১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

শিশুদের হতে পারে স্ট্রোক!

-

শিশুদের স্ট্রোক হতে পারে। কি! চমকে উঠলেন। না ভুল শোনেননি। আবার বলছি শিশুদের হতে পারে স্ট্রোক। তবে তাদের কারণ বড়দের কারণ থেকে বেশ আলাদা। আমাদের দেশে কত শিশু প্রতি বছর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এ হার কিন্তু কম নয়। যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর প্রায় কয়েক শত শিশু স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ লাখ শিশুর মধ্যে ২.৫-১৩ জন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। ছেলেশিশুরা মেয়েদের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিশুরা উন্নত দেশের শিশুদের চেয়ে বেশি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এ হার ইস্কেমিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ৪-৫ গুণ বেশি ও হেমোরেজিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ২ গুণ বেশি। স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার ১০-২৫ শতাংশ। কোনো শিশু একবার স্ট্রোক করলে পুনরায় স্ট্রোকের হার ২৫ শতাংশ বাড়ে।

শিশুদের স্ট্রোক কী?
স্ট্রোক হলো মস্তিষ্কের রক্তনালীর রোগ। মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে বা ফেটে রক্তক্ষরণ হলে স্ট্রোক দেখা দেয়।
সে হিসাবে স্ট্রোক দুই প্রকার। ১. ইস্কেমিক স্ট্রোক- কোনো কারণে মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষ মারা যায়। এতে দেখা দেয় নানান ধরনের লক্ষণ। এটাই ইস্কেমিক স্ট্রোক; ২. হেমোরেজিক স্ট্রোক- মস্তিষ্কের রক্তনালী কোনো কারণে ছিঁড়ে গেলে মস্তিষ্কে নানান ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। একে বলে হেমোরেজিক স্ট্রোক।

কারণ কী?
প্রথমেই বলেছি শিশুদের স্ট্রোক হলেও কারণগুলো কিন্তু ভিন্ন, বড়দের থেকে আলাদা।
শিশুদের স্ট্রোকের কারণগুলো আলোচনা করছি।
ইস্কেমিক স্ট্রোকের কারণ
১. কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ- জন্মগতভাবে শিশুদের কিছু হার্টের রোগ হতে পারে। যেমন টেট্রালজি অব ফেলটস, এইসেনমেঞ্জার সিন্ড্রোম, হার্টের ভালভের রোগ- মাইট্রাল স্টেনোসিস, হার্টের ইনফেকশন এন্ডোকারডাইটিস রোগে আক্রান্তদের হার্টে জমা রক্তপিণ্ড হার্ট থেকে ছুটে গিয়ে মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ করে দিতে পারে।
যেসব ক্ষেত্রে স্ট্রোকের কারণ জানা যায় না তাকে ক্রিপ্টজেনিক স্ট্রোক বলে। এ ধরনের স্ট্রোকের প্রায় ৪৫ শতাংশ কারণ প্যাটেন্ট ফোরামেন ওভালি (পিএফও) যা জন্মগতভাবেই থাকতে পারে।
২. রক্তের রোগ সিকেল সেল ডিজিজ- লোহিতকণিকার মূল উপাদান হিমোগ্লোবিন। এটি অক্সিজেন পরিবহনে সহায়তা করে। কিন্তু জেনেটিক কারণে হিমোগ্লোবিনে পরিবর্তন হতে পারে। সিকেল সেল ডিজিজে আক্রান্তদের হিমোগ্লোবিন এস থাকে। এটি থাকার কারণে লোহিত কণিকা ওভাল শেপের না হয়ে অর্ধচন্দ্রাকার হয়। ফলে পানিস্বল্পতা বা এসিডোসিস দেখা দিলে লোহিত কণিকা জমাট বেঁধে যায়। এ কারণে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। দেখা দেয় স্ট্রোক। সিকেল সেল ডিজিজে আক্রান্তদের প্রথম ১০ বছরের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
৩. রক্ত জমাট বাঁধার রোগ- রক্তের কিছু উপাদানের সমস্যা এ জন্য রক্ত সহজেই রক্তনালীতে জমাট বেঁধে যায়। ফলে মস্তিষ্কের রক্তনালী বন্ধ হয়ে স্ট্রোক হতে পারে। যেমন প্রোটিন সি, প্রোটিন এস, এন্টি থ্রোম্বিন, ফ্যাক্টর ফাইভ লেইডেনের অভাবে এমনটা হতে পারে।
৪. ইনফেকশন- শিশুদের ইনফেকশনের কারণে স্ট্রোক হতে পারে। চিকেনপক্স বা জলবসন্তের পরে হতে পারে স্ট্রোক। এ ছাড়া ব্যাক্টেরিয়াল মেনিনজাইটিস, এনকেফালাইটিস ও রক্তে মারাত্মক ইনকফেকশন থেকেও হতে পারে স্ট্রোক।
৫. আর্টেরিয়াল ডাইসেকশন বা রক্তনালীর ব্যবচ্ছেদ- এক্সিডেন্ট বা খেলাধুলার সময় ঘাড়ে আঘাত লাগলে রক্তনালীতে ডাইসেকশন বা পকেটের মতো স্থান তৈরি হতে পারে। এ জায়গায় রক্ত সহজেই জমাট বেঁধে যেতে পারে। এখান থেকে হতে পারে স্ট্রোক।
৬. ময়াময়া ডিজিজ- ময়াময়া ডিজিজ হলো মস্তিষ্কের রক্তনালীর একটি রোগ। এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের প্রধান রক্তনালীগুলো সঙ্কুুচিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মস্তিষ্কের রক্ত সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য কিছু ছোট ছোট রক্তনালী তৈরি হয়। এনজিওগ্রাম করলে এ ছোট ছোট রক্তনালীগুলোকে পাফ অব স্মোক বা ধোঁয়ার মতো প্যাচানো মনে হয়। নতুন এ রক্তনালীগুলোতে সহজেই রক্ত জমাট বাঁধতে পারে বা ছিঁড়ে যেতে পারে। রক্ত জমাট বাঁধলে হতে পারে ইস্কেমিক স্ট্রোক আর ছিঁড়ে গেলে হয় হেমোরেজিক স্ট্রোক। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে ইস্কেমিক স্ট্রোক বেশি হয়ে থাকে।
৭. ভাস্কুলাইটিস- রক্তনালীতে নানান কারণে প্রদাহ হতে পারে। একে বলে ভাস্কুলাইটিস। এটিও শিশুদের স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
৮. ভেনাস সাইনাস থ্রোম্বসিস- মস্তিষ্কের শিরাগুলো এক ধরনের ফাঁকা জায়গায় গিয়ে মিলিত হয়। একে বলে ভেনাস সাইনাস। এ ভেনাস সাইনাসগুলোতে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। একে বলে ভেনাস সাইনাস থ্রোম্বোসিস। বিভিন্ন কারণে তা হতে পারে। ইনফেকশন, পানিশূন্যতা, রক্ত জমাট বাঁধার রোগ হলে ভেনাস সাইনাস থ্রোম্বোসিস হতে পারে।

শিশুর হেমোরেজিক স্ট্রোকের কারণ
১. এনিউরিজম- রক্তনালী ফুলে ফোস্কার মতো হলে এনিউরিজম বলে। এ ফোস্কা ছিঁড়ে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। একে বলে সাব এরাকনয়েড হেমোরেজ।
২. এভিএম বা আর্টেরিওভেনাস ম্যালফরমেশন- শিশুদের হেমোরেজিক স্ট্রোকের অন্যতম কারণ এভিএম বা আর্টেরিওভেনাস ম্যালফরমেশন। রক্তনালীর স্বাভাবিক স্ট্রাকচার থেকে পরিবর্তিত অস্বাভাবিক হয়ে থাকে। মানে রক্তনালীগুলোর মধ্যে অস্বাভাবিক কমিউনিকেশন তৈরি হয়।
৩. অন্যান্য কারণ- ভাস্কুলাইটিস, ময়াময়া, ওষুধ ইত্যাদি কারণে হেমোরেজিক স্ট্রোক হতে পারে।

লক্ষণ
স্ট্রোকের মূল লক্ষণগুলোকে সহজ করে মনে রাখা যায় ফাস্ট নামে। ঋঅঝঞ মানে হলো ফেসিয়াল এসেমিট্রি বা মুখ একদিকে বেঁকে যাওয়া, অ- তে আর্ম বা বাহুতে দুর্বলতা, ঝ-তে স্পিস ডিফিকাল্টি বা কথা জড়িয়ে যাওয়া ঞ -তে এগুলো হলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে।
এ ছাড়া আরো কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে যেমন তীব্র মাথাব্যথার সাথে বমি, চোখে দেখার সমস্যা, খিঁচুনি, ব্যালেন্স রাখা সমস্যা, হাঁটার সমস্যা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরানো ইত্যাদি।

রোগ নির্ণয়
শিশুদের স্ট্রোক নির্ণয় করা বেশ কষ্টকর। কারণ এটা নিয়ে সাধারণ মানুষদের তো সচেতনতার অভাব আছে সেই সাথে চিকিৎসকদেরও। স্ট্রোক হয়েছে কি না তা জানার জন্য মস্তিষ্কের নিউরোইমেজিং বা সিটি স্ক্যান বা এমআরআই পরীক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া স্ট্রোকের কারণ নির্ণয় করার জন্য বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। রক্তের পরীক্ষা, হার্টের পরীক্ষা, রক্তের ইনফেকশনের পরীক্ষাসহ নানাবিধ পরীক্ষা করতে হয়। এর পরও কারণ অজানাই থেকে যেতে পারে।
রক্তনালীর সমস্যা নির্ণয় করার জন্য এনজিওগ্রাম করতে হয়। হার্টের সমস্যায় যেভাবে এনজিওগ্রাম করা হয় ঠিক সেভাবেই মস্তিষ্কের এনজিওগ্রাম করা হয়। সাধারণত হেমোরেজিক স্ট্রোকে এনজিওগ্রাম করা হয় বেশি। দেশের সরকারিভাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে শিশুদের এনজিওগ্রাম করার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া বেসরকারিভাবে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল, কল্যাণপুরের ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ, ল্যাবএইড ধানমন্ডি, মাউন্ট এডোরা সিলেট-এ করা যায়।

চিকিৎসা
স্ট্রোকের চিকিৎসাকে দুই ভাবে ভাগ করা যায়।
ইস্কেমিক স্ট্রোকে রক্ত তরল করার ওষুধ যেমন এসপিরিন দিতে হয়। তবে সিকেল সেল এনিমিয়াতে এটি দেয়া যায় না। রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়। এ ছাড়া স্ট্রোকের কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হয়।
হেমোরেজিক স্ট্রোকের ক্ষেত্রে এনজিওগ্রাম করে কারণ বের করে চিকিৎসা করতে হয়। যেমন এনিউরিজম থাকলে রক্তনালীর ফোস্কা কয়েলিং বা ক্লিপিংয়ের মাধ্যমে বন্ধ করে দিতে হয়। এভিএম থাকলে গ্লু দিয়ে অস্বাভাবিক রক্তনালী বন্ধ করে দিতে হয়।
ময়াময়া রোগের চিকিৎসা সার্জারির মাধ্যমে করতে হয়।
শিশুদের স্ট্রোকের চিকিৎসা বাংলাদেশে হয়। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস) হাসপাতালে শিশু নিউরোলজি ও শিশু নিউরোসার্জারির আলাদা বিভাগ আছে।

স্ট্রোক আক্রান্ত শিশুর পুনর্বাসন
স্ট্রোক আক্রান্ত শিশুর জন্য পুনর্বাসন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা এটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করে থাকেন।
শিশুর স্ট্রোক হলে দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করুন। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চিকিৎসা সম্পন্ন করুন।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইন্টারভেনশনাল নিউরোলজি বিভাগ
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিনস),
আগারগাঁও, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সমন্বয় গড়তে সংশোধিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করলো দেশ গড়ার দ্বিতীয় সুযোগ যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয় : আসিফ নজরুল লেককে ভয়েস অব আমেরিকার পরিচালক করলেন ট্রাম্প এক ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ হার পাকিস্তানের হাটহাজারীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১, আহত ২ কুড়িগ্রামে তাপমাত্রা বাড়লেও শীতের তীব্রতা কমেনি শৈত্যপ্রবাহে কাঁপছে পঞ্চগড়, ৯ ডিগ্রিতে নামল তাপমাত্রা নাফনদীর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার : স্বস্তি ফিরেছে সেন্টমার্টিনে আফ্রিকায় এবার ভয়াবহ ব্লিডিং আই ভাইরাসের হানা প্রথম দফায় ১৮ হাজার ভারতীয়কে ফেরত পাঠাচ্ছেন ট্রাম্প! প্রতিদিন সকালে মোরগ কেন ডাকে?

সকল