২০ মে ২০২৪, ০৬ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫
`


অনলাইনে চলছে জুয়া ও অর্থপাচারের মহোৎসব

টিআইবির উদ্বেগ ও বন্ধের দাবি
-


দেশে মূলধারার সম্প্রচার মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনলাইন জুয়ার প্রসার এবং এর মাধ্যমে অর্থপাচারের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনলাইন জুয়া বন্ধে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উল্টো ভিন্ন মোড়কে জুয়ার বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে, বিশেষ করে তরুণ সমাজকে অনলাইন জুয়ার নেশার কবল থেকে রক্ষা করতে অবিলম্বে এ সংক্রান্ত সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ ও জুয়া প্রতিরোধ আইন পাসসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবি বলছে, দেশের প্রচলিত আইনে যেকোনো ধরনের জুয়া নিষিদ্ধ হলেও নানা কৌশলে অনলাইন জুয়ার প্রচার ও প্রসার চলছেই। মূলধারার সম্প্রচার মাধ্যমে আইপিএল, বিপিএলসহ জনপ্রিয় খেলা সম্প্রচারসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বেটিং সাইটের চটকদার বিজ্ঞাপন ভিন্ন মোড়কে বা ‘সারোগেট’ বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করা হচ্ছে। এমনকি এ বছরের বিপিএলে একটি দলের জার্সিতে জুয়ার ওয়েবসাইটের সারোগেট বিজ্ঞাপনও দেখা যায়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চরম উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি, দেশে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপনের মহোৎসব চলছে। আইনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শুধু মুনাফার লোভে দেশকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া কোনোমতেই দায়িত্বশীল গণমাধ্যমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে না। ইদানীং শহরের বিভিন্ন বিলবোর্ডেও অনলাইন জুয়ার সাইটের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতে দেখা যাচ্ছে। গত বছর উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশন; বিশেষ করে স্পোর্টস চ্যানেলসহ ডিজিটাল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বাজি ও জুয়ার বিজ্ঞাপনের রমরমা প্রচার চলছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

টিআইবি মনে করে, শুধু অনলাইন জুয়ার মাধ্যমেই দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা আরো বড় উদ্বেগের বিষয়।
গণমাধ্যম ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের সূত্রে জানা যায়, শহর থেকে গ্রামসহ সারা দেশে লাখ লাখ মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর মাধ্যমেই বিপুল অঙ্কের টাকা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, ই-ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ক্রিপ্টোকারেন্সিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাচার হয়। অনলাইন জুয়ার অ্যাপসের বেশির ভাগই রাশিয়া, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া থেকে পরিচালনা করা হলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এগুলোর স্থানীয় এজেন্ট রয়েছে। এসব এজেন্ট মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে টাকা আদান প্রদান করেন। আবার এই এজেন্টদের মাধ্যমেই বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ চোখের সামনে হয়ে যাওয়া এই পাচার রোধে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)সহ কোনো দায়িত্বশীল সংস্থ্ারই কোনো কৌশলগত উদ্যোগ বা প্রচেষ্টার কথা জানা যায় না। একইভাবে সব নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে চলছে এ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনের বিশাল ব্যবসা, যা অবৈধ ও অনৈতিক।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, বিভিন্ন সময়ে জুয়ায় আসক্ত হওয়া ও সর্বস্ব খুইয়ে আত্মহত্যার ঘটনা আমরা নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন সংবাদে দেখছি। সম্প্রতি ঠাকুরগাঁওয়ে একজন ৩৫ বছরের যুবক অনলাইন জুয়ায় ১৫-২০ লাখ টাকা হারিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। পারিবারিক অশান্তি-কলহ, বিষণœতা, সর্বোপরি জুয়ায় সর্বস্ব খোয়ানোর ঘটনার পাশাপাশি অবৈধ উপায়ে বিপুল বিত্ত-বৈভব অর্জনের ঘটনাও ঘটে চলেছে। জুয়ার নেশা আমাদের অমিত সম্ভাবনাময় তারুণ্যের নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে তুলছে।
অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ১৮(২) অনুচ্ছেদ ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী, যেকোনো ধরনের জুয়া প্রতিরোধ করতে সরকারের ওপর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে দেশে এখনো জুয়া প্রতিরোধে ব্যবহার হচ্ছে ১৫৭ বছরের পুরনো আইন।

সরকার জুয়া প্রতিরোধ আইন, ২০২৩ প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও এখনো তা খসড়া পর্যায়েই রয়ে গেছে। অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপটে জুয়া প্রতিরোধে কঠোর ও যুগোপযোগী আইন আরো আগেই প্রণীত ও প্রয়োগ হওয়া প্রয়োজন ছিল। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে আইনটি এখনও খসড়া অবস্থাতেই রয়েছে। খসড়া আইনের ৬ ধারায় দূরবর্তী জুয়া ও অনলাইন জুয়ার প্রকৃতি এবং ৭ ধারায় বাজি বা বেটিং সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে, বেটিং, অনলাইন জুয়া প্রচারণার বিশ^ব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় সারোগেট বিজ্ঞাপন প্রচার এবং অনলাইন বেটিংয়ের সঙ্গে অর্থ পাচারের যোগসূত্রের ব্যাপারগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে। আবার, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা এর ৪.৫.৩ (ঘ) ধারা অনুযায়ী বাজি ধরা বা জুয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্থা/কোম্পানি/ব্যক্তির বিজ্ঞাপন প্রচার নিষিদ্ধ করা হলেও সারোগেট বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধে কোনো নির্দেশনা দেয়া নেই। অন্য দিকে, অনলাইন জুয়া রোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর স্বপ্রণোদিত ভূমিকা দেখা যায় না। অনলাইনের অবারিত দুনিয়ায় জুয়া বা বেটিংয়ের প্রসার রোধে সবার আগে এর প্রচারণা রোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর স্বপ্রণোদিত উদ্যোগ জরুরি। অনলাইন জুয়া প্রতিরোধে এ সংক্রান্ত সব প্রকার বিজ্ঞাপন প্রচারের সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত নজরদারি ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।

 


আরো সংবাদ



premium cement