২০ মে ২০২৪, ০৬ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫
`


ভারতে শিশুর যত্ন নেয়ার পদ্ধতি বাদলাতে যে পদক্ষেপ ইউনিসেফের

- ছবি : সংগৃহীত

ধর্মীয় বার্তার মাধ্যমে শিশুদের যত্ন নেয়ার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রচার করতে শুরু করেছে জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ইউনিসেফ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তারা সেই কাজ আরম্ভও করে দিয়েছে।

একটি শিশুর জন্ম, তার মায়ের স্বাস্থ্য, শিশুটির পুষ্টি, তার সুরক্ষাসহ শিশুদের যত্ন নেয়ার পদ্ধতি সম্বন্ধে লেখা একটি পুস্তিকাতে যেমন কোরআন-হাদিস, বেদ উপনিষদ, বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তেমনই সেগুলো ধর্মগুরুদের দিয়ে পরীক্ষাও করিয়ে নেয়া হয়েছে।

পালস-পোলিও টিকাকরণ এবং করোনার সময়ে কড়া নিয়ম-কানুন মানতে বাধ্য করার জন্য যেভাবে ধর্মগুরুদের দিয়ে বার্তা প্রচার করানো হয়েছিল, শিশুদের যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সেই একই পদ্ধতি নিয়েছে ইউনিসেফ।

ভবিষ্যতে তাদের এই পদ্ধতি সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোতেও ইউনিসেফ ব্যবহার করবে বলে জানানো হয়েছে।

কী রয়েছে পুস্তিকাগুলোতে?
‘ফেইথ ফর লাইফ’ পুস্তিকাটি ছয়টি ধর্মের জন্য আলাদাভাবে প্রকাশ করেছে ইউনিসেফের পশ্চিমবঙ্গ শাখা।

হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, জৈন এবং শিখ-প্রধানত যে ছয়টি ধর্মের মানুষ পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন, তাদের জন্যই আলাদাভাবে বইগুলো লেখা হয়েছে।

বইগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছে এবং বিষয়বস্তুও এক। তবে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য সেই ধর্মের ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে।

ইউনিসেফ বলছে, বইগুলোর পাঁচটি অধ্যায়ে যেসব বৈজ্ঞানিক তথ্য দেয়া হয়েছে, সেগুলো সবই আন্তর্জাতিকভাবেই ইউনিসেফ প্রচার করে থাকে।

মা ও সদ্যজাতর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিচ্ছন্নতা, শিশু সুরক্ষা ও বাল্যবিবাহ রোধ ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে বইটিতে।

বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলোর সাথেই প্রচলিত ভুল ধারণগুলোও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিটি বিষয়ে।

যেমন গর্ভবতী মায়ের বমি বা পা ফুলে যাওয়া অথবা রক্তস্বল্পতার কারণে দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা গেলে চিকিৎসা না করিয়ে ‘শয়তানের দৃষ্টি’ বলে চালিয়ে দেয়ার মতো ধারণা রয়েছে সমাজের একটা অংশের মধ্যে।

আবার সন্তানের জন্ম দেয়ার সময়ে মা এবং সদ্যোজাতকে একটি অন্ধকার, অপরিষ্কার ঘরে রাখার ব্যবস্থা অথবা হাসপাতালে পুরুষ ডাক্তার চিকিৎসা করবেন, এই ভয়ে বাড়িতে সন্তানের জন্ম দেয়ার ব্যবস্থা করার মতো প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।

আবার মাসিকের সময়ে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে যে অংশটি লেখা হয়েছে, সেখানেও প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো তুলে ধরেছে ইউনিসেফ।

যেমন, অনেকে এখনো মনে করেন যে নারীদের মাসিক হওয়াটা অপবিত্র ঘটনা। ওই সময়ে নারীদের আলাদা রাখার চল অথবা রান্না করতে না দেয়ার মতো অবৈজ্ঞানিক ধারণার উল্লেখ করা হয়েছে বইটিতে।

ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি
প্রতিটা অধ্যায়ে যেমন ভুল এবং অবৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো লেখা রয়েছে, পাশাপাশি বৈজ্ঞানিক নিয়মগুলোও লেখা হয়েছে। আর প্রতিটি পর্যায়ে ওই বিষয়টি নিয়ে ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে।

যেমন মাসিকের বিষয়ে ভুল ধারণা, বৈজ্ঞানিক নিয়মের সাথেই মুসলমানদের মধ্যে প্রচারের জন্য যে বইটি ছাপা হয়েছে, সেখানে হাদিস গ্রন্থ ‘সহীহ মুসলিম’ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে।

লেখা হয়েছে যে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) একটি মসজিদে ছিলেন, যখন তিনি আয়েশাকে একটি কাপড় দিতে বলেন।

‘সহীহ মুসলিম’ থেকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছে, ‘তিনি (আয়েশা) জবাব দেন যে তিনি রজস্বলা (মাসিক)। তিনি [মহনবী (সা:)] মন্তব্য করেন: তোমার মাসিক তোমার হাতে নেই এবং তিনি [আয়েশা (রা:)] সেটি (ওই কাপড়টি) এনে দেন।‘

আবার বাল্যবিবাহ রোধের নীতিগুলো নিয়ে যেখানে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানেও সমাজের একটা অংশে প্রচলিত ধারণাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

সমাজের একটা অংশ যে মেয়ে শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়ার আগেই বিয়ে দিয়ে দেন বা মেয়ে শিশুর তুলনায় ছেলে শিশুকে অতিরিক্ত নজর এবং যত্ন নেয়া হয়ে থাকে অনেক পরিবারে, সেই বিষয়ে হিতোপদেশ থেকে লেখা হয়েছে, ‘একটি শিশুকে তার বাবা এবং মা শিক্ষা দিলে তবেই সে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠবে। ছেলে হয়ে জন্ম নিলেই জ্ঞানী হয়ে ওঠে না।’

কেন বৈজ্ঞানিক ধারণার সাথে ধর্মযোগ?
ইউনিসেফ বলছে তারা সারা বিশ্বেই ধর্মগুরুদের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করে থাকে।

ইউনিসেফের পশ্চিমবঙ্গ শাখার গণসংযোগ বিশেষজ্ঞ সুচরিতা বর্ধন বলেন, ‘কোভিড চলাকালীন লোকজন দূরত্ব বজায় রাখা বা মাস্ক পরার মতো সরকারি নিয়ম-নীতিগুলো মানতে চাইছিলেন না। তখন ধর্মগুরুরাই একযোগে সেই সব নিয়ম মেনে চলার কথা বলেন, তখন দেখা যায় মানুষজন সহজেই সেগুলো মেনে নেন।’

‘এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমাদের মনে হয় শুধু কোভিড নয়, শিশু-বিকাশের যে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যাবলী রয়েছে, সেগুলোও যদি আমরা ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে তুলে ধরতে পারি!’

মিজ বর্ধন আরো বলেন, ‘আবার সেগুলো তুলে ধরে ধর্মগুরুদের কাছে আমরা বলতে পারব যে মন্দির-মসজিদ বা চার্চে যখন আপনারা ধর্মীয় বাণী দিচ্ছেন, তার মধ্যেই যেন এগুলোও চলে আসে।’

আবার ধর্মগুরুরাও যাতে সঠিক তথ্য দিতে পারেন তাদের অনুসারীদের কাছে, তার জন্য ইউনিসেফের বিশেষজ্ঞরা তথ্যগুলো বেছে দিয়েছেন। এই প্রকল্পটিতে ইউনিসেফের সাথে কাজ করেছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আমানত ফাউন্ডেশন’।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর আগে ২০০৩ সালের প্রথম তিন মাসে পশ্চিমবঙ্গে একসাথে ২৭ জন পোলিও রোগী পাওয়া গিয়েছিল। এদিকে টিকাকরণের ব্যাপারে মুসলমান সমাজে একটা প্রতিরোধ ছিল। মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছিল যে এই টিকা নিলে নারী-পুরুষ-শিশুরা প্রজনন ক্ষমতা হারাবে ইত্যাদি।’

আলম জানাচ্ছিলেন ‘ইউনিসেফ খুবই উদ্বিগ্ন ছিল ব্যাপারটা নিয়ে। তখনই আমাদের সাথে তাদের চুক্তি হয়। আমরা বিভিন্ন ইমাম ও হুজুরদের বক্তব্য দিয়ে একটি সিডি বার করি। সেটা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেয়া হয়। টিকাকরণ এতই ভাল হয়েছিল যে ওই বছরের বাকি সময়টাতে মাত্র একজন পোলিও রোগী চিহ্নিত হয়।’

তিনি আরো বলেন, এরপর থেকেই নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ধর্মগুরুদের প্রচারের কাজে যুক্ত করা হয়েছে।

আলম আরো বলেন, মূলত আমাদের সমাজে অনেকে ধর্মগুরুদের এবং ধর্মীয় বাণীগুলোকেই সব থেকে বেশি বিশ্বাস করেন। সেজন্যই কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা বা তথ্যও তাদের মাধ্যমেই বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা সহজ হয়।’

শিশুদের যত্ন নেয়ার প্রকল্পটি নিয়ে প্রায় দু’বছর কাজ চলেছে। প্রথমে ইউনিসেফের নিয়মনীতিগুলো নিয়ে ধর্মগুরুদের সাথে আলোচনা হয়েছে। তারপরে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় গ্রন্থে ওই বিষয়ে কী কী লেখা আছে, তা খুঁজে বের করা হয়েছে।

এরপরে আবার তাদের (ধর্মগুরু) কাছে বইগুলো দিয়ে, সেগুলোতে স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি নিয়ে সম্প্রতি সার্কভুক্ত দেশগুলোর ইউনিসেফ কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে আলোচনা হয়।

ভারতের অন্যান্য প্রদেশ, নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং মালদ্বীপেও ইউনিসেফ কর্তারা পশ্চিমবঙ্গ শাখার বইগুলো প্রচারের জন্য ব্যবহার করবেন বলে ইউনিসেফ জানাচ্ছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement