১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলকদ ১৪৪৫
`


সুবিধাবঞ্চিত নাজিরার টেকের শুঁটকি পল্লীর ৩ হাজার শিশু

-

স্বাস্থ্য ও শিা সুবিধাবঞ্চিত কক্সবাজারের নাজিরারটেক শুঁটকি পল্লীর প্রায় তিন হাজার শিশু। যারা অভাবের সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা নিয়ে আসতে নেমে পড়েছেন শুঁটকি প্রক্রিয়া করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে। এই শিশুদের পড়ার টেবিলে থাকার কথা থাকলেও বাবা-মায়ের সাথে আসতে আসতে একসময় হয়ে উঠছে দ শ্রমিক। আবার কেউ জীবনের প্রয়োজনে জীবিকার তাগিদে কাজ করছেন এখানে। অল্প টাকায় বেশি কাজ করানো যায় বলে শিশু শ্রমিকদেরই পছন্দ মালিকদের।
সরেজমিন দেখা যায়, মা রওশনের সাথে কাজ করছেন শিশু কায়সার। কায়সার জানান, এখন তার ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার কথা ছিল। পঞ্চম শ্রেণী পাস করার পর সম্প্রতি তার বাবা মারা যায়। এর পর বাধ্য হয়ে মায়ের সাথে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। তাই পড়ালেখা করে বড় হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কাজের সময় তার হাতের দিকে খেয়াল করে দেখা যায় তালুতে মাছের কাটা বিদ্ধ হয়ে রক্ত পড়ছে। বিভিন্ন সময় এভাবে কাঁটাবিদ্ধ কচি হাতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
কায়সার বলেন, মাছের কাটার আঘাতে ব্যথা হয়। রাতে ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়। অনেক সময় ডাক্তারের কাছে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসি। অনেক সময় ওষুধ কেনার টাকা পাই না। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সারা দিন এভাবে কাজ করলে মালিক ৩০০ টাকা দেয়। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে মাকে সহযোগিতা করি।
একটু সামনে গিয়ে দেখা মেলে শিশু শ্রমিক আয়াতুল্লার। বয়স জানতে চাইলে বলে, ১১ বছর। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে আর এগুতে পারেনি। এখন আয়াতুল্লার বন্ধুরা পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। পড়ালেখার প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকলেও সেটি সম্ভব হচ্ছে না। সংসারের ভার বহন করতে এই শুঁটকি পল্লীতে কাজ করতে এসেছে।
মাছগুলো চাটাইয়ের ওপর বিছিয়ে রোদে শুকানোর ব্যস্ততায় কথা বলার কিংবা শোনার সময় পাচ্ছে শিশু সিদ্দিক। শুঁটকি পল্লীতে কাজ করে বাবার সংসারে সহযোগিতা করছে। স্কুলে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব হচ্ছে না।
দুপুরের প্রচণ্ড তাপে একটি খলাতে কাজ করছিলেন শিশু সোহাগ ও সায়মন। এর মধ্যে সোহাগের বাবা আবুল কালাম অসুস্থ। এ জন্য দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে আর সামনের দিকে এগুতে পারেনি। পিতার অসুস্থতায় সংসারের আয়ের হাতিয়ার হয়ে কাজ করতে হচ্ছে তার।
অন্য দিকে সায়মন পিতৃহারা। মায়ের স্বল্প আয়ে সংসার চলে না। ফলে তাকেও নামতে হয় কাজের খোঁজে। গত তিন বছর থেকে পড়ালেখা বাদ দিয়ে খলায় কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
নাজিরার টেকের খোলার মালিক মেহেদী হাসান বলেন, আমরা কোনো শিশুকে জোর করে আনি না। পরিবারে আর্থিক অসচ্ছলতা থাকায় তারা এখানে আসে কাজের সন্ধানে। কাজ করে অর্থ নেয়। শিশুরা না এলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, আমরা অন্য লোক দিয়ে কাজ করাবো।
নাজিরার টেকের শুঁটকি পল্লীর শিশু শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উইনরক। তাদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে এখানে ৫৬১টি খলা রয়েছে। সেখানে কাজ করছে ১৪ হাজার ৩৩৬ জন শ্রমিক। এর মধ্যে শিশু শ্রমিক রয়েছে দুই হাজার ৮৭৬ জন। প্রতিটি খলায় ২৬ জন শ্রমিক কাজ করছে। প্রতিটি খলায় গড়ে শিশু শ্রমিক রয়েছে পাঁচজন করে, যা মোট শ্রমিকের গড় হিসেবে ২০ শতাংশ।
এর আগের ২০১০ সালের বিবিএসের গবেষণায় দেখা যায়, ২০১০ সালে এই শুঁটকি পল্লীতে খলা ছিল ৮৭২টি। সেখানে কর্মরত ছিল ২৩ হাজার ৪০ জন শ্রমিক। এর মধ্যে শিশু শ্রমিক ছিল তিন হাজার ৯৪ জন। প্রতিটি খলায় ২৬ জন শ্রমিক নিয়োজিত ছিল। গড়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ছিল চারজন। যা মোট শ্রমিকের গড় হিসাবে ১৩ শতাংশ।
স্থানীয় অনেকের অভিযোগ, এখানে কয়েক হাজার বসতী থাকলেও কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বার বার আবেদন জানালেও কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এসব এলাকায় শিশুদের জন্য স্কুল স্থাপন জরুরি। এতে যেসব শিশু শিা থেকে ঝরে পড়ছে, তাদের শিার অধিকার সুনিশ্চিত হবে। শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান তারা।
জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আল আমিন পারভেজ নয়া দিগন্তকে বলেন, সেখানে কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আমরা সেগুলোকে দেখভাল করছি। স্থানীরা যদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আবেদন করে তাহলে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবো।


আরো সংবাদ



premium cement