একদলীয় আধিপত্য ও ব্যবসায়ীদের প্রভাব প্রাধান্য পাচ্ছে
কোটিপতি প্রার্থী ১০৬ জন- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৮ মে ২০২৪, ০০:০০
ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপে এক হাজার ৪১৯ প্রার্থীর মধ্যে ১০৬ জনই কোটিপতি। আর এই নির্বাচনে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন ৬৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ প্রার্থী। যদিও আয়ের বিবেচনায় প্রার্থীরা ৭১ দশমিক ৮৮ শতাংশ ব্যবসা থেকে আয় দেখিয়েছেন বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। টিআইবি বলছে, চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৬৬.৫৩ শতাংশই ব্যবসায়ী, ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৮.৯৯ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৩১.৫৬ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৪৮.৫৪ শতাংশই নিজেকে গৃহিণী হিসেবে/ গৃহস্থালির কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও রাজনৈতিকভাবে একদলীয় আধিপত্যের বিকেন্দ্রীকরণের পাশাপাশি ব্যবসায়ী স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে।
রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ টিআইবি কার্যালয়ে উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে একটি ড্যাশবোর্ড প্রস্তুত করেছে। গতকাল টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশে এইসব তথ্য জানানো হয়। টিআইবির গবেষক রিফাত রহমান গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেন। এ সময় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সম্পদ বিবরণী খতিয়ে দেখার পরামর্শ দেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। প্রতিবেদনে জানানো হয়, তৃতীয় ধাপে ১১২টির মধ্যে ১১১টি উপজেলার প্রার্থীর হলফনামা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। এসব প্রার্থীর হলফনামায় দেয়া আট ধরনের তথ্যের বহুমাত্রিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ও গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা দলের সদস্য ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহসমন্বয়ক ইকরামুল হক ইভান ও কে এম রফিকুল আলম।
হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি জানায়, প্রার্থীদের আয় ও সম্পদের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়েছে। রয়েছে আয়কর রিটার্নের তথ্যের সাথে হলফনামার গরমিল। করজাল বাড়াতে জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের জমা দেয়া এই হিসাব বিবরণী খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিয়েছে টিআইবি।
প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে টিআইবি দেখিয়েছে, গত পাঁচ বছরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সাথে নির্বাচিত হননি এমন প্রার্থীদের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, যে সব জনপ্রতিনিধি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন, তাদের আয় ও সম্পদ বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত ১০ বছরের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, অনির্বাচিতদের তুলনায় আয় ১০ গুণ বেড়েছে। আর অস্থাবর সম্পদ প্রায় ৩৭ গুণ বেশি বেড়েছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। অর্থাৎ ক্ষমতায় থাকার সাথে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট। দশ বছরের হিসাব তুলনা করলে দেখা যায়, পদে থাকা প্রার্থীদের আয় ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৬৮১.৩৭ শতাংশ ও ১০১০.১২ শতাংশ। পদে না থাকাদের এ ক্ষেত্রে আয় ও সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৭১.৭১ শতাংশ ও ৩১.৩৫ শতাংশ।
হলফনামা বিশ্লেষণে টিআইবি বলছে, জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের মতো তৃতীয় ধাপেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট অক্ষুণœ রয়েছে। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৮.১৪ শতাংশ। এ দিকে গৃহিণী/ গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের সাড়ে ১৪ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে। ১৫.১৪ শতাংশ প্রার্থীর কোনো না কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সার্বিকভাবে প্রার্থীদের প্রায় ৩৭ শতাংশ আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন ১০.৫ শতাংশ প্রার্থী। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ২৪.২১ শতাংশের আয় সাড়ে ষোল লাখ টাকার ওপরে। অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ৩.৪৫ শতাংশ। আবার, চেয়ারম্যান প্রার্থীদের ১৯.৫ শতাংশের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অন্যান্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৪৫.৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে অপেক্ষাকৃত ধনীরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তা ছাড়া সার্বিকভাবে তৃতীয় ধাপের প্রার্থীদের মধ্যে ১০৬ জনের এক কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদ রয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা আগের নির্বাচনের তুলনায় হয়েছে প্রায় চারগুণ।
তৃতীয় ধাপের প্রার্থীদের হলফনামার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ১৬ শতাংশ প্রার্থী বর্তমানে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত, অতীতে অভিযুক্ত ছিলেন ২১.৬৩ শতাংশ। বর্তমানে ১০টির বেশি মামলায় অভিযুক্ত প্রার্থীর সংখ্যা সাতজন, একজন চেয়ারম্যান প্রার্থীর সর্বোচ্চ মামলা চলমান রয়েছে ২৭টি, অতীতে ১০টির বেশি মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা ৩৭ জন, পূর্বে সর্বোচ্চ ২৭টি মামলা ছিল একজন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর। প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আঘাত, জনগণের শান্তিভঙ্গ, ভীতিপ্রদর্শন, অপমান, উৎপাত, নারী ও শিশু নির্যাতন, প্রতারণা ইত্যাদি ধরনের মামলা বর্তমানে রয়েছে বা পূর্বে ছিল।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে এখন জনস্বার্থের উপস্থিতি বিরল, আছে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ব্যক্তিস্বার্থের বিকাশের সুযোগ। যারা ব্যবসা করেন, অন্য যেকোনো পেশাজীবীর মতো তারা রাজনীতিতে আসবেন, এটি স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হলো ব্যবসায়ীদের আগ্রাসী অংশগ্রহণ সঠিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় হচ্ছে কি না এবং জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে তারা রাজনীতিতে আসছেন কি না? অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, মুনাফার সম্ভাবনা রয়েছে বলেই রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বাড়ছে, বাড়ছে স্থানীয় পর্যায়ে পরিবারতন্ত্র। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি হতে পারাকে বাজার নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে একদিকে যেমন ক্ষমতা অপব্যবহারের লাইসেন্স হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট খাতে সিদ্ধান্ত ও নীতিকাঠামোতে ব্যবসায়ী লবির প্রভাব ও স্বার্থ রক্ষিত হয়। ফলে যখন অনিয়ম, দুর্নীতি হয় বা সিন্ডিকেট যখন বাজার নিয়ন্ত্রণ করে তখন দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায় না। আবার যারা এই গোষ্ঠীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবেন তাদেরও একাংশ সুবিধাভোগী, অংশীদার বা সুরক্ষাকারী। ফলে রাজনীতিতে মুনাফামুখিতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সদিচ্ছার প্রমাণ রেখে এবং নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি সৎ থেকে জবাবদিহিতামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে সরকারের প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।
সার্বিক বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে প্রার্থীদের আয় বৃদ্ধির বিষয়টি ইসি ও এনবিআরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যাদের সম্পদের বিবরণ দেয়া হয়েছে তার উৎস খতিয়ে এবং আয়ের সাথে সম্পদের বিকাশ সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না সেটা আইন অনুযায়ী খতিয়ে দেখা উচিত। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের যেমন প্রার্থী বাতিলের এখতিয়ার আছে, তেমন আইনগত প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করারও দায়িত্ব রয়েছে। আবার করের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। আয়কর রিটার্নের তথ্যের সাথে হলফনামার গরমিল রয়েছে সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। জনপ্রতিনিধি ও প্রার্থীরা যে হিসাব জমা দিয়েছেন সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় তা যদি আইনগতভাবে এনবিআর অনুসন্ধান করে তাহলে করনেট বৃদ্ধির কথা বলে সেখানে সাফল্যজনক ফলাফল পাওয়া সম্ভব।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা