৪৬ বছরেও লেজেগোবরে অবস্থা
কেমন চলছে পর্যটন শিল্প-১- আবুল কালাম
- ২৭ নভেম্বর ২০১৮, ০০:০০
প্রায় চার যুগেও বদলায়নি সম্ভাবনার পর্যটন শিল্পের অবস্থা। নানান জটিলতায় ৪৬ বছরেও এ খাতে এখনো বলতে গেলে লেজেগোবরে অবস্থা। ’৭২ সাল থেকে প্রথম এর কার্যক্রম শুরু হলেও নানা চেষ্টায় আজো তার বাণিজ্যিক সাফল্য আসেনি। আমলাতন্ত্রের পাশাপাশি পর্যটন কাঠামো, পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা, অর্থায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন, সেবার মান নিয়ন্ত্রণ, পণ্য চিহ্নিতকরণ ও উন্নয়ন, সঠিক পরিসংখ্যান, গবেষণা, আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এসব প্রতিকূলতায় তার উন্নয়ন আটকে আছে। এসব কারণে অগ্রগতি নিয়ে খোদ সংশ্লিষ্টরাও হতাশ। তারা বলছেন এ রকম চলতে থাকলে এ খাতকে কোনো দিনও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
খোঁজ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পর্যটন খাতের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া নেই কোনো আইন। নীতিমালা থাকলেও তারও কার্যকারিতা নেই বলেও তারা জানালেন। ফলে প্রতি বছর কোন দেশ থেকে কতজন পর্যটক আসছে, তারা কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে, কোন গন্তব্যে যাচ্ছেন এমন কোনো তথ্যই তারা দিতে পারেননি। এসব কারণে পর্যটন খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন।
জানা যায়, পর্যটনের উন্নয়নে ’৭২ সালে প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়। এর পর ’৭৩ সাল থেকে তার কাঠামোসহ এ খাতের উন্নয়নে ধাপে ধাপে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে গঠিত হয়েছে টুরিজম বোর্ড। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বছরের পর বছর এসব কর্তা সব সুবিধা ভোগ করলেও কাজের ক্ষেত্রে কোনো সফলতা দেখাতে পারেননি। ফলে দেশের প্রধান আয়ের উৎস সম্ভাবনার এ খাত এখনো লাভজনক অবস্থানে আসতে পারেনি।
এ বিষয়ে গত কয়েক দিনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে ঘোরেও এ সংক্রান্ত কোনো অগ্রগতি প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। এমনকি এ নিয়ে সংশ্লিষ্টরা একটি পরিসংখ্যান পর্যন্ত দিতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউএনডাব্লিউটিও তাদের সদস্য দেশগুলোর পর্যটন পরিসংখ্যান নিয়ে যে প্রকাশনা বের করে তাতে বাংলাদেশ গত বছরের কোনো পরিসংখ্যান এমনকি কোনো পরিকল্পনাও দিতে পারেনি।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডাব্লিউটিটিসি) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ে ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের প্রত্যক্ষ অবদান ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২.২ শতাংশ। এর আগে ২০১৫ সালে ছিল জিডিপির ২.৪ শতাংশ। সেই হিসাবে জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান কমেছে। তবে এ নিয়ে চলতি বছরের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে খোদ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও হতাশ। তাদের অভিযোগ, বাংলাদেশের পর্যটন খাতে বিদেশী বিনিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে আইন কিংবা কোনো দিকনির্দেশনা নেই। ফলে এর কার্যক্রমে তারা কোনো গতি পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা নিজেদের ব্যর্থতা স্বীকার করে বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭২ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন অর্ডিন্যান্স আইন পাস করা হয়। ’৭৩ সালে শুরু হয় পর্যটন কার্যক্রম। ’৯৬ সালে সরকার পর্যটন সেক্টরকে অগ্রাধিকার সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করে। এরপর ২০০৭ সালে তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকার পর্যটন আইন করতে তিন সদস্যের কমিটি করে। তখন তার খসড়া করা হলেও আজো তা আইনে পরিণত হয়নি। এসব ঘটনায় প্রমাণ হয় আমরা কখনই পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব উপলব্ধির চেষ্টা করিনি। ফলে সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও এ খাতে পিছিয়ে রয়েছে।
অন্য এক কর্মকর্তা নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, পর্যটনের উন্নয়নের দায়িত্ব বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের। ২০১০ সালে ট্যুরিজম বোর্ড এ দায়িত্ব পায়। কিন্তু আজো তারা এর উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ দূরের কথা, তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না। বছরে শুধু একটি মেলা ছাড়া আর কোনো কার্যক্রমে তাদের দেখা যায় না। ফলে এর উন্নয়ন চলমান প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ট্যুরিজম বোর্ড গঠন হওয়ার আগে পর্যটন সংশ্লিষ্ট সব দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের। পরবর্তীতে বোর্ড গঠনের পর পরিসংখ্যান তৈরির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড। কিন্তু বাস্তবতা হলো- ২০০৯ সালের পর থেকে দেশী-বিদেশী পর্যটকের কোনো পরিসংখ্যানও তাদের কাছে নেই।
এসব অভিযোগ স্বীকার করে ট্যুরিজম বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘কাজের পরিসংখ্যান আসলেই খুবই জরুরি। এ নিয়ে আমরা চ্যালেঞ্জে আছি’। তার অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের অসহযোগিতার কারণে তারা তা করতে পারছেন না। এরপর বিগত বছরের কার্যক্রমের পরিসংখ্যান চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনার আসতে হবে না। কাল ফোন দিন সব জানিয়ে দেবো’। পরদিন একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
পর্যটন শিল্প নিয়ে ৪২ বছর ধরে কাজ করা ট্যুরিজম বোর্ডের বর্তমান সদস্য ও ট্যুরিজম ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টিডাব) সাবেক চেয়ারম্যান মো: জামিউল আহমেদ বলেন, ‘আমাদের পর্যটন চলছে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই। এতে না আছে ব্যবস্থাপনা, না আছে কোনো শৃঙ্খলা। যে যার মতো করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে এসে তা চাপিয়ে দিচ্ছে। ফলে এই শিল্পের জন্য পরিকল্পনামাফিক উন্নয়ন কাজের কোনো সুযোগ নেই।’
তার মতে এই খাত থেকে সরকারের বিপুল অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা থাকলেও বারবার তা ব্যর্থ হচ্ছে। তিনি কর্মকর্তাদের অদক্ষতাকে দায়ী করে বলেন। দক্ষ কর্মকর্তার অভাবেই সম্ভাবনার পর্যটন গতিপথ হারিয়েছে। তিনি জানান, ট্যুরিজম নিয়ে বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত নিশ্চিত কোনো ডাটাও নেই। যা আছে তার সবই অনুমান নির্ভর।
একাধিক সমস্যা চিহ্নিত করে তিনি বলেন, পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে দরকার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, পর্যটকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পর্যটন এলাকায় পর্যাপ্ত ট্যুরিস্ট পুলিশের ব্যবস্থা করা, বিমানবন্দর ও নৌবন্দরের সংস্কার ও উন্নয়ন, পর্যটনকে ব্র্যান্ডিং করা, পর্যটন স্পটে পর্যটকদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা ও পর্যটন মেলার আয়োজন করা, বিদেশী পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত গাইড গড়ে তোলা, বিদেশে বাংলাদেশের ট্যুরিজম প্রমোশনে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ, ওয়েবসাইটে প্রচারণা বা ক্যাম্পেইন ও পর্যটনবিষয়ক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ, ট্যুরিস্ট জেনারেটিং দেশগুলোয় (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া) পর্যটন অফিস স্থাপন করা। কিন্তু আমাদের কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে যুগের পর যুগ অতিবাহিত হলেও আমরা আজো তার সুফল থেকে বঞ্চিত রয়েছি।
এদিকে খোঁজ নিয়ে পর্যটন স্পটগুলোরও দুরবস্থার চিত্র পাওয়া গেছে। জানা গেছে, দেশে দিনে দিনে অভ্যন্তরীণ পর্যটন বৃদ্ধি পেলেও পর্যটকদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না। দেশের অনেক পর্যটন কেন্দ্রেই এখনো পর্যাপ্ত অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা নেই। আবার কিছু জায়গায় অবকাঠামো তৈরি হলেও তাতে পরিকল্পনার কোনো প্রকাশ নেই। অপরিকল্পিতভাবে অবকাঠামো গড়ে ওঠায় পর্যটন নগরী কক্সবাজারের অবস্থা এখন যাচ্ছেতাই। অতিরিক্ত পর্যটকের চাপে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক শোভাও মাধুর্য হারিয়ে ফেলেছে। প্রায় একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে সুন্দরবন, সিলেটের রাতারগুল, জাফলং, তামাবিল, বিছানাকান্দির মতো দর্শনীয় পর্যটন স্পটগুলোতে। সিলেট ও কক্সবাজারের পর্যটন স্থানগুলোতে যাতায়াতের অবস্থা শোচনীয়। সরকার পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অনেক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তার বাস্তবায়ন এখনো দৃশ্যমান হয়নি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা