেই (ষষ্ঠ থেকে নবম) নতুন কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। একই সাথে কয়েক দফা পরিবর্তন পরিমার্জন করার পর গত ২৯ জুন শিক্ষার্থীদের নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিরও অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ জুলাই থেকে একযোগে সারা দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ষাণ¥াষিক মূল্যায়ন হয়েছে। এই মূল্যায়নে যে প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে সেই প্রশ্ন ও উত্তরসহ এক দিনে আগে থেকেই ফেজবুক, গুগলে ঘুরছে। অভিভাবকদের অভিযোগ তাদের সন্তানরা পাঠ্যবই থেকে উত্তর বা সমাধান না খুঁজে গুগল থেকে উত্তর মিলিয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখছে।
এ দিকে প্রশ্ন ফাঁসের এ ঘটনাকে খোদ শিক্ষামন্ত্রী নিজেই এক অনুষ্ঠানে দূষণীয় নয় বলে সাফাই গেছেন। মন্ত্রীর যুক্তি হচ্ছে যেহেতু শিক্ষার্থীরা নিজেরাই প্রশ্নের সমাধান খুঁজে খাতায় লিখতে হবে তাই প্রশ্ন আগে থেকে জানা থাকলেও কোনো অসুবিধা নেই। এ ছাড়া পরীক্ষার হলেও শিক্ষার্থীরা নিজেরা দেখাদেখি করেও লিখতে পারবে। নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূলত শিক্ষার্থীদের দক্ষতা অর্জন কতটুকু হয়েছে তার ভিত্তিতেই তাদের মেধার মূল্যায়ন করা হবে। মন্ত্রী আরো বলেন, আমরা মুখস্থ বিদ্যার প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে এসে এক দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তুলতে এই শিক্ষাক্রম চালু করেছি। যদিও এটি সব অভিভাবকের বুঝতে একটু সময় লাগবে। এ ছাড়া সবাই কিন্তু ঢালাওভাবেও নতুন এই কারিকুলাম বা মূল্যায়ন পদ্ধতির বিরোধিতা করছে না। একসময় অভ্যস্ত হয়ে গেলে সবার কাছেই এ পদ্ধতি সহজ হয়ে যাবে।
গাজীপুরের একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর বাবা কবির হোসেন মণ্ডল নয়া দিগন্তকে জানান, আমার মেয়ের ক্লাসে পরীক্ষার সিট প্ল্যান এমনভাবে করা হয়েছে, যাতে ক্লাসের ফার্স্ট যিনি তার সাথে ক্লাসের দুর্বল শিক্ষার্থীকে বসানো হয়েছে। যাতে তারা দু’জন পরস্পরকে সহযোগিতা করে খাতায় লিখতে পারে। এভাবে ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে সবল শিক্ষার্থীকে দুর্বল শিক্ষার্থীর সাথে বসানো হয়েছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের বর্ণনা মতে পরীক্ষার হলের পরিবেশ নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। শিক্ষক নিজেই পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয় না বুঝে থাকলে একে অপরের সাথে আলাপ-আলোচনা করে লিখতে বলেছেন।
বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যেও নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেক শিক্ষক বলছেন, নতুন এ পদ্ধতি বোঝার জন্য যে প্রশিক্ষণ দরকার ছিল, তা সঠিকভাবে দেয়া হয়নি। এর ফলে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই আছে অন্ধকারে। অন্য দিকে শিক্ষাবিদরাও বলছেন, কোনো প্রকার পাইলটিং না করে সরাসরি এভাবে একযোগে নতুন কারিকুলাম চালু করায় বিতর্ক বেশি হচ্ছে। বিশেষ করে একদম তাড়াহুড়া করেই এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এ কারণে অনেক অভিভাবক, শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। ফলে নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে।
গত দুই দিন ধরে নতুন শিক্ষাক্রমের যেসব বিষয় নিয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মূল্যায়ন পদ্ধতি। শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বড় অংশ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক শিখনকালীন মূল্যায়ন। অর্থাৎ সারা বছর শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে। এ কারণে আগের মতো এখন কোনো পরীক্ষা হচ্ছে না।
যদিও নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে মূল্যায়ন বিষয়ে অভিভাবকদের অনেকেই আগের মতো লিখিত পরীক্ষা রাখার দাবি জানিয়েছেন। সম্মিলিত অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু নয়া দিগন্তকে বলেন, নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা এ পদ্ধতি মানতে চাইছেন না। অভিভাবকদের দাবি নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা আগের মতো পড়াশোনা করছে না। মোবাইলে তারা বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে। পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা গুগলের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে গেছে। তবে যেহেতু নতুন একটি পদ্ধতি চালু করা হয়েছে এর ভালোমন্দ দিক নিয়ে এখনই বিচার-বিশ্লেষণ করা যাবে না। আরো কিছু দিন সময় লাগবে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য। অভিভাবকদের দাবি আগের নিয়মের পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের খাতায় বা উত্তরপত্রে নম্বর দিয়ে মূল্যায়ন ছিল। তখন শিক্ষার্থীরা বাসায় পড়াশোনায় আগ্রহী হতো। তাদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা থাকত। এখন এসব না থাকায় বাসায় আর শিক্ষার্থীরা পড়তে আগ্রহী হচ্ছে না।
নতুন এই মূল্যায়ন পদ্ধতির বিষয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বক্তব্য হচ্ছে আগের নিয়মে পরীক্ষা নির্ভর ও মুখস্থ নির্ভরতার কারণে আমাদের শিখন অর্জন হচ্ছিল না। শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যায়ন পদ্ধতি দীর্ঘস্থায়ী কিছু নয়। বিশ্ব পরিবর্তনের সাথে সাথে শিক্ষাপদ্ধতির ধরনও বদলে যায়। সে কথা বিবেচনা করেই এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। এ ছাড়া আগের মতো পরীক্ষা পদ্ধতি না থাকায় এখন শিক্ষার্থীদের কেউ অকৃতকার্য হচ্ছে না। যারাই ক্লাস করছে, স্কুলে আসছে তারা সবাই পরবর্তীতে ক্লাসে উন্নীত হবে। পাস ফেলের সেই আগের অঙ্ক এখন কোনো স্কুলেই হবে না।
এনসিটিবির দেয়া তথ্যানুযায়ী, স্বাধীনতার পর দেশে শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন এসেছে অন্তত সাতবার। এর মধ্যে ১৯৭৭ সালে প্রথম শিক্ষাক্রম প্রণয়নের পর ১৯৮৬ সালে পাঠ্যবইয়ে পরিমার্জন করা হয়। ১৯৯২ সালে প্রাথমিক স্তরে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমে রূপান্তর করা হয়, ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক স্তরে উদ্দেশ্যভিত্তিক শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন করা হয়। আবার ২০০২ সালে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমের কিছু পাঠ্যবইয়ের পরিমার্জন করা হয়। এরপর ২০১২ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়। গত এক দশকে সেটিও পরিবর্তন করা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement