মাছের রাজ্যে মাছের আকাল জেলেপল্লীতে হাহাকার
- মাকসুদুর রহমান পারভেজ লালমোহন (ভোলা)
- ১৬ মে ২০২৪, ০০:০০
দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহন উপজেলার জেলেপল্লীগুলোতে অভাব-অনটনে সর্বাবস্থায় হাহাকার চলছে। গত ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দীর্ঘ দুই মাস মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ওই নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর নদীতে গিয়ে আশানুরূপ মাছ না পেয়ে খালি হাতে ফিরে আসছেন জেলেরা। তাছাড়া দাদন ও সুদের দেনার ফাঁদেও আটকে আছেন জেলেরা। দেনা থেকে মুক্তি মিলছে না মৃত্যুতেও। এতে বলা যায় মাছের রাজ্যে মাছের আকাল। জেলে পল্লীতে হাহাকার। নদীতে গিয়ে আশানুরূপ মাছ না পাওয়ায় দিনের পর দিন বাড়ছে সুদের মুনাফা, জেলেদের জীবন কাটছে দুরাশায়, চোখে মুখে দেখছেন শুধু মরীচিকা। অন্যদিকে জেলেপল্লীর শিশু-কিশোররাও দিন দিন ঝরে পড়ছে পড়ালেখা থেকে। তারা বেছে নিয়েছেন বাপ-দাদার মাছ ধরা পেশা।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ২৪ হাজার ৮০৬ জন। তবে এর প্রকৃত সংখ্যা অন্তত ৩০ হাজার । যারা কেবল মাছ ধরার ওপরই নির্ভরশীল। লালমোহন উপজেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদী এলাকায় ছোট-বড় অন্তত ২৫-৩০টি মৎস্যঘাট থেকে জেলেরা মাছ ধরতে নদীতে যায়। উপজেলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকাকে অভয়াশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। উপজেলার কোভখালী ও গাইট্টার খাল মাছ ঘাটের ৪০ ও ৩৮ বছর বয়সী জেলে মো: নাজিম উদ্দীন ও মো: আলী। তাদের পেশা শুধু মাছ শিকার করা। তাদের বয়সের বেশির ভাগ সময়ই কাটিয়েছেন মেঘনা নদীতে মাছ শিকার করে। এই নদীই তাদের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম। বুড়িরদোন ঘাটের মৎস্যজীবী মো: শাহে আলম মাঝি বলেন, সম্প্রতি শেষ হওয়া নিষেধাজ্ঞা শেষে ১৫ জন জেলেসহ মেঘনা নদীতে মাছ ধরতে যায়। একদিন নদীতে মাছ ধরার জন্য ট্রলারের তেল, চাল, ডাল এবং অন্যান্য খরচ বাবদ প্রায় দশ-পনের হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। সারা রাত মাছ ধরে সকালে ঘাটে ফিরে মাছ বিক্রি করেছি মাত্র সাত-আট হাজার টাকার। সেখান থেকে কমিশন বাবদ প্রায় ৯০০ টাকা কেটে রেখেছেন আড়তদার। লাভ তো দূরের কথা, ওই দিন লোকসানই হয়েছে প্রায় চার-পাঁচ হাজার টাকা। এতে করে দিনের পর দিন দেনার পরিমাণ কেবল বাড়ছেই।
নদীতে তেমন মাছ না থাকায় এখন আর মাছ ধরতে যাইতে ইচ্ছে করে না। সর্দারের খাল মাছ ঘাটের জেলে মো: রফিক মিয়ার মতো এমন অনেক জেলেই লোকসানের ভয়ে নদীতে যাচ্ছেন না বলে এ প্রতিনিধিকে জানান। যার ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাবে দিন কাটছে লালমোহন উপজেলার বেশির ভাগ জেলের। ওই মৎস্যঘাটের মোসলে উদ্দীন মাঝি, আজাহার মাঝিসহ আরো বেশ কয়েকজন জেলে জানান, আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি; যখন নদীতে মাছ থাকে তখন মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। আর যখন মাছ থাকে না তখন নিষেধাজ্ঞাও থাকে না। এ কারণেই মূলত আমরা মাছ পাচ্ছি না, ধারদেনায় জড়িয়ে থাকি বছরের পর বছর। তাই মৎস্য বিভাগসহ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অনুরোধ সামনের দিকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার। ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের বাতিরখাল মৎস্যঘাটের জেলে আনিচুল হকসহ আরো একাধিক জেলে বলেন, মহাজনরা আড়তদারদের কাছ থেকে দাদনের টাকা নিয়ে নৌকা বা ট্রলারে থাকা অন্যান্য জেলেদের মধ্যে টাকা বিতরণ করেন। এরপর মহাজন নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার সময় দাদনের টাকা নেয়া ১৫-১৬ জন জেলেকে সাথে নেন। জেলেরা মাছ ধরা এবং বিক্রির ওপর টাকা পায়। দেখা যায় জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে আড়তদারের কাছ থেকে যে টাকা নেন, মাছ না পেলে ওই টাকা দেনাই থেকে যায়। আবার নতুন করে মাছ ধরতে গেলে আড়তদারের কাছ থেকে আবারো দাদন নিয়ে যেতে হয়।
এভাবে দাদনের টাকা বাড়তে বাড়তে এক সময় পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায়। জেলেরা যতদিন নদীতে মাছ ধরবে ততদিন আড়তদার দাদনের টাকা ফেরত চায় না। জেলেরা যখন মাছ ধরা ছেড়ে দেয় তখনই ফয়সালার মাধ্যমে আড়তদারের টাকা ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই টাকা ফেরত দিতে গিয়ে দেনাগ্রস্ত অনেক জেলেকে ভিটেমাটি বিক্রি করতে হয়। যার কারণে ইচ্ছা থাকার পরও অনেকে জেলে পেশা ছাড়তে পারছেন না। এভাবেই বেশির ভাগ জেলেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ পেশায় জড়িয়ে বেড়াতে হয় দাদনের বোঝা। মৃত্যুর পরও মেলে না মুক্তি। কারণ দাদন নিয়ে মারা গেলে ও জেলেদের ওয়ারিশরা দাদনের ওই টাকা ফেরত দিতে হয়। অন্যদিকে জেলেপল্লীর শিশু-কিশোররাও ঝরে পড়ছে লেখাপড়া থেকে। পড়ালেখা ছেড়ে তারা জড়াচ্ছেন বাপ-দাদার মাছ ধরা পেশায়। কামারের খাল ও জোড়া খাল মৎস্যঘাটের এমনই কয়েকজন ১৪-১৫ বছর বয়সী শিশু-কিশোরকে দেখা যায় মাছ শিকারে। বিদ্যালয়ের বারান্দায় তাদের ছোঁয়া লেগেছে ঠিকই, তবে তা দীর্ঘাস্থায়ী হয়নি। কোনো রকমে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণীতে। তখন থেকে মাঝে মধ্যে স্বজনদের সাথে নদীতে যাওয়া শুরু হয় শিশু কিশোরদের। একপর্যায়ে নদীতে মাছ শিকার করা তাদের পেশা হয়ে যায়। মাছ শিকার পেশা হওয়ায় ছেড়ে দিয়েছেন পড়ালেখা। মেঘনা তীরবর্তী এলাকার শিপন ও রিয়াজ নামের দুইজন শিশু জানায়, স্বজনদের সাথে প্রথমে শখ করে নদীতে যাওয়া শুরু করি। সেই শখই এখন পেশা। প্রথম প্রথম নদীর উত্তাল ঢেউ দেখে ভয় হতো। তবে এখন সেই ভয় কেটে গেছে। এখন স্থানীয় অন্যান্য জেলেদের সাথে নিয়মিত মাছ শিকারে যাই। যেদিন মাছ শিকারে যাই সেদিন কখনো ২০০ কখনো ৪০০ টাকা পাই। আবার কখনো খালি হাতেই ফিরতে হয়। যখন নদীতে গিয়ে মাছ ধরে টাকা পাই, তখন ওই টাকা মা-বাবার হাতে তুলে দিই।
ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের পাটাওয়ারীর হাটসংলগ্ন মৎস্যঘাটের আড়ৎদার ও ঘাটের সাধারণ সম্পাদক মো: সালাউদ্দিন দালাল বলেন, এ ঘাটে ৪৫-৬০টি মাছ ধরার ট্রলার রয়েছে এতে এ ঘাটে দুই থেকে আড়াই হাজার জেলে পেশাজীবী রয়েছে, গত অবরোধের পর বর্তমানে জেলেরা নদীতে মাছ ধরতে নেমে প্রতিদিন প্রায় খালী হাতেই ফিরতে হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, একে তো নদীতে মাছ নেই আবার কোস্টগার্ড আতঙ্ক থাকে জেলেরা, তজুমদ্দীন থেকে ডিউটিরত কোস্টগার্ডের সদস্যরা বিভিন্নভাবে হয়রানি করছেন জেলেদের, কোনো কোনো জেলেদের বিভিন্ন অজুহাতে জাল নৌকা নিয়ে যায় আবার কারো কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে ছেড়ে দেয় বলে জানান এ সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় জেলেরা। ওই মৎস্যঘাটের সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, বড় মাছতো পাওয়াই যাই না, দু-চারটি জাটকা ইলিশ ছাড়া মিলছে না কোনো কিছু এতে প্রতিনিয়ত কোস্টগার্ডের লোকজন অভিযান চালায়। জেলেদের জীবন মান রক্ষার্থে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাচ্ছি সাধারণ জেলেদের দিক বিবেচনা করে যেন আর হয়রানির শিকার হতে না হয়।
লালমোহন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা /চ: দা: মো: আলী আহমদ আখন্দ দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে নদীতে মাছ কম আসে তবে সাগরে প্রচুর মাছ রয়েছে। আশা করি সামনের দিনগুলোতে মাছ পড়বে। তবে প্রচুর বৃষ্টি হলে নদীর পানি বাড়বে, তখন নদীতে মাছও আসবে। এরপর জেলেরা নদীতে গিয়ে তাদের আশানুরূপ মাছ পাবেন বলে আশা করছি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা