১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মস্তিষ্কের টিউমার

-

চেম্বারে রোগী দেখছি। ৩৫ বছর বয়সী একজন নারী এলেন। কোলে তিন বছরের একটি ছেলে। সাথে স্বামী। বেশ হাসিখুশি ভদ্রমহিলা। সমস্যা কি জানতে চাইলে জানালেন, চোখে দেখার সমস্যা। এক চোখে দেখেন না, অন্য চোখে কম দেখতে পাচ্ছেন। মাথাব্যথা আছে কি না জানতে চাইলে স্বামী জানালেন, অনেক দিন ধরেই মাথাব্যথা। প্রায় সময়ই মাথাব্যথার সাথে বমি হয়। কয়েক মাস ধরে চোখে কম দেখছে। ইদানীং এক চোখে দেখতে পায় না বলেই চলে।
আমি খারাপ কিছু সন্দেহ করছি। অপথ্যালমোস্কোপ দিয়ে দেখি চোখের নার্ভের প্রেসার অনেক বেশি হয়ে নার্ভ নষ্ট করেছে। ব্রেনের এমআরআই পরীক্ষা করতে দিয়ে দেখা করতে বলি। পরের দিন এমআরআই পরীক্ষা করে আসেন। এমআরআই দেখে আমি খুব কষ্ট পাই। মেয়েটার কোলের সন্তানটির দিকে চোখ যেতেই বুকটা মুচড়ে ওঠে। মস্তিষ্কের টিউমার। ব্রেনের বিরাট অংশ জুড়ে আছে সেটি। অপারেশন করলেও খুব বেশি উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
তাদের কাছে জানতে চাইলাম কেন এত দেরি করলেন। তারা জানাল, হাতুড়ে লোকদের চিকিৎসা নিয়ে সময় গেছে। যখন চোখে একেবারেই দেখছে না তখন আপনার কাছে এসেছি।
সপ্তাহে প্রতি শুক্রবার একটি উপজেলায় চেম্বার করতে যাই। সপ্তাহের মাঝখানে সেখানের একজন চিকিৎসক ফোন করে জানান, তার বোনের এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন শরীরের একপাশে শক্তি কমে গেছে। আমি তাকে দ্রুত সিটিস্ক্যান করার পরামর্শ দেই। সিটিস্ক্যান দেখে বুঝতে পারি মেয়েটি স্ট্রোক করেনি। তার আসলে মস্তিষ্কের টিউমার আছে। দ্রুত অপারেশন করার পরামর্শ দেই। অপারেশন করে সে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এখন সে ভালো আছে।
দুটো গল্পই সত্যি। দুটো গল্পের ফলাফল ভিন্ন। শুধু সচেতনতার জন্য একজন সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে আর অন্যজন মৃত্যু পথযাত্রী।
বিশ্বব্যাপী ১.৪ মিলিয়ন মানুষ মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত। প্রতি বছর প্রায় তিন লাখ মানুষ নতুন করে এ টিউমারে আক্রান্ত হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে টিউমারে আক্রান্তদের মধ্যে ২ শতাংশ মস্তিষ্কের টিউমারে আক্রান্ত হন।
মস্তিষ্কের টিউমার বেশ জটিল রোগ। কিছু কিছু টিউমার বেশ ভালো। আবার কিছু টিউমারের মৃত্যুর হার বেশি।
শরীরের কোনো স্থানের কোষের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি হলে সেখানে টিউমার দেখা দেয়। টিউমার দুই প্রকার। টিউমার যদি শরীরের এক স্থান থেকে অন্য ছড়িয়ে না পড়ে তাহলে তাকে বিনাইন টিউমার বলে। আর কোনো টিউমার যদি এক স্থান থেকে শরীরের অন্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে তবে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বলে। যেটিকে আমরা বোঝার সুবিধার্থে ক্যান্সার বলি।
মস্তিষ্কে হতে রোগ টিউমার। ভালো দিক হলো মস্তিষ্কে বেনাইন টিউমার বেশি হয়। মানে মস্তিষ্ক ছাড়া অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়ে না। কিন্তু সমস্যা হলো মস্তিষ্কে যেহেতু জায়গা কম তাই টিউমার প্রভাব ফেলতে পারে সহজেই। মানে হলো লক্ষণগুলো দেখা দেয় তাড়াতাড়ি। এর সুবিধাও আছে। এর ফলে রোগী দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যান। তাই রোগ তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে। মস্তিষ্কে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়তে পারে। মানে অন্য কোনো অঙ্গ থেকে ক্যান্সার মস্তিষ্কে আসতে পারে। যেমন- স্তন ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার, কিডনির ক্যান্সার, অন্ত্রের ক্যান্সার, মেলানোমা মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে তা খুব কম।

কাদের হয় মস্তিষ্কের টিউমার
টিউমারের কিন্তু কোনো বয়স নেই। ছোট থেকে বৃদ্ধ সবার মস্তিষ্কের টিউমার হতে পারে। শিশুদের টিউমারগুলো কিন্তু মারাত্মক বেশি হয়।

কেন হয়?
কেন মস্তিষ্কের টিউমার হয় তার কারণ জানা যায় না। তবে কিছু কিছু কারণে টিউমারের ঝুঁঁকি বাড়ে।
রেস বা জাতি : কিছু কিছু টিউমার কিছু কিছু মানুষের বেশি হয়। যেমন- গ্লায়োমা টিউমারগুলো ফর্সা মানুষের বেশি হয় আর মেনিনজিওমা হয় কালো বর্ণের মানুষের।
রেডিয়েশন বা তেজস্ক্রিয়তা : অতিরিক্ত মাত্রার রেডিয়েশনের কারণে ক্যান্সার হতে পারে। ক্যান্সার চিকিৎসায় যে রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয় তা কিন্তু মস্তিষ্কের টিউমারের কারণ হতে পারে। পারমাণবিক শক্তি থাকেও এ টিউমার হতে পারে।
বংশগত : কিছু কিছু মস্তিষ্কের টিউমার বংশগত হতে পারে। যেমন- নিউরোফাইব্রোমেটোসিস, ভন হিপ্পেল লিনডু সিন্ড্রোম, লি-ফ্রাউমেনি সিন্ড্রোম ইত্যাদি
বিপদ চিহ্ন
মস্তিষ্কের ক্যান্সারের মূল লক্ষণ হলো মাথাব্যথা। তবে মাথাব্যথা হলেই যে মস্তিষ্কের ক্যান্সার তা কিন্তু নয়। মাথাব্যথার যত কারণ আছে তার বেশির ভাগই কিন্তু অন্য। মস্তিষ্কের টিউমারের মাথাব্যথার ধরণ একটু ভিন্ন। মাথাব্যথা সারাক্ষণ থাকে, পুরো মাথায় হাল্কা বা মাঝারি ধরনের ব্যথা থাকে। হাঁচি-কাশি দিলে মাথাব্যথা বেড়ে যায়। সকালে ঘুম থেকে ওঠলে ব্যথা বেশি হয়। মাথাব্যথার সাথে বমি হতে পারে।
টিউমারের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে কিছু কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। যেমন- মস্তিষ্কের সামনের দিকে টিউমার হলে আচরণে অস্বাভাবিকতা, হঠাৎ রেগে যাওয়া, মনযোগে ঘাটতি হতে পারে।
শরীরের একপাশ ধীরে ধীরে অবশ হওয়া, চোখে দেখার সমস্যা, হাঁটতে সমস্যা, ভারসাম্যহীনতা, কথা বলার সমস্যা, খিঁচুনি, কানে শোনার সমস্যা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেতে পারে। চোখে দেখার সমস্যাও কিন্তু টিউমারের বিপদ চিহ্ন।
টিউমার নির্ণয়ে শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি জরুরি মস্তিষ্কের সিটিস্ক্যান বা এমআরআই। এ ছাড়াও আরো কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে।
মস্তিষ্কের টিউমারের চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে আছে- মেডিক্যাল চিকিৎসা, সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেমোথেরাপি।
চিকিৎসা দেশেই সম্ভব। মস্তিষ্কের চিকিৎসার সব ব্যবস্থা দেশেই হয়। ওষুধের পাশাপাশি সব ধরনের অপারেশনের জন্য দেশে ভালো মানের সার্জন আছেন। যেটা জরুরি তাহলো লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।

ব্রেনের স্বাস্থ্য ও প্রতিরোধ
সুস্থ ব্রেনের জন্য আপনাকে মেনে চলতে হবে কিছু নিয়মকানুন। ব্রেনকে হেলদি রাখতে হলে নিচের জিনিসগুলো মেনে চলুন :
১. শারীরিক পরিশ্রম : প্রতিনিয়ত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করুন। সপ্তাহে পাঁচ দিন ৩০ মিনিট করে ব্যায়াম করুন, মস্তিষ্ক ভালো থাকবে।
২. পরিমিত ঘুমান : ঘুম মস্তিষ্কের জন্য খুব প্রয়োজন। তাই রাত জাগবেন না। রাতে কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যাস করুন। এতে মস্তিষ্ক তরতাজা থাকবে।
৩. খাবার হোক স্বাস্থ্যকর : অতিরিক্ত চর্বি, তেল প্রাণীজ আমিষ খাওয়া কমিয়ে দিন। লবণ পরিহার করুন। প্রচুর শাকসবজি, উদ্ভিদজাত আমিষ, ডিম, মাছ খেতে পারেন। অলিভ ওয়েল তেল হিসেবে ব্যবহার করুন।
৪. মেধাকে কাজে লাগান : মাংসপেশী যদি ব্যবহার করা না হয় তাহলে কিন্তু তা শুকিয়ে যায়। হাড় ভাঙার পর ব্যান্ডেজ করা হয়। এতে করে কিন্তু মাংসপেশী শুকিয়ে যায়। মস্তিষ্ক কিন্তু একই রকমের। ব্যবহার করলে ভালো থাকে না হলে অকার্যকর হয়ে পড়ে। তাই মেধাকে পরীক্ষা করুন। নিয়মিত বই পড়ুন। যেসব কাজে মস্তিষ্কের প্রয়োজন পড়ে সেগুলো বেশি বেশি করুন। বেশি টিভি বা মোবাইল দেখবেন না। এতে মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়ে।
৫. মানসিক চাপ কমান : মানসিক চাপ মস্তিষ্কের ওপর খুব খারাপ প্রভাব ফেলে। শুধু মস্তিষ্ক না শরীরের সব অঙ্গে এর প্রভাব ভয়াবহ। মানসিক চাপ দূর করুন। নিজেকে সামাজিক কাজের সাথে যুক্ত রাখুন। মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে এমন কাজ বা পরিবেশ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখুন।
৬. ঝুঁঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখুন : ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কোলস্টেরলের আধিক্য মস্তিষ্কের উপর খারাপ প্রভাব বিস্তার করে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
৭. মাদক, ধূমপান ও খারাপ অভ্যাসকে না বলুন। তাহলে সুস্থ থাকবে মস্তিষ্ক।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল


আরো সংবাদ



premium cement