গাউছিয়া কাপড়ের হাটে ৩৫ হাজার নারীর দারিদ্র্য জয়
- মীর শফিকুল ইসলাম কাঞ্চন শিল্পাঞ্চল (নারায়ণগঞ্জ)
- ১২ জুন ২০২৪, ০২:০৭
হাজারো ক্রেতা বিক্রেতাদের ভিড়ে দম ফেলার ফুসরত নেই। কেনাকাটায় যে যার মতো ব্যস্ত। শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রি পিছ ও থান কাপড়ের এক সুবিশাল বাজার। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে সারা দেশ থেকে ৩৫ হাজার নারীর কর্মযজ্ঞে পরিণত হয়েছে এই গাউছিয়া মার্কেট। বস্ত্র কেনাকাটায় এ মার্কেটের জুড়ি নেই। নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা গাউছিয়া এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন এক বিশাল কাপড়ের মার্কেট প্রতি মঙ্গলবার সপ্তাহে ১ দিন পাইকারি হাট বসে। সারা দেশ থেকে আসা প্রায় ৩৫ হাজার নারী দারিদ্র্য জয় করেছে রূপগঞ্জের এ গাউছিয়া মার্কেটে মাধ্যমে। ব্যবসায়ীরা বলছেন এ মার্কেটটি নারী ক্রেতার ওপরই বেশি নির্ভরশীল। জীবন সংগ্রামে জয়ী হতে গাউছিয়ার বাজারে ক্রমেই নারী ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার পূর্বে রূপগঞ্জ উপজেলার গোলাকান্দাইল এলাকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে এই বিশাল গাউছিয়া মার্কেট। তৎকালীন বারো ভূঁইয়ার এক ভূঁইয়া গোলবক্স ভূঁইয়ার বড় ছেলে আলহাজ মজিবুর রহমান ভূঁইয়া এ মার্কেট প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৯ সালে ছোট পরিসরে এখানে বেচাকেনা শুরু হয়। পরে এটি সংস্কার করে ১৯৮৫ সালে এখানে পাকা ভবন নির্মিত হয়। ধীরে ধীরে ১২০ বিঘা জমির ওপর গাউছিয়া মার্কেট সম্প্রসারিত হয়। বর্তমানে গাউছিয়া-১, গাউছিয়া-২ ও গাউছিয়া-৩ যা সিটি মার্কেট নামে পরিচিত। এখানে প্রায় সাড়ে সাত হাজার দোকান রয়েছে। এই মার্কেটটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ একক মালিকানা মার্কেট হিসেবেও খ্যাতি রয়েছে। এই হাটে প্রতি মঙ্গলবারে হাট বসার কথা থাকলেও সোমবার থেকেই বিকিকিনি শুরু হয়ে যায়। শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা, ওড়না, থানকাপড়, গজ কাপড়, থ্রিপিছ, গ্রে কাপড়, বিছানার চাদর, মশারি, রেডিমেট গার্মেন্ট ও সকল প্রকার ইলেক্ট্রনিকস মালামাল পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়ের হাট হলেও শাড়ি ও লুঙ্গির জন্য বিখ্যাত এই গাউছিয়ার হাট।
প্রায় ৪ যুগের কিংবদন্তি হয়ে উঠা এই বস্ত্র হাটের অলিতে গলিতে আলো আঁধারিতে হাজার হাজার দোকানের বিস্ময়ে হাজারো ক্রেতার ভিড়ে পা ফেলা দায়। ব্যবসায়ীদের জন্য এখানে দিন রাতের ফারাক থাকে না। দম ফেলার ফুসরত থাকে না ক্রেতা বিক্রেতাদের। নিশুতি রাতের শুশুপ্তি যখন চরাচর জুড়ে নিথর নিস্তব্দতা অধিকার করে নেয় তখন শুরু হয় এ হাটের হাঁকডাক। দরদামে কোলাহল আর কুলিদের ব্যস্ততা। কাপড়ের গাট উঠছে নামছে। আবার ট্রাকে করে মালামাল নিয়ে যাচ্ছে দূর-দূরান্তে। মার্কেটের থান কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে রঙের গন্ধ। দোকানে দোকানে শাড়ি, লুঙ্গি ও গামছা বিক্রিতে মার্কেটটি দেশের বিখ্যাত তাঁতরস্ত্র বিপণন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এখানে ক্রেতা-বিক্রেতাদের বাড়তি কোনো টোল বা খাজনা দিতে হয় না। এ জন্য ব্যবসায়ীদের পছন্দের শীর্ষে গাউছিয়া হাট।
তিনতলা বিশিষ্ট এ মার্কেটে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার দোকান রয়েছে। রাজধানী ঢাকার পূর্বে সদর দরজার কাছে রূপগঞ্জের গাউছিয়া হাটে অভাবনীয় বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রতি সোম ও মঙ্গলবার এখানে সারা দেশের কাপড় ব্যবসায়ীদের বিপণন তীর্থ হয়ে উঠে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে এই মোকাম। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত চলে বিকিকিনি। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা থাকায় সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নারী ও পুরুষ পাইকাররা এখানে ব্যবসা করতে আসে। প্রায় চার যুগের কিংবদন্তি হয়ে উঠা এই বস্ত্র হাটের অলি গলিতে আলো আঁধারে হাজার হাজার দোকানের দোকানি ও ক্রেতা বিক্রেতাদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। ব্যবসায়ীদের জন্য এখানে ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সপ্তাহের ১ দিনের বিকিকিনি হয় অবিশ^াস্য অঙ্কে। শুধু এক দিনের বেচাকেনাই প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। আর এ হাটের অধিকাংশ ক্রেতাই নারী। এ হাটকে ঘিরে সারা দেশের ৩৫ হাজার নারীর ভাগ্যের চাকা সচল রয়েছে। এর পরেও দিনদিন নারী ক্রেতার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তারা এ হাট থেকে কম দামে শাড়ি লুঙ্গি, থ্রিপিছ কিনে এলাকায় গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছে। এলাকাবাসী এ হাটকে নারীর হাট বলেই চিনে জানে।
সপ্তাহের প্রথম দিন রোববার থেকেই করোটিয়া, শেখেরচরের বাবুর হাট ভেঙে গাউছিয়ার উদ্দেশে রওনা দেয় মালবাহী ট্রাক ও কভার্ডভ্যান। সারি সারি ট্রাক ও ভ্যানগাড়ি মার্কেটের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। এ দিকে কুলি মজুরদের ব্যস্ততা, ক্রেতা বিক্রেতার মাঝে দরদামের হাঁকডাক, কাপড়ের গাট নিয়ে ভ্যান ওপরে উঠছে নামছে। আবার লোড হয়ে ট্রাক দেশের বিভিন্ন জেলায় ছুটে যাচ্ছে। ক্রেতা বিক্রেতা ও কুলিদের হাঁকডাকে মার্কেট প্রাঙ্গণ হয়ে উঠে মুখরিত। মঙ্গলবার কাকডাকা ভোর থেকে এ ব্যস্ততা আরো বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নারী পুরুষ ক্রেতা এসে জড়ো হয় এ হাটে। রমজানের ঈদে বাড়তি যোগ হয় জাকাতের কাপড়। প্রতিটি দোকানেই উপচে পড়া ভিড়। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রখর রোদ সেই সাথে ভ্যাপসা গরমে মানুষের ভিড় ঠেলে বিকিকিনি চলছে গাউছিয়া মার্কেটে। সিলেট, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, শরিয়তপুর, পাবনা, ফরিদপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকারি ক্রেতাদের ভিড়ে মুখরিত গাউছিয়া মার্কেট। সোমবার রাত থেকে বেচাকেনা জমলেও মঙ্গলবার কাকডাকা ভোরে মহিলা ক্রেতাদের ভিড়ে মুখরিত হয় মার্কেট প্রাঙ্গণ। মার্কেট প্রাঙ্গণ ঘুরে নারী ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের দরিদ্র জয়ের নানান গল্পের তথ্য। কষ্টকে জয় করে জীবন সংগ্রামে কিভাবে জয়ী হতে হয়। জানা গেছে ইচ্ছা আর পরিশ্রমই জীবনের চাকা ঘুরাতে কতটা সহায়ক।
ভোর ৬টা। মার্কেটের ভেতর কথা হয় পঞ্চাশোর্ধ বয়সের সাথী বেগমের সাথে। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল এলাকায় তার বাড়ি। স্বামীকে হারিয়ে জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে সাথী। সংসার চালাতে সে হিমশিম খায়। পরে পাশের বাড়ির শায়লা বেগমের কথায় সে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। শায়লা বেগম দীর্ঘ ৯ বছর ধরে গাউছিয়া মার্কেট থেকে কাপড় কিনে গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে নিজের ভাগ্য বদলিয়েছেন। দরিদ্রতাকে পেছনে ফেলে সুখের মুখ দেখেছেন। শায়লার কথামতো সাথীও গত তিন বছর ধরে কাপড়ের ব্যবসা করে দরিদ্রকে জয় করেছেন।
জামালপুরের রোকেয়া বেগম। এক সময় নুন আনতে পানতা ফুরাতো। গাউছিয়া কাপড়ের মার্কেট থেকে প্রতি সপ্তাহে কাপড় কিনে এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে। এখন তার সচ্ছলতা ফিরেছে। বাড়িতে নতুন ঘর দিয়েছে। আর এ টাকা সে কাপড় বিক্রি করেই যুাগিয়েছে। রানী বেগম বলেন এই মার্কেট আমারে সুখের ঠিকানা দিয়েছে। এমনভাবে আছমা বেগম, শরুফা বেগম, আকলিমা বেগম, নুরজাহান ও তুলসী রানী পাল অল্প পুঁজি নিয়ে গাউছিয়ায় ব্যবসা করে আজ তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। তারা মেধা ও শ্রম দিয়ে দরিদ্রকে জয় করতে পেরেছে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ নারীর বয়স পঞ্চাশের ওপরে হলেও দারিদ্র্য ঘোচাতে কাপড়ের গাট মাথায় করে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে। এরা অনেকেই স্বামী হারা, সন্তান হারা অসহায় পরিবারের সদস্য। তারা কারও ওপর নির্ভর করে ঘরে বসে থাকেনি। তারা দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে দেশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত। তাদের একটাই চিন্তা সংসারের লাগাম টেনে ধরতে হবে। এভাবে ৩৫ হাজার নারীর কর্মের জোগান দিয়েছে রূপগঞ্জের এই গাউছিয়া মার্কেট।
ঝিলিক প্রিন্ট শাড়ির মালিক মনির হোসেন বলেন, এই মার্কেটে নারী ক্রেতারাই মূল আকর্ষণ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নারী ক্রেতারা সারা বছরই এখানে ক্রয় করে থাকেন। আর এ বস্ত্র তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে দিচ্ছেন। গ্রাম-গঞ্জের মানুষও তাদের কাছ থেকে কম দামে কাপড় কিনতে পারছে। দিনদিন মহিলা ক্রেতার সংখ্যা বাড়ছে বলেও তিনি জানান। মেহেদী লুঙ্গি বিতানের মালিক অলিউল্লাহ বলেন, আমাদের এ মার্কেটের বিকিকিনি নারী ক্রেতার ওপর বেশি নির্ভরশীল। এখানে অধিকাংশ ক্রেতাই নারী। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নারী ক্রেতারা এসে শাড়ি লুঙ্গি নিয়ে যায়। অনেক নারী এ ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। গাউছিয়া মার্কেটের ম্যানেজার আব্দুল আউয়াল বলেন, আমাদের এ মার্কেটে নারী ক্রেতাই বেশি। তাই তাদের কথা চিন্তা করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। চুরি ছিনতাই রোধে প্রতিটি গলিতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা প্রহরীসহ সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। মার্কেটে রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি।