১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখছে চুয়াডাঙ্গার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল

দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখছে চুয়াডাঙ্গার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল -


চুয়াডাঙ্গার ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেশের দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখছে বিশ্বখ্যাত কালো জাতের এই ছাগল পালন করে এ জেলার অসচ্ছল পরিবারে ফিরেছে সচ্ছলতা। এ জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দেখা মিলবে ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট বা কালো জাতের ছাগল।
বাংলাদেশের স্থানীয় জাত ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল মানের দিক থেকে বিশ্বসেরা হিসেবে স্বীকৃত। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থা এফএও এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা আইএইও ২০১৫ সালের মূল্যায়ন অনুযায়ী ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত। আন্তর্জাতিক বাজারে এই ছাগল ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ হিসেবে পরিচিত। তবে বর্তমানে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলার অংশ চুয়াডাঙ্গা জেলায় এই ছাগল বেশি পালন হওয়াতে জেলা প্রশাসন থেকে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে জেলার ব্র‌্যান্ডিং হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। গুণগত মানের চামড়া ও সুস্বাদু মাংসের জন্য সারা পৃথিবীতে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের যেমন খ্যাতি রয়েছে তেমনি যেকোনো পরিবেশে দ্রুত মানিয়ে নেয়া ও বছরে দু’বারে ৩-৪টি বাচ্চা প্রদানের কারণে দারিদ্র্যবিমোচনে বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

শুধুমাত্র কালো জাতের ছাগলই নয়, হরিয়ানা, যমুনাপাড়ী, তোতামুখী ও বিটল জাতের ছাগলও পালন করে আসছে এ জেলার মানুষ। চুয়াডাঙ্গা জেলাজুড়ে কয়েক প্রজাতির ছাগল দেখতে পাওয়া গেলেও এর মধ্যে ৭০ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল। এই ছাগল পালনে বাড়তি তেমন খরচ না থাকায় খুব সহজেই এর দেখভাল করতে পারেন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও। অনেকেরই জীবনযাত্রা পাল্টে গেছে এই কালো জাতের ছাগল লালন-পালন করে। চুয়াডাঙ্গার চারটি উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে মূল সড়ক পেরিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের রাস্তাঘাট এবং মেঠোপথেও দেখা যায় ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের। কোথাও উঠানে, কোথাও বা বাড়ির মাচায় চলছে ছাগল লালন-পালন। অনেক খামারি ২০-৩০টি ছাগল পালন করে বছরে দুই থেকে তিন লাখ টাকা আয় করছেন।

চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের হাসানুজ্জামান নামের এক ছাগল পালনকারী বলেন, আমি সারা বছরই কৃষিকাজের পাশাপাশি ছাগল পালন করে আসছি। বর্তমানে আমার বাড়িতে ৩০টির অধিক ছাগল রয়েছে। এই ছাগল দেড় বছরের মধ্যে আট থেকে দশ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। এরা বাড়ির আশপাশের গাছের পাতা, ঘাস ও বিচুলি খেয়েই বড় হয়। তাই এদের পালতে বাড়তি কোনো খরচেরও দরকার হয় না।
কালো জাতের ছাগল পালন করে সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন লিমা থাতুন। স্বামী মনোয়ার হোসেন ও তিন সন্তান নিয়ে তার সংসার। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে তাদের বাড়ি। স্বামীর এক বিঘা জমিতে কৃষিকাজ আর অন্যের জমিতে দিনমজুরি করে চলে সংসার। এমতাবস্থায় লিমা ওয়েভ ফাউন্ডেশন থেকে ছাগল কেনার জন্য ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দু’টি ছাগি ক্রয় করেন এবং ১০টি ছাগলের জন্য মাচাযুক্ত ঘর তৈরি করেন। ছাগি দু’টি প্রথমেই একটি করে খাসি বাচ্চা প্রসব করে এবং বছর দেড়েকের মধ্যে লিমা খাসি দু’টি ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন।
চুয়াডাঙ্গা পৌর শহরের ছাগল খামারি মিনারুল ইসলাম জানান, মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে দু’টি ছাগল থেকে বর্তমানে আমি ৫০টির অধিক ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের মালিক। তিনি বলেন, ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল পালন করে আমার জীবন বদলে গেছে। ঋণ নিয়ে মাত্র দু’টি ছাগল কিনে পালন করতে শুরু করি। এখন আমার ৫০টির বেশি ছাগল রয়েছে। ছাগল ও দুধ বিক্রি করে প্রতি বছরে ভালো পরিমাণের টাকা আয় হয়।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় বছরে প্রায় পাঁচ লাখ ছাগল উৎপাদন হয়ে থাকে। এর থেকে ২৩ হাজার মেট্রিক টন গোশত উৎপাদন হয়। বর্তমানে বাজারে ছাগলের গোশতের দাম প্রকারভেদে ৯৫০-১০০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। জেলায় ছাগলের গোশত ও চামড়া বিক্রি করে বছরে আয় হচ্ছে দুই হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও ছাগলের চামড়া বিক্রি করেও মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা ছাগল উন্নয়ন খামারের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আরমান আলী জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলার বিশ্ববিখ্যাত ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জাত সংরক্ষণে ১৯৯৬ সালে চুয়াডাঙ্গায় ছাগল উন্নয়ন খামার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতি বছর এ খামার থেকে খুলনা বিভাগের ১০টি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্ধারিত মূল্যে পাঁঠা-ছাগি সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এ খামারে পাঁঠা-ছাগি মিলিয়ে প্রায় এক হাজার ছাগল পালন করা হয়। এর ফলে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাত সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা: মো: মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চুয়াডাঙ্গা ব্ল্যাক বেঙ্গল গোটের জন্য একটি অভয়াশ্রম বলা যায়। এখানকার জলবায়ু ও অনুকূল আবহাওয়া হওয়ার কারণে ছাগল পালনের ক্ষেত্রে এটা সব থেকে উপযোগী এলাকা। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল হলো চুয়াডাঙ্গার ব্র‌্যান্ড। চুয়াডাঙ্গা জেলাকে এই ছাগলের অভয়াশ্রম বলে মনে করি। বিশ্বের মধ্যে ১০০টি ছাগল গবেষণা করে দেখা গেছে এই কালো জাতের ছাগলই সব থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। চুয়াডাঙ্গার ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের গোশত অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় দেশে এবং দেশের বাইরে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এটি চুয়াডাঙ্গা জেলার ঐতিহ্য। এ জেলায় ছাগলের গোশত ও চামড়া বিক্রি করে বছরে আয় হচ্ছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement