১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পাটকল বন্ধে কপাল পুড়ল কৃষকেরও

-

মহামারীকালে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধের আকস্মিক সিদ্ধান্তের ফলে পাটচাষিরাও পড়েছেন ক্ষতির মুখে। ‘হঠাৎ পাটকলগুলো বন্ধ করে দিয়ে আমাদের পেটে লাথি মারা কেন?’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এই প্রশ্ন করেছেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার কুমারগাড়া গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম। এবার ৮ বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু ভরা মৌসুমে একসঙ্গে এত পাটকল বন্ধ হওয়ায় ফসলের দাম পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তিনি। বিডিনিউজ।
সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, বর্তমানে দেশে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ। দেশের জিডিপিতে পাট খাতের অবদান ০.২৬ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপিতে তা ১.৪ শতাংশ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে সাড়ে সাত লাখ থেকে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়, এর থেকে কম-বেশি ৮০ লাখ বেল পাটের আঁশ উৎপন্ন হয়ে থাকে। দেশের সব জেলাতেই কম-বেশি পাটের চাষ হয়।
পাবনায় এবার ২০ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে; গতবার হয়েছিল ১৮ হাজার হেক্টরে। সাইফুল বলেন, ‘গতবার ২,১০০ টাকা মণ দরে পাট বিক্রি করেছিলাম। এখন শুনছি, এবার পাটের দাম পাওয়া যাবে না। সবচেয়ে বেশি পাটের চাষ হয় ফরিদপুর জেলায়, সেখানে এবার ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। গত মৌসুমে হয়েছিল ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে। পাটনির্ভর এই জেলায় ১৯টি পাটকল আছে; সবই বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে সচল রয়েছে, ১৩টি। দেশের অন্যতম বৃহৎ বেসরকারি খাতের জুট মিল করিম জুট মিল এই ফরিদপুরেই অবস্থিত। গত মৌসুমে দাম ভালো পাওয়ায় এবার কৃষক বেশি জমিতে পাটের চাষ করেছেন বলে জানান জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী। পাশের জেলা রাজবাড়ীতে এবার ৪৭ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক গোপাল কৃষ্ণ দাশ জানান, এই জেলায় পাট কাটা শুরু হয়েছে। তবে হাটবাজারে এখনো বিক্রি শুরু হয়নি।
কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামানের আশঙ্কা, মৌসুমের ঠিক আগে আকস্মিক পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো কৃষিতে। তিনি বলেন, এমন সময়ে সরকার পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলো, যখন কয়েক দিন পরই নতুন পাট বাজারে আসবে। এতে চাষি পাটের উৎপাদন খরচ পাবে না। দেশে এখন বেশ কিছু ব্যক্তিমালিকানার পাটকল আছে। তারা মিলের জন্য পাট খরিদ করবে, কিন্তু দাম দেবে না। ‘চাষিরা হাটবাজারে এসে পাটের দাম না পেয়ে আহাজারি করবেন। অনেক চাষি হয়তো রাগে পাটে আগুন লাগিয়ে দেবেন। এই হলো আসছে পাট মৌসুমের চিত্র।’
দেশে মোট ৩১৪টি পাটকলের মধ্যে ৬৩টি বন্ধ থাকার কথা গত বছর সংসদে জানিয়েছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। এখন একবারেই বন্ধ হলো রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি। এর মধ্যেও আরো কয়েকটি বন্ধের খবর পাওয়া যায়। গত কয়েক বছর ধানের দাম না থাকায় কৃষকরা ক্রমেই ঝুঁকছিলেন পাটের দিকে। কৃষি অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, এবার দাম না পেয়ে চাষিরা পাট চাষে আগ্রহ হারালে উৎপাদন কমে যাবে। তাতে সঙ্কটে পড়বে বেসরকারি পাটকলগুলোও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে উৎপাদিত পাটের আঁশের প্রায় ৫১ শতাংশ পাটকলগুলোয় ব্যবহৃত হয়, ৪৪ শতাংশের মতো কাঁচা পাট বিদেশে রফতানি হয় এবং মাত্র ৫ শতাংশের মতো লাগে ঘর-গৃহস্থালি আর কুটিরশিল্পের কাজে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৯০ এর দশকে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। মাঝে তা ৪.০-৪.৫ লাখ হেক্টরে নেমে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক আঁশের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধির কারণে ২০১০-১৫ সাল নাগাদ চাষের এলাকা বেড়ে ৭ লাখ হেক্টরে পৌঁছায়। এর পর থেকে তা আরো বাড়ছে। সরকারি হিসাবে পাটচাষির সংখ্যা ৪০ লাখ হলেও কৃষি তথ্য সার্ভিস বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ পাট চাষ এবং চাষ-পরবর্তী বিভিন্ন প্রক্রিয়া যেমন- প্রক্রিয়াজাতকরণ, আঁশ বাঁধাই, গুদামজাত, পরিবহন বা স্থানান্তর ও বিপণন ইত্যাদিতে জড়িত।
শ্রমিকদের সামনে অনিশ্চয়তা : রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ২৫ হাজারের মতো শ্রমিক কাজ হারালেও তাদের ওপর নির্ভরশীল কয়েক লাখ মানুষকে সরকারের সিদ্ধান্তে ভুগতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে পাটকল শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছে, নতুন ব্যবস্থাপনায় কলগুলো চালু হলে অভিজ্ঞ শ্রমিকরা আবার কাজ পাবেন। তবে তাতে ভরসা করতে পারছেন না শ্রমিকরা। শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের কারণে শ্রমিকরা এখন হয়তো কিছু টাকা পাবে। কিন্তু ভবিষ্যতে তাদের কী হবে? তাদের পরিবার-পরিজনের কী হবে?’
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল নিয়ে বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে হয় ৮২। এরশাদ সরকারের সময় ৩৫টি পাটকল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়। আটটি পাটকলের পুঁজি প্রত্যাহার করা হয়। ১৯৯০ সালের পর বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় ১১টি পাটকল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০২ সালের জুনে বন্ধ হয় দেশের বৃহত্তম আদমজী জুট মিল। শেষ পর্যন্ত বিজেএমসির আওতায় ২৬টি পাটকলের মধ্যে চালু ছিল ২৫টি। এর মধ্যে ২২টি পাটকল ও ৩টি নন-জুট কারখানা। সেগুলোই এখন বন্ধ হয়ে গেল।
স্বপ্নভঙ্গ : স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য ছিল পাট। তা থেকে রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশ আসায় পাটকে বলা হতো ‘সোনালি আঁশ’। তার পর দিন যত গড়িয়েছে, পাটের গৌরব তত ম্লান হয়েছে। কিন্তু প্রায় অর্ধ শতক পর করোনাভাইরাস সঙ্কটকালে যখন দেশের রফতানি আয় তলানিতে ঠেকেছে, তখন পাটে দেখা যাচ্ছিল আশা, সেই সময়েই পাটকলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত হলো।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছে। টাকার অঙ্কে তা প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি হয়েছে ৭ শতাংশ। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির মধ্যে পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) ৫৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ মোট রফতানির ৬৪ শতাংশই এসেছে পাটসুতা রফতানি থেকে। কাঁচা পাট রফতানি থেকে আয় হয়েছে ১৩ কোটি ডলার। এই অঙ্ক পাট খাতের মোট রফতানির ১৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছরে কাঁচা পাট রফতানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। আর লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেশি এসেছে ১৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রফতানি হয়েছে ১০ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ৮৩ শতাংশ। এ ছাড়া পাটের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি হয়েছে ১৯ কোটি ডলারের। আর এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দিন পর দেশের রফতানি বাণিজ্যে চামড়াকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এলো পাট।
বাংলাদেশ পাটপণ্য রফতানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল বলেন, এখন পৃথিবীতে পাট ও পাটপণ্য রফতানিতে কিন্তু সুসময় চলছে। কোভিড-১৯ মহামারী পরিবেশের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়ায় এ খাতের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে, বিশ্ববাজারে দামও বাড়ছে। এ সময়ে হঠাৎ করে সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে, এটা আমরা চিন্তাই করতে পারিনি। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমলেও পাটপণ্যের চাহিদা কমবে না। অস্ট্রেলিয়া থেকে এরই মধ্যে অর্ডার পেতে শুরু করেছি আমরা। আমার বিশ্বাস, পরিবেশের বিষয়টি আরো জোরালোভাবে সামনে আসবে।
সরকার দেশে পাটের ব্যবহার বাড়াতে ২০১০ সালেই আইন করেছে। সে আইন অনুযায়ী ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনিÑ এই ছয় পণ্য সংরক্ষণ, সরবরাহ ও মোড়কীকরণে পাটের বস্তা ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে সব ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আবদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা লক্ষ্য করছি, শুধু ধান, চাল ও গমে পাটের মোড়ক ব্যবহার হচ্ছে, সেটাও স্বল্প আকারে; রাজধানী ঢাকায়। জেলা-উপজেলায় কেউ মানছে না এই আইন। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে ইউরোপের অনেক বাজারে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সেই বাজার কিন্তু বিশাল; প্লাস্টিকের ব্যাগের বিকল্প হতে পারে পাটের ব্যাগ। ওই বাজার ধরতে আমাদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো লোকসানে থাকলেও বেসরকারিগুলো এরই মধ্যে লাভ দেখিয়েছে। বাংলাদেশের আকিজ জুট মিলস পাট সুতা উৎপাদনে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যশোরের নওয়াপাড়ায় মাত্র ৩০০ জন শ্রমিক ও ১০ টন উৎপাদন সক্ষমতা নিয়ে যাত্রা পাটকলটি এখন পাট সুতার বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় ২৫ শতাংশ সরবরাহ করছে। কাজ করছে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক। বিশ্ববাজারে পাট সুতার বার্ষিক চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। এ চাহিদার এক লাখ টনের বেশি সরবরাহ করছে আকিজ জুট মিলস। বিশ্বের প্রায় ৪০টির মতো দেশে রফতানি করছে তারা। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে আকিজ জুট মিলস প্রায় ১৫ কোটি ডলারের পাট পণ্য রফতানি করেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা জনতা সাদাত জুট মিলসের রফতানি ছিল সাড়ে তিন কোটি ডলারের কাছাকাছি। অন্য দিকে করিম জুট মিলসের রফতানি ছিল ৩ কোটি ডলারের মতো।
বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এবং করিম জুট স্পিনার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ মিয়া বলেন, বিশ্বব্যাপী পাট পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। শুধু এখন বস্তা, চট ও থলে নয়, পাট সুতাসহ পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য বাংলাদেশ থেকে রফতানি হচ্ছে। আমরা করিম জুট মিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাটের তৈরি একটি পণ্য রফতানি করি, যা দিয়ে বিএমডব্লিউ গাড়ির ড্যাশবোর্ড ও সিট তৈরি হয়। এ ছাড়া এয়ারক্র্যাফটের কার্পেট তৈরিতেও আমাদের এই পাট পণ্যটি ব্যবহার হয়। করিম জুট মিল গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩৫০ কোটি টাকার পাট পণ্য রফতানি করেছে।
‘রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ করে দিয়ে ভারতের উপকার করলাম কি না’Ñ সরকারের নীতিনির্ধারকদের তা ভাবার অনুরোধ জানান মাওনা জুট মিলের কর্ণধার সাজ্জাদ সোহেল। ‘এখন কী হবে? আকিজ, জনতা ও করিম জুট মিলের মতো বড় বড় পাটকলগুলো সরাসরি পাট সুতা রফতানি করবে। আর আমাদের মতো ছোট ছোট কলগুলোকে ভারতের বড় বড় রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাব-কন্ট্রাকে কাজ করতে হবে।’
‘শ্বেতহস্তী’ বিজেএমসি : পাটকলগুলোতে ক্রমাগত লোকসানের জন্য পাটমন্ত্রী থেকে শুরু করে শ্রমিকরাও বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অদক্ষতাকে দায়ী করলেও সে দিকে সরকারের কোনো নজর দেখা যায়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বন্ধ দুই পাটকল চালু এবং বেসরকারি মালিকানায় দেয়া তিন পাটকল ফিরিয়ে এনে আবার চালু করে। এ জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়। এর পরের ১০ বছরে সরকারি পাটকল লোকসান দিয়েছে ৪ হাজার ৮৫ কোটি টাকা। অথচ বেসরকারি পাটকল লাভের মুখ দেখছে। সব মিলিয়ে সরকারি পাট খাতের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ এখন প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
ব্যবসার কোনো রকম অভিজ্ঞতা না থাকা আমলাদের দিয়ে বিজেএমসি পরিচালনা করছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। করপোরেশনের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন চেয়ারম্যানসহ সাতজন। তাদের প্রত্যেকেই সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মচারী। পাটকলের ব্যবসা পুরোপুরি বোঝার আগেই বদলির ঘটনাও ঘটেছে। গত তিন বছরে দায়িত্বে ছিলেন তিনজন চেয়ারম্যান।
পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় বলেছে, বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোর শ্রমিকদের মাসিক মূল মজুরি ২ হাজার ৭০০ টাকা। তবে ২০১৫ সালে সরকারি পাটকলগুলোতে মজুরি ৮ হাজার ৩০০ টাকায় উন্নীত হয়েছে, যা বেসরকারি পাটকলের প্রায় তিন গুণ। এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন ডেমরায় রাষ্ট্রায়ত্ত লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের। তিনি বলেন, সরকারি পাটকলের যন্ত্রপাতি ৬০-৭০ বছরের পুরনো। ফলে পাটকলের উৎপাদনক্ষমতা ৪০-৪৫ শতাংশে নেমে যায়। সে কারণে এক টন পণ্য উৎপাদনে বেসরকারি মিলে যেখানে ২৫-২৮ জন শ্রমিক লাগে, সেখানে সরকারি মিলে প্রয়োজন হতো ৬৫-৭০ জন। তা ছাড়া পাটের মৌসুমে সুলভ মূল্যে কাঁচাপাট না কিনে পরবর্তী সময়ে বেশি দামে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনাটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। তাতে ১ হাজার ২০০ টাকা মণের পাট অনেক সময় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকায় কেনা হতো। এর পেছনেও বিজেএমসির সঙ্গে পাটের দালালদের যোগসাজশ ছিল বলে অভিযোগ শ্রমিক নেতাদের।
পাট শিল্প বিকাশে করণীয় নির্ধারণে ২০০৯ সালের ২৪ মে সরকার জাতীয় পাট কমিশন গঠন করেছিল। ওই কমিশন বিজেএমসিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করাসহ অনেকগুলো সুপারিশ করেছিল। কমিটির প্রধান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘পাটখাত পুনর্গঠন করতে আমরা যে সুপারিশ দিয়েছিলাম, তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। পাটখাতের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে, দক্ষ লোকবলের কারণে আজকে সরকারি পাটখাতের এই অবস্থা।’
উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘অব্যবস্থাপনায় ডুবেছে সরকারি পাটকলগুলো। সরকারের উচিত ছিল সার্বিক বিষয় নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। তা হলে দেশের মানুষ বুঝতে পারত, পাট নিয়ে আসলে কী হয়েছে এত দিন? বেসরকারি পাটকলগুলো ভালো করলে সরকারিগুলো কেন করতে পারেনি?’
তা হলে প্রশ্ন জাগে পাট মন্ত্রণালয়-বিজেএমসি কী করেছে। তাদের ব্যর্থতার দায় কে নেবে? অবশ্যই শ্রমিকরা নয়। সরকারকে নিতে হবে; পাট মন্ত্রণালয় বা বিজিএমসিকে নিতে হবে।
আকস্মিক সিদ্ধান্ত : মহামারীকালে যখন রফতানিতে আশা দেখাচ্ছে পাট, তখন আকস্মিক রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্ত কেন হলো, তার কারণ খুঁজতে হয়রান সংশ্লিষ্টরা। বিএনপি আমলে দেশের বৃহত্তম আদমজী পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনামুখর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই পাটশিল্প নিয়ে তার আবেগের কথা বলে আসছেন। লোকসানে থাকা পাটকলগুলোর জন্য অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি নানা পদক্ষেপও নিচ্ছিল সরকার। তা হলে কেন এই সঙ্কটকালীন সময়ে সরকার হাজার হাজার শ্রমিককে বেকার করার পাশাপাশি কৃষকদের সঙ্কটে ফেলার কঠিন এ সিদ্ধান্ত তিনি নিলেন; তা বুঝে উঠতে পারছেন না কৃষি অর্থনীতিবিদ, পাটচাষি, ব্যবসায়ী, রফতানিকারক, শ্রমিক কেউই। বাম দলগুলো বলছে, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে যেমন আদমজী পাটকল বন্ধ করেছিল বিএনপি-জামায়ত জোট সরকার, তার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল এবার বন্ধ করল আওয়ামী লীগ সরকার। তবে এবারের সিদ্ধান্ত তেমন নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ পাটপণ্য রফতানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান এম সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল। হঠাৎ পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়ায় অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অনেকে বলছেন, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের পরামর্শে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে কিন্তু তেমনটি মনে হয়নি। মনে হচ্ছে, দেশের ভেতরেরই একটি গোষ্ঠী সরকারকে বিভ্রান্ত করে এই কঠিন সময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। পাটকল শ্রমিকদের নেতা বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সভাপতি সহিদুল্লাহ চৌধুরী এর পেছনে ‘গভীর ষড়যন্ত্র’ দেখার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পাট শিল্প নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পিপিপির নাম করে কয়েকজন ব্যক্তির হাতে পানির দরে পাটকলগুলোকে তুলে দিতেই এগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এই বুদ্ধি কে বা কারা সরকারকে দিলো, বুঝে পাচ্ছি না। তবে অনুমান করা যাচ্ছে, পিপিপির নামে হাতেগোনা কয়েকজন বিত্তবানের হাতে নামমাত্র মূল্যে এসব তুলে দিতে চাইছে।’ ‘আমি কিছু বলব না, তবে যে কেউ যদি প্রশ্ন করে কম দামে পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের কাঁচাপাট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের হাতে তুলে দিতেই কি এভাবে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো?’ বলেন তিনি।


আরো সংবাদ



premium cement
ইরানে হামলা : ইস্ফাহান কেন টার্গেট? মাত্র ২ বলে শেষ পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড প্রথম টি-টোয়েন্টি জেলে কেজরিওয়ালকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ দলের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা তোকে যদি এরপর হলে দেখি তাহলে খবর আছে, হুমকি ছাত্রলীগ নেতার বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত

সকল