এমপি আজিমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ২২ মে ২০২৪, ১৬:২৯, আপডেট: ২২ মে ২০২৪, ১৮:৩৮
এক সপ্তাহ আগে নিখোঁজ হওয়া বাংলাদেশের ঝিনাইদহের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বুধবার দুপুরে ধানমণ্ডিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন,‘পরিকল্পিতভাবেই এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। তিনজনকে বাংলাদেশ পুলিশ আটক করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
‘তদন্ত চলছে, যারা যারা এ খুনের সাথে জড়িত সবার বিষয়ে জানতে পারবো। ভারতের পুলিশও সহযোগিতা করছে। আমাদের পুলিশ অত্যন্ত দক্ষ। তদন্ত শেষ হলে এ খুনের মোটিভ কী, সবকিছু বিস্তারিত দিতে পারবো আমরা।’
এর আগে কলকাতা বিধান নগর পুলিশের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার মানব শ্রিংলা বলেন,‘জিজ্ঞাসাবাদে ক্যাবচালক জানিয়েছে ১৩ মে যে ব্যক্তিকে সে গাড়িতে তুলেছিল তাকে এই অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে নামিয়ে দেয়।’
এমপি আজিম নিখোঁজের ঘটনায় কলকাতা সংলগ্ন সিঁথি পুলিশ স্টেশনে একটি জিডি করা হয়। সেখানকার এক শীর্ষ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, সঞ্জিভা গার্ডেনের ওই ফ্ল্যাটের ভেতরেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
তিনি জানিয়েছেন, সেখানে রক্তের দাগ ও অন্যান্য প্রমাণ রয়েছে। ১৩ই মে ওই এমপির সাথে তিনজন সেখানে ঢুকেছে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, তারা একেকজন পৃথক পৃথকভাবে ওই ফ্ল্যাট থেকে বের হয়েছে। ১৫ মে একজন, ১৬ মে আরেকজন এবং ১৭ মে আরেকজন বের হয়েছেন সেখান থেকে। তিনজনের মধ্যে একজন মহিলাও ছিলেন।
বুধবার বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন,‘তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলেন। এটা মার্ডার, খুন হয়েছে। এর নেপথ্যের বিষয় আপনাদের জানাবো।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন,‘যাদের আটক করা হয়েছে জিজ্ঞাসাবাদের পর খুনের নেপথ্য কারণ জানা যাবে। তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছুই জানাচ্ছি না। সব উদ্ধার করবো আমরা।’
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের অ্যান্টি টেররিস্ট ইউনিটের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদন্তে নেমে তারা প্রথমে এমপি আনোয়ারুল আজিমকে বহনকারী ক্যাবচালককে আটক করেন।
সেই ক্যাবচালক তাদের জানিয়েছেন, আজিমকে তার গাড়িতে তোলার পর আরো তিনজন গাড়িতে ওঠেন। তাদের মধ্যে দু’জন পুরুষ ও একজন নারী।
পরে এই চারজন কলকাতা নিউটাউনের ওই বাড়িতে যান।
এটিএফ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এদের মধ্যে পুরুষ দু’জন বাংলাদেশে ফিরে যান। বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগকে জানানো হলে তারা দু’জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের দেয়া তথ্য কলকাতার পুলিশকে জানানো হয়। এরপরেই এমপি আনোয়ারুল আজিমের মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয় পুলিশ।
এমপি আজিমের মেয়ের প্রতিক্রিয়া
এমপি আজিমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন ঢাকায় মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেছেন।
তিনি বলেন,‘সর্বশেষ বাবার সাথে ভিডিও কলে কথা হয়। ওই দিন আমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া কথা ছিল। বলেছিল কলকাতা থেকে ফিরে আম্মু তোমাকে নিয়ে যাবো।’
আজিমের হত্যার ঘটনায় কাউকে সন্দেহ করেন কি না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কাউকে সন্দেহ করি না। কিন্তু যারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের যাতে ধরা হয় সেটা চাই। বাবার হত্যার বিচারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।’
এর আগে, ২০ মে আজিমের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করেছিল।
তারা জানতে পেরেছে কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারের কোনো জায়গায়।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এই তথ্য পেয়েছে কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস কর্তৃপক্ষ, এমনটাই জানিয়েছিলেন উপ-দূতাবাসের এক কর্মকর্তা, যিনি তার নাম প্রকাশ করতে চাননি।
কলকাতার উত্তর শহরতলি বরাহনগর এলাকার সিঁথিতে যে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আজিম, সেই গোপাল বিশ্বাস জানিয়েছেন, ১৩ মে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে ভাড়া করা গাড়িতে উঠেছিলেন আজিম, সেটির চালকের সন্ধান পেয়েছে বলেই স্থানীয় পুলিশের তরফে তাকে জানানো হয়েছে।
গোপাল বিশ্বাস বলেন, পুলিশের কাছে আমি নিখোঁজ ডায়েরি করেছিলাম। তারা ওই গাড়িটিকে খুঁজে বার করেছে আর চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ওই চালক নাকি পুলিশকে জানিয়েছেন যে সংসদ সদস্যের সাথে একজন বাংলাদেশী নাগরিক ছিলেন। এদের দু’জনকে তিনি কলকাতা সংলগ্ন নিউ টাউন এলাকায় ছেড়ে দেন ১৩ মে।’
এর বাইরে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ সংসদ সদস্যের ব্যাপারে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
২০ মে উপ-দূতাবাসের তরফে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস সচিব রঞ্জন সেন জানিয়েছেন,‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সংসদ সদস্যের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের শনিবার জানানো হয়। তারপরই আমরা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করি। তারা খোঁজখবর করছেন এমনটাই আমাদের জানানো হয়েছে।’
আবার শেষবার যেহেতু নিখোঁজ সংসদ সদস্যকে কলকাতায় দেখা গিয়েছিল, তাই কলকাতা পুলিশের সাথেও অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ রাখছিল বাংলাদেশ উপ-দূতাবাস।
ডাক্তার দেখাতে বের হন তিনি
কলকাতার সিঁথি অঞ্চলের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাস এর আগে বলেছিলেন, আনোয়ারুল আজিমের সাথে দু'দশকেরও বেশি সময় ধরে তার পারিবারিক সম্পর্ক।
গোপাল বিশ্বাস বলেন,‘এবারে তিনি এসে আমাকে বলেছিলেন যে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাবেন। কোন ডাক্তার ভালো হবে, সেটাও জানতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমার জানাশোনা কোনো স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ নেই, তাই আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম সল্ট লেকের অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারেন।’
‘আমরা একসাথে সকালের খাবার খেয়েছিলাম। তারপরে তাকে বলেছিলাম আজ আমার গাড়ি নেই, উনি যেন গাড়ির বন্দোবস্ত করে নেন। এরপরে আমি বাড়ির একতলায় অফিসে চলে আসি।’
গোপাল বিশ্বাস বলেন, ‘এরপর আমি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। দুপুরে বেরনোর সময়ে আমাকে বলে যান তিনি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবেন। তার খোঁজ না পাওয়ার পরে আমি যখন সিসিটিভি ফুটেজ দেখি, তখন জানতে পারি উনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন দুপুর একটা ৪১ মিনিটে।’
বরাহনগর থানায় যে নিখোঁজ ডায়েরি করেছেন গোপাল বিশ্বাস সেখানে তিনি লিখেছেন, তার বাড়ির অদূরে বিধান পার্ক এলাকা থেকে ভাড়ার গাড়িটিতে ওঠেন আনোয়ারুল আজিম। তাকে গাড়িতে উঠতে দেখেছেন, এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শীর কথাও পুলিশকে জানিয়েছেন গোপাল বিশ্বাস।
সন্ধ্যায় বন্ধুর বাড়িতে ফিরে আসার কথা থাকলেও সেখানে ফেরেননি আজিম।
হোয়াটস্অ্যাপে ১৩ মে তিনি মেসেজ পাঠান যে ‘বিশেষ কাজে দিল্লি চলে যাচ্ছি এবং পৌঁছে ফোন করবো, তোমাদের ফোন করার দরকার নেই।’
ডাক্তার দেখাতে বের হয়ে দিল্লিতে?
কলকাতার গোপাল বিশ্বাসের গহনা রফতানির ব্যবসা আছে। তিনি জানান, দুই আড়াই দশকের বন্ধুত্ব সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিমের সাথে।
তিনি বলেন,‘বাংলাদেশে বিএনপির সময় ও ভারতে থাকত। আমাদের বাড়ি মাঝদিয়ায়। সেখানে সুভাষ আগরওয়ালের বাড়িতে থাকত আজিম। আমার সাথে সেখানেই পরিচয়, তারপরে বন্ধুত্ব। সম্পর্কটা এখন পারিবারিক স্তরে চলে গেছে।’
সে কারণেই চিকিৎসা করাতে এসে বন্ধুর বাড়িতে উঠেছিলেন আনোয়ারুল আজিম।
ওই দিন দুপুরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরে আজিম যে ভাড়াচালিত গাড়িতে উঠেছিলেন সেটির চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ।
এরপর গোপাল বিশ্বাসকে পুলিশ জানিয়েছে, আজিমের সাথে আরেকজন বাংলাদেশী নাগরিককে নিউ টাউন অঞ্চলে ছেড়ে দেয়ার কথা জানিয়েছেন ওই চালক।
এরপর ১৫ মে সকালে গোপাল বিশ্বাস আজিমের কাছ থেকে আবারো একটি হোয়াটস্অ্যাপ মেসেজ পান যে তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং তার সাথে ‘ভিআইপিরা’ আছেন, তাই তাকে যেন ফোন না করা হয়।
এর দু'দিন পরে, ১৭ মে গোপাল বিশ্বাসকে আজিমের মেয়ে ফোন করে জানান যে তার বাবার সাথে কিছুতেই তারা যোগাযোগ করতে পারছেন না।
গোপাল বিশ্বাস বলেন, সে খবর জানতে পেরে কলকাতায় ওর যত ঘনিষ্ঠ মানুষ আছেন বলে আমি জানি, সবাইকে বিষয়টা জানাই। তারাও খোঁজ খবর করতে শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই আজিমকে ফোনে পাওয়া যায়নি।’
পরের দিন, ১৮ মে বরাহনগর থানায় যান তিনি।
গোপাল বিশ্বাস বলেন,‘সেখানে আমাকে সারাদিন বসিয়ে রাখা হয়। পুলিশ আমার বাড়িতে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। সেসব খতিয়ে দেখে আমার নিখোঁজ ডায়েরি নেয়া হয়। তারা ওই ভাড়ার গাড়িটির নম্বরও পেয়ে যায়। চালকের সাথে কথা বলেছে। নিশ্চয়ই পুলিশ খোঁজখবর করছে, আমাকে তো আর সব তথ্য জানাচ্ছে না।’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশের উপ-দূতাবাস যে তথ্য পেয়েছিল, সে অনুযায়ী ১৭ মে আজিমের মোবাইল নম্বরটি কিছুক্ষণের জন্য বিহারে অবস্থান করছিল।
আবার এটাও জানতে পেরেছে তারা যে মোবাইল সেট থেকে সিম কার্ডটি আলাদা করে রাখার কারণে সঠিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এর আগে, ঢাকায় ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তার দুটি বাংলাদেশী নম্বর আছে আর একটি ভারতের নম্বর। আমরা ভারতীয় পুলিশের সহযোগিতায় তার ভারতীয় নম্বরটি দেখলাম মুজাফফরাবাদ অর্থাৎ বিহারের দিকে।
ঘটনাচক্রে বিহারে মুজাফফরাবাদ নামের জায়গা নেই। পাকিস্তান শাসিত জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানীর নাম মুজাফফরাবাদ, আর প্রায় কাছাকাছি যে নামের জায়গা বিহারে আছে, সেই জায়গার নাম মুজফ্ফরপুর।
ডিবির প্রধান সেদিন জানিয়েছেন,‘আমরা বিষয়টার খোঁজখবর রাখছি। ভারতের যারা বাংলাদেশে আছেন, তাদের সাথে কথা বলছি, আবার ভারতীয় পুলিশের সাথেও কথা বলছি। উনার পরিবারও যোগাযোগ রাখছে আমাদের সাথে। তার মেয়ে আমাদের কাছে এসেছিলেন।’
ডিবি কার্যালয়ে বাবার নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন সংসদ সদস্যের কন্যা মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
সূত্র : বিবিসি