প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে গ্রুপিং লবিং রূপ নিচ্ছে সঙ্ঘাতে
কর্মকর্তারা জড়াচ্ছেন অনিয়ম-দুর্নীতিতে- কাওসার আজম
- ২৪ জুন ২০২৪, ০০:০৫
প্রাণিসম্পদ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। এ খাতের সম্প্রসারণ দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের। এ জন্য রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। রয়েছে রাজস্ব বাজেট। এমনিতেই প্রতিষ্ঠানটিতে জনবল সঙ্কট দীর্ঘদিনের। এর ওপর কর্মকর্তাদের মধ্যে গ্রুপিং লবিং এবং অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের অক্টোবরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ‘জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভেটেরিনারি পাবলিক হেল্থ সার্ভিস জোরদারকরণ প্রকল্প’-এর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ডা: আজিজুল ইসলামকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রাণিসম্পদ খাতের সবচেয়ে বড় প্রকল্প ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্প’, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সক্ষমতা জোরদারকরণ প্রকল্প, পিপিআর নির্মূল এবং ক্ষুরারোগ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প’সহ বিভিন্ন প্রকল্পে। এমন কি সায়েন্স হাউজ নামের বিতর্কিত একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে যন্ত্র সরবরাহের কাজ দিয়ে কোটি কোটি টাকা সুবিধা নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ভেটেরিনারি পাবলিক হেল্থ সার্ভিস জোরদারকরণ প্রকল্পের ল্যাবরেটরির যন্ত্রাংশ সরবরাহের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ সায়েন্স হাউজ। তবে দরপত্র অনুযায়ী সঠিক যন্ত্র সরবরাহ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। বিষয়টি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শাহীনা ফেরদৌসীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে পণ্য সরবরাহে ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ মেলে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ল্যাবরেটরি পরিদর্শনকালে তদন্ত কমিটি ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ এ জাল স্টিকার বসানোর সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে। এতে চীন থেকে নিয়ে আসা পণ্যে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের স্টিকার লাগানো হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্টরা। উল্টো এলডিডিপি প্রকল্পের জিডি-৯৭ প্যাকেজের আওতায় ৭৯ কোটি টাকার আরো একটি কার্যাদেশ দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
গ্রুপিং লবিং সঙ্ঘাতে রূপ নিচ্ছে
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের শীর্ষ পদ মহাপরিচালক বা ডিজি। বর্তমান ডিজি ডা: মোহাম্মদ রেয়াজুল হক নিয়োগ পেয়েছেন চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি। তিনি অবসরে যাবেন আগামী ডিসেম্বরে। ঢের সময় রয়েছে সামনে। কিন্তু, এখনই শীর্ষ এই পদে বসা নিয়ে রীতিমতো ‘রাজনীতি’ শুরু হয়ে গেছে। ডিজি নিয়োগের সময় হলেই প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে শুরু হয় অস্থিরতা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বিসিএস লাইভস্টকের মেধা বা গ্রেডেশন অনুযায়ী, পরবর্তী প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক হওয়ার কথা ১৯তম বিসিএসের ডা: মো: আবু সুফিয়ান। ৯ম বিসিএসের পর মামলাজনিত কারণে দীর্ঘ বিরতির পর ১৯তম বিসিএসে লাইভস্টক ক্যাডারে নিয়োগ দেয় সরকার। এই ব্যাচে মেধা তালিকায় তিন নম্বরে রয়েছেন আবু সুফিয়ান (গ্রেডেশন নং ৯০৩)। গ্রেডেশনের ১ নম্বরে থাকা ব্যক্তি এখন চাকরিতে নেই। আর দ্বিতীয় হওয়া ব্যক্তি চাকরিতেই যোগদান করেননি। ফলে আবু সুফিয়ানই এই ব্যাচের প্রথম ব্যক্তি। তার পরেই রয়েছে ডা: মলয় কুমার শূরের নাম (গ্রেডেশন নং ৯০৪)। তাদের সাথে ডিজি হওয়ার প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছেন ১৯ জন পরে থাকা ডা: বরুন কুমার দত্ত। তার গ্রেডেশন নম্বর ৯৩০। ডা: বরুনের আগে মেধা তালিকায় আরো অনেকেই থাকলেও ‘পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড’ আছে, এমন যৌক্তিকতায় তিনি জোর গ্রুপিং লবিং চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
ডা: বরুন কুমার দত্ত বর্তমানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক (হিসাব, বাজেট ও নিরীক্ষা)। গত ৬ মার্চ আলাউদ্দিন রোডের এন্ডোপ্যারাসাইটোলজি অনুবিভাগের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার থেকে পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে বসানো হয় তাকে। এই পদে ছিলেন তারই ব্যাচের বর্তমানে শীর্ষে (এক নম্বর) থাকা ডা: মো: আবু সুফিয়ান। ওই দিনই তাকে ঢাকা থেকেই সরিয়ে বরিশাল বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের পরিচালক করা হয়। তার পর গত ১৫ মে বদলি করে ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের টক্সিকোলজি অ্যান্ড জুরিপ্রুডেন্স অনুবিভাগের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার করে আনা হয়। একই দিন একই প্রজ্ঞাপনে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার পদোন্নতি ও বদলির আদেশ হয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় মুরগি খামার, মিরপুর-এর পরিচালক পদে থাকা ডা: মোহাম্মদ বজলুর রহমানকে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক পরিকল্পনা শাখায় আনা হয়। যার গ্রেডেশন নম্বর ৯৪২।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বর্তমান ডিজি নিয়োগের সময় প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা গ্রুপিং লবিংয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। বিদায়ী মহাপরিচালক ডা: এমদাদুল হক তালুকদার চেয়েছিলেন চুক্তিতে থাকতে। এ জন্য জোর লবিং ছিল তার। বিসিএস ক্যাডার নন, বিএনপি-জামায়াতপন্থীসহ নানা প্রচারণা থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ডিজি হন ডা: মোহাম্মদ রেয়াজুল হক। তখনও ডিজি হওয়ার দৌড়ে ছিলেন বর্তমানে পরিচালক প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা ডা: মলয় কুমার সুর। গ্রেডেশন তথা মেধাবী হিসেবে নাম ছিল ডা: আবু সুফিয়ানের নামও। কিন্তু, এই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরেকটি নাম ডা: বরুন কুমার দত্ত।
গত ১৪ জুন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো: আব্দুর রহমানের ঢাকার পরিবাগের বাসার লিফটে হামলার শিকার হন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) মলয় কুমার শূর। তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার অভিযোগে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (লিভ, ডেপুটেশন অ্যান্ড ট্রেনিং রিজার্ভ) মো: আজিজুল ইসলামের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করেন তিনি। ওই ঘটনার পর একটি ভিডিওতে হামলার জন্য ডা: আজিজের পাশাপাশি ডা: বরুনের নামও বলতে শোনা যায় ডা: মলয়কে। এ প্রসঙ্গে ডা: বরুন কুমার দত্ত নয়া দিগন্তকে বলেন, তিনি (ডা: মলয়) কিভাবে এ ঘটনায় আমাকে জড়িয়ে বক্তব্য দেয়? আমি এটা দেখেছি। আমি তো তার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করবো। ডা: আজিজের সাথে তার (ডা: মলয় কুমার শূর) দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্ব। এ কারণে হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জড়াচ্ছে। আবার দেখেন, মামলায় কিন্তু আমাকে আসামি করেনি। তিনি বলেন, আমার পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সামনে হয়তো বড় পদের (মহাপরিচালক ) জন্য আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন তিনি (শূর)।
ঘটনার রাতেই (১৪ জুন) ডা: আজিজের নতুন পদে নিয়োগ বাতিল করে মন্ত্রণালয়। গত ১৯ জুন তাকে ফের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়।
সূত্রে জানা যায়, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডিজি পদে নিয়োগ নিয়ে গত বছরই সক্রিয় ছিলেন পরিচালক প্রশাসন ডা: মলয় কুমার শূর। ডা: রেয়াজুল ডিজি হলেও অধিদফতরে ডা: মলয় পাওয়ারম্যান হিসেবেই পরিচিত। তবে, তার সাথে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডা: বরুন কুমার দত্ত। ফরিদপুরে বাড়ি হওয়ার ইতোমধ্যে তিনি ‘মন্ত্রীর লোক’ হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছেন। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘পাওয়ার’ দেখাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বিগত কয়েক বছরে বেশির ভাগই দলীয় বিবেচনায় ডিজি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ডিজি নিয়োগ নিয়েও অস্থিরতা তৈরি হয়। তবে, বিএনপিপন্থী হিসেবে পরিচিতি পেলেও বর্তমান প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী গ্রেডেশনে শীর্ষে থাকা ডা: রেয়াজুলকেই বেছে নেন। ডা: রেয়াজুল দায়িত্ব নেয়ার পর ডা: মলয়ের পাশাপাশি ডা: বরুনপন্থীরা শক্ত অবস্থান তৈরি করেন। ডিজিপন্থী এক কর্মকর্তা বলেন, ডিজি স্যারকে কোনো কোনো সময় বিব্রতকর পরিস্থিতেও পড়তে হচ্ছে।
সাধারণত পরিচালক প্রশাসন থেকেই পরবর্তী মহাপরিচালক নিয়োগ হয়ে থাকে। গ্রেডেশনে শীর্ষে থাকা ডা: আবু সুফিয়ান পরিচালক হিসাব, বাজেট ও নিরীক্ষা থেকে পরিচালক প্রশাসনে যাওয়ার কথা। কিন্তু, তাকে ওই পদে তো নেয়াই হয়নি বরং ঢাকার বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যদিও পরে ঢাকায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করে আনা হয়েছে। পরিচালক প্রশাসনের পদ বাগিয়ে নেন ডা: মলয় কুমার শূর। একই সাথে তিনি সামলাচ্ছেন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেলও।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, মেধায় এক নম্বরে থাকলেও আবু সুফিয়ানকে বিএনপি-জামায়াতপন্থী ‘তকমা’ দিয়ে মন্ত্রণালয়কে বিষিয়ে তোলা হচ্ছে। সুফিয়ান ডিজি হচ্ছেন না, এমনটা ধরেই শীর্ষ পদে আসীন হতে অনেকটা যুদ্ধে নেমেছেন ডা: মলয় কুমার শূর ও ডা: বরুন কুমার দত্ত। তবে এ বিষয়ে একেবারেই নীরব ডা: আবু সুফিয়ান। কোনো তৎপরতায় নেই তিনি। এ দিকে, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে রেষারেষি ছড়িয়ে পড়ছে তৃণমূলেও।
গত অক্টোবরে সাতক্ষীরা জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালে মারামারিতে জড়িয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ডা: এ বি এম আব্দুর রউফ ও ডা: বিপ্লøবজিৎ নামের দুই কর্মকর্তা। বিসিএস (পশুসম্পদ) ক্যাডারের ১৯তম ব্যাচের এই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদেরকে লঘুদণ্ড হিসেবে ‘তিরস্কার’ দণ্ড দিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কর্মকতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বার্থগুলো নিয়ে এ দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতেও রূপ নেয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটিতে, যা নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও অস্বস্তিতে আছে বলে জানা গেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা