পোলট্রি-ফিসফিডের বস্তায় রেলের ডিজেল পাচার
- এরশাদ আলী খুলনা ব্যুরো
- ৩১ মার্চ ২০২৪, ০২:১২
বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশন থেকে তেল পাচারের নানা মজার গল্প শোনা যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় সেসব পাচারের কিছু খবরও প্রকাশিত হয়। কিন্তু এখন বস্তায় ভরে চলন্ত ট্রেন থেকে তেল পাচারের একটি কৌতুককর কাহিনী জানা গেছে। এটাকে রেলওয়ের চাকুরেদের নতুন আবিষ্কার বলা যায়। এ ছাড়া ঘটনার বয়ান ও তদন্ত রিপোর্টে রেকর্ডের সাথে সামঞ্জস্যহীন তথ্যাদি, গোঁজামিল, একই বিষয়ে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য এবং মুখ বাঁধা বস্তায় মাছের পোনা রাখার মতো হাস্যকর কাহিনীও রয়েছে।
ঘটনাটি ২০২২ সালের আগস্টের বলে রেল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এত দিন আমরা জানতাম তরল পদার্থ তেল প্লাস্টিক বা টিনের কনটেইনারে রাখা এবং বহন করতে হয়। রেলের তেল পাচারের যেসব খবরাদি এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে, সেসবেও কনটেইনার ব্যবহার করার কথাই লেখা হয়েছে। কিন্তু সার, ফিস বা পোলট্রি ফিড ভরার অসংখ্য ছিদ্রবিশিষ্ট বস্তায় করে তেল পাচারের কথা আগে শোনা যায়নি। এখন বাংলাদেশ রেলওয়ের পাকশী অফিস অন্তত কাগজে কলমে সেটা সম্ভব করেছে। আর বস্তায় তেল ভরে চলন্ত ট্রেন থেকে নিচে ছুড়ে ফেলে পাচার করার অভিযোগে একজন লোকো মাস্টার (ট্রেন চালক) ও তার সহকারীকে সাথে সাথে সাসপেন্ড করা হয়। পরে আবার সাসপেনশন প্রত্যাহার করে শুধু লোকো মাস্টারকে কয়েকটি শাস্তি প্রদান করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২২ সালের ৩ আগস্ট তারিখ ৬৫১৫ ইঞ্জিন নম্বরধারী কেএন-১ আপ তেলবাহী ট্রেন নিয়ে খুলনা থেকে ঈশ্বরদী রওনা হন এল এম (লোকো মাস্টার) আবুল কালাম আজাদ। তার সহকারী ছিলেন এ এল এম ইকবাল হোসেন। গার্ড রিপোর্ট অনুযায়ী, ট্রেনটি রাত সোয়া ১টায় ছাড়ার কথা থাকলেও ৩টা ২৫ মিনিটে খুলনা থেকে যাত্রা শুরু করে এবং রাত ২০টা ৫ মিনিটে ঈশ্বরদী পৌঁছে। ট্রেনের স্কটপার্টিতে ছিলেন সিপাহি হেমায়েত হোসেন মোল্লা ও গৌতম কুমার। তাদের মধ্যে গৌতমের বরাত দিয়ে ওইদিনই খুলনার আরএনবি/আইবির সাব ইন্সপেক্টর রাজশাহীর আরএনবির কমান্ড্যান্টকে লিখিতভাবে এক প্রাথমিক প্রতিবেদন দেন।
সিপাহি গৌতম তার ফোনে ধারণ করা ৫৮ সেকেন্ডের ভিডিও ক্লিপটি তার ফেসবুক পেজে পোস্টও করে। ভিডিও ক্লিপ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাতে শুধু গার্ড ব্রেকের নিকটবর্তী দৃশ্য ধারণ করা আছে। একজনের কণ্ঠস্বর, যাতে বলা হচ্ছে ‘ইনসান তোর অবস্থা কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে ভাই বললাম’ শোনা যায়। সেটাতে ইঞ্জিন থেকে কোন কিছু ফেলার দৃশ্য নেই। অবশ্য ৩০ ওয়াগন সমন্বিত ট্রেনের গার্ড ব্রেক থেকে ইঞ্জিনের দূরত্ব এক কিলোমিটার হয় এবং সেখান থেকে সামনের প্রায় ১০ কিলোমিটার রেলট্রাক স্রেইট হওয়ার কারণে গার্ড ব্রেক থেকে ইঞ্জিন দেখা সম্ভব না বলে অভিজ্ঞ একজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বস্তাগুলোর ভেতরে অতিরিক্ত নি-িদ্র কোনো পলিথিন ব্যহারের নমুনাও দৃশ্যমান নয়। বস্তার সাইজ দেখে সেগুলোতে কঠিন বস্তু থাকলে ওজন কমপক্ষে ৩৫-৪০ কেজি করে হবে বলে যারা এসব বস্তা ব্যবহার করেন তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। তরল পদার্থ হলে লিটারের পরিমাণ আরো বেশি হবে। সে হিসেবে চার বস্তায় কমপক্ষে ১৬০ লিটার তেল পাচার হওয়ার কথা। কিন্তু পাচারের অভিযোগ মাত্র ৩০ লিটারের। আবার চলন্ত ট্রেন থেকে ও রকম সাইজের বস্তা ফেললে ৪টা চার জায়গায় পড়ার কথা। কিন্তু ২টা বস্তা আছে এক জায়গায়।
যাহোক এ অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে পাকশী অফিসের বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী (লোকো) আশীষ কুমার মণ্ডল ওই ট্রেনের এল এম আজাদ ও এ এল এম ইকবালকে সাসপেন্ড করেন।
ঘটনার পর দিন ৪ আগস্ট এল এম আজাদকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। এরপর তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে ৪-১২-২২ তারিখে আজাদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি চার বছরের জন্য স্থগিত, এল এম গ্রেড-২ থেকে এ এল এম গ্রেড-১ পদে পদাবনত, বেতন ১৩তম গ্রেড থেকে ১৬তম গ্রেডে অবনমন এবং খুলনা লোকোসেড থেকে পার্বতীপুর লোকোসেডে বদলি করার শাস্তি দিয়ে আবার কাজে যোগ দিতে বলা হয়। এ এল এম ইকবালকে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
অনেক দিন ধরে চেষ্টা করেও শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি না পেয়ে এল এম আজাদ ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট তারিখে খুলনার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক, পশ্চিম রেলওয়ের সিনিয়র পার্সোনেল অফিসার এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে, পাকশীর ডিভিশনাল ম্যানেজার, বিভাগীয় যন্ত্র প্রকৌশলী ও সহকারী যন্ত্র প্রকৌশলীকে বিবাদি করা হয়।
এ ব্যাপারে অভিযোগকারী সিপাহি গৌতমের সাথে ফোনে কথা হলে, যেখানে ভিডিও করা হয় সেখান থেকে ট্রাক সুতার মতো সোজা। তার আগে বাঁক ছিল। সেখান থেকে ইঞ্জিন দেখা যায়। সাদা বস্তার ভেতরে পলিথিন দিয়ে তেল নেয়া যায়। ভিডিও ক্লিপে তিনি ইনসান নামের যে লোককে সাবধান করেন সে আগের পরিচিত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাস্তার পাশে তারা যখন বলাবলি করছিল সেখান থেকে নাম শোনেন। অথচ ভিডিও ক্লিপে দেখা যায় লোক তিনজন বরাবর পৌঁছানোর আগেই তিনি বলা শুরু করেন।
পাকশী অফিসের ডিইই আশীষ মণ্ডলের অফিসিয়াল মোবাইল ফোনে কল দিয়ে জানা যায় তিনি চীনে ট্রেনিংয়ে আছেন, ফিরবেন ৭ এপ্রিল।
এল এম আবুল কালাম আজাদের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি চুরি-দুর্নীতি করতে পারি না- এটাই আমার অপরাধ। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা