১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ুতে অর্থায়ন হ্রাসে উদ্বেগ

-


স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনায় এবং জলবায়ু খাতে অর্থায়ন ক্রমেই কমছে বলে মন্তব্য করেছে নীতি গবেষণা সংগঠন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ।
গতকাল ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটিতে ‘সবুজ অর্থনীতি ও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জলবায়ু, পরিবেশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসংক্রান্ত বিষয়ে মতামত’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি এ কথা জানায়। এতে উল্লেখ করা হয়, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে জলবায়ু সম্পর্কিত বাজেট বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশ কম। আর ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের তুলনায় বাজেটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের কাজ বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় প্রকৃত বরাদ্দ ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ কমেছে। জলবায়ু সহনীয়তা ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিতে বাজেটে জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ ব্যয় করা প্রয়োজন। দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়লেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে জলবায়ু সম্পর্কিত বাজেট বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ০.৭০৬ শতাংশ, গত বছরের তুলনায় কমেছে।

সংবাদ সম্মেলনে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসেন খান বলেন, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় এবারের বাজেটে পরিবেশ,বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ দুই হাজার ১৩০ কোটি টাকা বাড়লেও বিদ্যমান মুদ্রাস্ফীতির বিবেচনায় প্রকৃত বরাদ্দ কমেছে। দুর্যোগ বাড়লেও কৃষি, স্বাস্থ্য এবং পানিসম্পদ খাতে জলবায়ু সম্পর্কিত বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক বা তার সামান্য বেশি। তীব্র দাবদাহ, শৈত্যপ্রবাহ, মৌসুমের বাইরে বৃষ্টিপাতসহ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং শিলাবৃষ্টির মতো দুর্যোগ বাড়লেও খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা, দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা এবং গবেষণা ও জ্ঞান ব্যবস্থাপনায় জলবায়ু সম্পর্কিত অর্থায়ন ক্রমেই কমছে। অভিযোজন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং গবেষণায় জলবায়ু সম্পর্কিত অর্থায়ন ক্রমেই কমছে।

জাকির খান বলেন, প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ এনডিসিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪১১৪.২ মেগাওয়াট। প্রতি অর্থ বছরে গড়ে কমপক্ষে প্রায় তিন হাজার ৮৬ কোটি টাকা প্রয়োজন হলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নবায়নযোগ্য শক্তি বাবদ মাত্র ১০০ কোটি টাকা বা মাত্র ৩.২ শতাংশ তহবিল বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। প্রতি অর্থবছরে বাংলাদেশে সার্বিক জলবায়ু অর্থায়নে ঘাটতি ২৩.৪ বিলিয়ন ডলার। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হারানো কর্মদিবসের আর্থিক মূল্য বিবেচনায় সার্বিক জলবায়ু অর্থায়নে ঘাটতি বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার। ঘাটতির তুলনায় আন্তর্জাতিক উৎস হতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রতিশ্রুত প্রতি বছর ১১.৪ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়নসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রায় ২৫ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ২৯.৩ বিলিয়ন ডলার) প্রদানের যে উদ্যোগ নিয়েছে জলবায়ু ঋণ না নিয়ে এ তহবিল থেকে অনুদান পেতে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে দ্বিপক্ষীয়ভাবে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। প্যারিস চুক্তির আওতায় সরকার জলবায়ু সহনীয়তার জন্য কার্বন নিঃসরণকারী জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর কার্বন কর আরোপ করা উচিত, তাহলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি অভিযোজনেও বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হবে, পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কমে বায়ু দূষণের পরিমাণ কমে যাবে। কার্বন কর, দূষণ করারোপের মাধ্যম বছরে সর্বোচ্চ ৩.৪ বিলিয়ন ডলার সবুজ অর্থায়ন সম্ভব বলেও জানান জলবায়ু অর্থায়ন বিশেষজ্ঞ এম জাকির হোসেন খান।

ক্রমবর্ধমান পানি, মাটি দূষণসহ শ্রমিকের দেহের ভেতরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তৈরি পোশাকের ভোক্তার উপর পরিবেশ সংরক্ষণ ফি/করারোপের সুপারিশ জানিয়েছে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। সংগঠনটি বলেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির মূল্য প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার আমদানিকারক দেশ কর্তৃক দূষণকারী কর্তৃক ক্ষতিপূরণ নীতিমালার আওতায় আমদানিকারক দেশ খুচরা ক্রয়ের ওপর ১০% হারে পরিবেশ সংরক্ষণ করারোপ করতে বার্ষিক প্রায় ২.১৩ বিলিয়ন ডলার (২৬,৪৫০ কোটি টাকা) রাজস্ব আদায় করা সম্ভব। নির্দিষ্ট চুক্তির আওতায় করের টাকা বাংলাদেশের পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষকরে নদী ও মাটি দুরূপ এবং অনস্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা যেতে পারে। এ ছাড়া ভারতের ক্লিন এনভায়রনমেন্ট আইনের মতো বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির ওপর ৫% থেকে ১০% পর্যন্ত কার্বন কর আরোপ করে বার্ষিক ২০৬০ থেকে ৪১২০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আদায় সম্ভব। এ ছাড়া প্লাস্টিক, ইট ভাটা, বিল্ডিং, দূষণকারী প্রতিষ্ঠান, পানি উত্তোলন ও বনভূমি কর্তনের উপর ৫% দূষণ করারোপের মাধ্যমে আরো ২৯০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব।

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ইতোমধ্যে গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমাল ২০টি জেলায় ৩,৮৩,৮১৫ জন মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেÑ অদূর ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ হতে যাচ্ছে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ থেকে বলা হয়, গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স এ ২০০০-২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৭ম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিশ্বব্যাপী গড় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির চেয়ে বাংলাদেশে বছরে দ্রুত এবং ৩.৪২ মিলিমিটার বেশি হারে বাড়ছে। শুধু ক্রান্তীয় ঝড়ের কারণে বার্ষিক গড় ক্ষতি প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৩.৩ মিলিয়ন লোক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ অভিবাসনে বাধ্য হতে পারে। বাংলাদেশ প্রায় ১০% আমন ধানের উৎপাদন হ্রাসের ঝুঁকির সম্ভাবনা আছে। জলবায়ুর ঝুঁকি সূচকে রংপুর এবং বরিশাল বিভাগ কাছাকাছি অবস্থান করলেও রংপুর বিভাগের তুলনায় বরিশালে বিসিসিটিএফ থেকে জনপ্রতি প্রায় ৯ গুণ বেশি তহবিল বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থায়নে সুশাসন নিশ্চিতে ২০২২ সালে সোয়াস, ইউনিভার্সিটি প্রকাশিত গবেষণা এবং ২০১৯ বিসিসিটিএফসহ বিসিসিটিএফের প্রকল্প মূল্যায়নের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং শুদ্ধাচার নিশ্চিতে প্রকল্প এলাকার জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু, পরিবেশ, দুর্যোগ সহনীয় পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন এবং তদারকির নেতৃত্ব প্রদান করলে দক্ষতা এবং স্থায়িত্বশীলতা দুই-ই অর্জন সম্ভব।

তাপপ্রবাহ কমাতে সমন্বিত কুলিং এবং গ্রিন জোন প্রতিষ্ঠা, কার্বন- নির্গমনভিত্তিক কর ও দূষণ কর প্রবর্তন, জলবায়ুসংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব করা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আরো ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, দুর্যোগ ব্যাবস্থাপনা উন্নত করা ও ভর্তুকিভিত্তিক দুর্যোগ বীমা চালু, অঞ্চলভেদে যথাযথ শুধু সবুজ অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেয়া, শিল্প ও পরিবহন খাতে নবায়নযোগ্য শক্তির মসৃণ রূপান্তর, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য গভীর বনে টিলা এবং অধিক মিষ্টি পানির কূপ খনন বিষয়ে বাজেটে বরাদ্দে অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানানো হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।
এ ছাড়াও টেকসই সমৃদ্ধি কৌশল ও পরিকল্পনা নিশ্চিতে জল, বন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার প্রদান করে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রকৃতিভিত্তিক টেকসই সমৃদ্ধি কৌশল প্রনয়ন; নীতি ও প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার; টেকসই সমৃদ্ধি অর্থায়ন কৌশল প্রণয়ন; এবং সবুজ বাজেট বাস্তবায়নে জিডিপির কম্পক্ষে ৫% ব্যয় করা; দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিলের পাশাপাশি উদ্ভাবনী অর্থায়ন সবুজ করনীতি প্রণয়ন, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং সবুজ সেবা ও পণ্যকে সব ধরনের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ করারোপ হতে অব্যাহতি; দুর্নীতি, অর্থ পাচার, কর ফাঁকি রোধে সব ধরণের নেতিবাচক প্রণোদনা এবং পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো পরিবহন ব্যবস্থায় আইনি বাধ্যতার সুপারিশ করে।

 


আরো সংবাদ



premium cement