১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


প্রকল্পের মাঝপথেই ভবন ফ্লোর ও টাইলসে ফাটল

-


-সমীক্ষার দুর্বলতায় ৭৭ বাজারের নির্মাণ বাদ
-তিন বছরের কাজ ৬ বছরে ৪৭ শতাংশ অগ্রগতি

প্রকল্পের মাঝপথেই নির্মিত ভবনে, ফ্লোরে এবং টাইলসে ফাটল ধরেছে। বাজারের দোকানে নিম্নমানের শাটার লাগানো হয়েছে। এ দিকে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুর্বলতার কারণে সারা দেশে বিভিন্ন জটিলতায় ৭৭টি বাজার অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিন বছরে প্রকল্পের অধীনে ৫০৭টি বাজার অবকাঠামো তৈরির কথা ছিল। এখন তিন বছরের প্রকল্পের প্রায় ছয় বছর কাজ হয়েছে মাত্র ৪৭ শতাংশ। আর্থিক ব্যয় ৩২.৯৪ শতাংশ, যা আশানুরূপ নয়। জমি অধিগ্রহণে সময়ক্ষেপণ, ড্রইংয়ে বিলম্ব ইত্যাদি কারণে প্রকল্পের কাজ চলছে ঢিমেতালে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রকল্প দলিল থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ দ্রুত অগ্রসরমান একটি উন্নয়ণশীল দেশ, কিন্তু জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। গ্রামীণ হাটবাজার হলো গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। বর্তমানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের অভাবে গ্রামীণ হাট-বাজারের পূর্ণ সুবিধা গ্রামীণ কৃষক ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা (ব্যবসায়ী) পাচ্ছে না। বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় গ্রামের কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য সংরক্ষণ সুবিধার অভাবে স্বত্বভোগীদের নিকট স্বল্পমূল্যে উৎপাদন স্থলে বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। অন্য দিকে স্থায়ী অবকাঠামো না থাকায় গ্রামীণ বাজারে মালামালের সরবরাহ অপ্রতুল থাকায় ভোক্তাদের অধিক মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করতে হয়। গ্রামীণ বাজারের ভবনসহ চারতলা বুনিয়াদের ওপর দুই/একতলা ভবন, যার প্রতিটি তলা প্রায় ৪ হাজার থেকে ১০ হাজারবর্গ ফুট) অন্যান্য (অভ্যন্তরীণ সড়ক, পানি নিষ্কাশনের জন্য উন্মুক্ত ড্রেন, পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ) ভৌত সুবিধা প্রদান করা হলে কৃষি ও অকৃষি পণ্যের সহজ বাজার জাতের মাধ্যমে স্থানীয় কৃষকরা প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে উৎপাদিত পণ্য বিক্রয় করতে পারবেন। ভোক্তারাও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সহজে ন্যায্যমূল্যে ক্রয়ের সুবিধা পাবে। সৃষ্ট সুবিধাদির মিথষ্ক্রিয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধিসহ গ্রামীণ অর্থনীতির সঞ্চালন বৃদ্ধির জন্য প্রকল্প নেয়া হয়। প্রকল্পটির মাধ্যমে গ্রামীণ বাজার উন্নয়ন করে গ্রাম পর্যায়ে কৃষি ও অকৃষি পণ্যের সহজ বাজারজাতকরণের মাধ্যমে কৃষককে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সহজলভ্য করা। অধিকন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি করা যাবে। প্রকল্পের মেয়াদকাল হবে জুলাই ২০১৭ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য নেয়া হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। কিন্তু সেই প্রকল্পটি তিন বছরে তো নয়ই দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে এখন আট বছরে নেয়া হয়েছে। আর ৬ বছরে এর অগ্রগতি ৫০ শতাংশও হয়নি।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হলো, নির্মাণ ও পূর্তকাজ ৫০৭টি, ভূমি অধিগ্রহণ পরিমাণ ১ একর, ডাবল-কেবিন পিকআপ দুইটি, মোটরসাইকেল ১৫০টি, কম্পিউটার এবং মালামাল ৭৫টি (কম্পিউটার, প্রিন্টার, স্কেনার, ফ্যাক্স, ইউপিএস)। অফিস সরঞ্জামাদি লেভেল মেশিন (প্রতিটি উপজেলায় ১টি করে) ৪৯১টি। উপজেলা মেটেরিয়াল টেস্টিং ইকুইপমেন্ট (প্রতিটি উপজেলায় ৬টি সিরিন্ডার মোল্ড, ব্রাশসহ একটি সিভ সেট, দুই সেট কংক্রিট স্ল্যাব কোন, দুইটি ব্যালেন্স করে) ৪৯১টি, কংক্রিট কোর ড্রিল মেশিন (প্রতি জেলায় ১টি করে) ৬৪টি সংগ্রহ।

৫.৪ প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ
২০২২ সালে জুন পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগগ্রতি ৩৯৪০২.৭৯ লাখ টাকা বা ২৩.৩০% এবং বাস্তব অগ্রগতি ৪০%। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রকল্পের আরএডিপির বরাদ্দ রয়েছে ২০০০০.০০ লাখ টাকা এবং অর্থ ছাড় হয়েছে ১৭০০০.০০ লাখ টাকা, অর্থ ছাড়ের বিপরীতে মে-২০২৩ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৬৩১৪.৮৩৭ লাখ টাকা। অগ্রগতি বিবেচনায় প্রকল্পের অবশিষ্ট মেয়াদে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না মর্মে প্রতীয়মাণ হয়। প্রকল্পের এ পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জীভূত আর্থিক অগ্রগতি মে-২৩ পর্যন্ত ৫৫৭ কোটি ১৮ লাখ টাকা বা মোট প্রকল্প বরাদ্দের ৩২.৯৪ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। যাতে প্রায় ৬ বছরে বাস্তব অগ্রগতি ৪৭ শতাংশ মাত্র। যেখানে প্রকল্প সমাপ্ত হয়ে মানুষ সুফল পাবার কথা।
সরেজমিনর সরকারি তথ্য বলছে, বাজারের স্থানের জন্য অনুমতি, জমি অধিগ্রহণ ও নির্মাণ পরবর্তীতে হস্তান্তর-এই সব ক্ষেত্রেই জেলা প্রশাসনের সাথে এলজিইডির সমন্বয়ের অভাব লক্ষণীয়, যা প্রকল্পটির দীর্ঘসূত্রতার একটি কারণ বটে। সমন্বয়ের জন্য উভয় পক্ষকে একসাথে বসা প্রয়োজন। বেশ কিছু বাজার মূল জনবহুল পূর্বের স্থান অপেক্ষা বেশ দূরে কিছুটা ফাঁকা জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে। আবার মূল সড়কের সাথে সংযোগ সড়ক নাই। ড্রেনেজের সুব্যবস্থা নেই। বাস্তবানুগ স্থান নির্বাচন আর দূরের বাজারগুলোর জন্য রাস্তার সংযোগ আর ড্রেনেজের ব্যবস্থা করা উচিত। কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ পরিদর্শক সংস্থা। তারা বলছেন, বেশ কিছু স্থানে দৃশ্যমান নির্মাণ ত্রুটি পাওয়া গেছে। তা ছাড়া সাটারিংয়ের মান অনেক ক্ষেত্রেই খারাপ ছিল। সার্বিক তদারকি আরো বাড়ানো উচিত।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, শাহজালাল বাজার, সিলেট সদর, সিলেট। সরেজমিন পরিদর্শনে এই বাজার অবকাঠামোর প্লিন্থ লেভেলে বেশ কিছু ফাটল দেখা গেছে। যেগুলো নিট সিমেন্ট পেস্ট দ্বারা ভরাট করে ফিনিশিং দেয়া হয়েছে।
রামপুর বাজার, মেঘনা উপজেলা, কুমিল্লা। গ্রাউন্ড ফ্লোরে কিছু স্থানে যথাযথ কিউরিংয়ের অভাবে কিছু স্থানের কনক্রিটে সঙ্কোচনজনিত ফাটল পরিলক্ষিত হয়েছে। এগুলো নির্মাণকাজের ত্রুটি নির্দেশক।
ভোলা জেলা, চরফ্যাশন উপজেলা, উত্তর ইছা বাজারে অবস্থিত অবকাঠামোটি ২০২১ সালের ৫ জুলাই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিডি) মাধ্যমে সমাপ্তকৃত হাটের মার্কেট ভবনটি হস্তান্তর ও গ্রহণ করা হয়। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ভবনের নিচতলার মেঝেতে কিছু জায়গায় প্লাস্টার উঠে নিচের ব্রিক দেখা যাচ্ছে এবং দেয়ালের প্লাস্টার ফেটে গিয়েছে। বেসিং ও ওয়াশরুমগুলো দীর্ঘদিন ধরে অপরিষ্কার থাকায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে গিয়েছে।
ভোলা জেলা, লালমোহন উপজেলা, কর্তারহাট বাজারে অবস্থিত নির্মাণাধীন অবকাঠামোর সিঁড়ি ও দ্বিতীয়তলার ফ্লোর টাইলসগুলোর ৮৫ শতাংশের বেশি জায়গায় সঠিকভাবে টাইলস বসানো হয়েছে। অর্থাৎ ১৫% জায়গায় টাইলস ফিটিংস ভালো হয়নি। দ্বিতীয় তলার দোকানের শাটারিং কাজের গুণগতমান ও ফিটিংসগুলো মোটামুটি ভালো। ভবনের প্লাস্টারের ফিনিশিং মোটামুটি ভালো। ওয়াশরুমের দরজা ও টাইলসসহ অন্যান্য ফিটিংস নিম্নমানের ব্যবহার করতে দেখা যায়। ভোলা জেলা, তজুমদ্দিন উপজেলা, শম্ভুপুর নতুনহাটে অবস্থিত অবকাঠামোটির নির্মাণকাজ ২০২১ সালে সম্পূর্ণ হয়েছে। নির্মাণাধীন ভবনের জমির দলিল সংক্রান্ত সমস্যার কারণে এখন পর্যন্ত ভবনটি হস্তান্তর ও এলজিইডি কর্তৃক বুঝে নেয়া সম্ভব হয়নি। পরিদর্শন দেখা যায়, ভবনের মেঝেতে অপর্যাপ্ত রাবিশ পড়ে আছে এবং নিচতলার মেঝেতে কিছু জায়গায় প্লাস্টার ফেটে গিয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় দেয়ালের প্লাস্টার ফেটে যেতেও দেখা গিয়েছে। রঙের কালার নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে ভবনের স্ট্রাকচারগত কাজের গুণগতমান ভালো পরিলক্ষিত হয়েছে এবং ডিজাইন অনুযায়ী নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে।

বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় তালুছ বাজারের নিচতলায় নির্মাণকাজের ফিনিশিং ভালো হয়নি। নিচতলায় খোলা বাজারে বিভিন্ন স্থানে ক্রাক দেখা যায়। এলজিইডি কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটি নিবিড় পরিবীক্ষণ সমীক্ষা কার্যক্রমের সরেজমিন পরিদর্শনকালীন ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী প্রকল্প সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকৌশলী উপস্থিত ছিলেন।
আইএমইডির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে যেসব বাজারে মার্কেটগুলোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। তার একটি বড় অংশ জেলা প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় দেরি হচ্ছে। নীতিমালা প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত এক্ষেত্রে ‘এডহক’ ভিত্তিতে পূর্বের গাইডলাইন অনুসরণ করে বরাদ্দের মাধ্যমে মার্কেটগুলো চালু করা যেতে পারে।
আইএমইডির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এমএস ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড বলছে, এ ধরনের বড় প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে এলজিইডিকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং সম্ভাব্যতা যাচাই গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন ছিল। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে দুর্বলতার কারণে প্রকল্পের অধীনে ৫০৭টি বাজারের মধ্যে বিভিন্ন জটিলতায় ৭৭টি বাজার অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
৭৭টি বাজার ডিপিপি থেকে বাদ দিয়ে খরচ কমিয়ে নতুন আরডিপিপি প্রণয়ন করা উচিত। তারা বলেছেন, এখন পর্যন্ত ৬ বছরে অনেক বাজারে মার্কেট ভবন নির্মাণে জায়গা নির্বাচন করা এবং অস্থায়ী স্থাপনা বা প্রাচীন গাছ অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। সেগুলোর বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট দফতর/সংস্থাসহ জেলা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় জোরদার করতে হবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement