২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা প্রাণঘাতী রোগ নয়

-

আমাদের দেশে কিছু দিন ধরে অ্যানথ্রাক্স বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছে। আদিকাল থেকে অ্যানথ্রাক্স বা তড়কা রোগ থাকলেও আমাদের দেশে এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০১০ সালের দিকে। সে সময় প্রায় সাড়ে ৭০০ জন ব্যক্তি তড়কা রোগে আক্রান্ত হন। এখন পর্যন্ত টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও কুষ্টিয়া থেকে তড়কা রোগে আক্রান্তের খবর পাওয়া গেছে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আমাদের দুচিন্তা বেশ। এটা কি খুবই প্রাণঘাতী রোগ? অনেকে অভিযোগ করছেন আসন্ন বকরি ঈদের আগে এটা নিয়ে প্রচারণার পেছনে নেই তো কোনো উদ্দেশ্য? অ্যানথ্রাক্স নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও লাইন ডিরেক্টর, কমিউনিকেবল ডিজিজ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। এ বিষয়ে তার আছে বিস্তর গবেষণা। এ নিয়ে তার বেশ কয়েকটি প্রকাশনাও আছে। তার মুখ থেকেই শুনুন অ্যানথ্রাক্স নিয়ে।
অ্যানথ্রাক্স মূলত তৃণভোজী পশুর রোগ। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দিয়ে এটি হয়। এটি একটি স্পোর তৈরি করতে পারে এমন ব্যাকটেরিয়া। স্পোর হলো ব্যাকটেরিয়ার একটি স্পেশাল অবস্থা এর মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়া দীর্ঘদিন মাটিতে বেঁচে থাকতে পারে। গবাদিপশু যখন মাঠে ঘাস খায় তখন ঘাসের সাথে এ স্পোররূপী ব্যাকটেরিয়া পশুকে আক্রান্ত করে। গবাদিপশু জ্বরে আক্রান্ত হয়, প্রাণী কাঁপতে থাকে, ঘন ঘন শ্বাস নেয়, পেট অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায় এবং পশু হঠাৎ করে মারা যেতে পারে। মারা যাওয়ার পর প্রাণীর নাক, মুখ ও পায়খানার রাস্তা দিয়ে কালচে রক্ত বের হয়ে আসে।
হাঁস-মুরগি বা গরু-ছাগল অসুস্থ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের দেশের বেশির ভাগ লোকেই চিন্তা থাকে তা জবাই করা। মনে করা হয় মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত জবাই করে খাওয়া হালাল এটি আমাদের দেশে খুবই প্রচলিত। মালিক কম দামে বিক্রি করেন আর অন্যরা কম দামে কিনে খেতে পেরে খুশিই হন। এ থেকেই বিস্তার ঘটে অ্যানথ্রাক্স পশু থেকে মানুষে। অসুস্থ গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, গোশত, হাড়, নাড়িভুঁড়ি ইত্যাদির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। তাই যারা পশু জবাই, কাটা-বাছা, ধোয়া, রান্নার কাজে জড়িত তারাই বেশি আক্রান্ত হন। তবে এটি কিন্তু কখনো মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।
মানুষের শরীরে প্রবেশের পর থেকে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পর্যন্ত সময় লাগে ২-৭ দিন। সাধারণত মানবদেহে অ্যানথ্রাক্স তিন ধরনের রোগ হতে পারে। ত্বকে, পরিপাকতন্ত্রে এবং ফুসফুসে। এদের মধ্যে পরিপাকতন্ত্র ও ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স একটু জটিল ধরনের। কিন্তু ত্বকের অ্যানথ্রাক্স খুবই হাল্কা ধরনের রোগ। এতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার হার নেই বললেই চলে। আমাদের দেশে যে তাপমাত্রায় গোশত রান্না হয় তাতে অ্যানথ্রাক্স জীবাণু বেঁচে থাকতে পারে না। তাই দেখা গেছে দেশে যত অ্যানথ্রাক্স রোগী তার শতকরা ৯৫ ভাগ এ ত্বকের অ্যানথ্রাক্স-এ আক্রান্ত। এ কারণে বলা যায় অ্যানথ্রাক্স প্রাণঘাতী কোনো রোগ নয়।
আগেই বলেছি, এ রোগটি মূলত ত্বকের। ত্বকে ঘার মতো হয়। প্রথমে চামড়ায় ফোসকা পড়ার মতো শুরু হয় ধীরে ধীরে ঘা হয়ে যায়। গোলাকার ঘা-র মাঝখানে কালচে হয় আর চারদিকের চামড়া লালচে হয়ে পানির ফুসকুরি জমে। এমন ঘা সাধারণত একটিই হয়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে একাধিকও হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘা হাত, মাথা ও দেহের উপরের অংশে দেখা যায়।
অনেকে মনে করতে পারেন এটির কি চিকিৎসা আছে? হ্যাঁ, এটির চিকিৎসা আছে, পুরোপুরি সেরে ওঠা সম্ভব। এ রোগের চিকিৎসা খুবই সহজলভ্য বলেই এর কারণে জীবনহানি ঘটে না। সময় মতো ও সঠিকভাবে চিকিৎসা নিলে রোগ সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আটলান্টার রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের গাইড লাইন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসায় রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। সিপ্রোফ্লোক্সাসিন অথবা ডক্সিসাইক্লিন অথবা পেনিসিলিন দিয়ে চিকিৎসা করা হয়।
অ্যানথ্রাক্সের প্রতিরোধ নির্ভর করে গবাদিপশুর রোগ নিয়ন্ত্রণের ওপর। গবাদিপশুর জন্য অ্যানথ্রাক্সের টিকা আছে। এটি খুব স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এ টিকা প্রস্তুত করে। সরকারি প্রাণিসম্পদ হাসপাতালগুলোতে এর টিকা দেয়া যাবে। টিকা দেয়ার মাধ্যমে গবাদিপশুকে এ রোগের হাত থেকে রক্ষা করে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। তেমনি মানব আক্রান্তের হারও কমানো যায়। আক্রান্ত গবাদিপশুরও চিকিৎসা করতে হবে। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গবাদিপশু অল্প সময়েই মারা যায়। অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত কোনো গবাদিপশু মারা গেলে সেটি চামড়াসহ মাটির গভীরে পুঁতে ফেলতে হবে। কখনই অসুস্থ গবাদিপশু জবাই করা যাবে না। মৃত গবাদিপশু এমনভাবে পুঁততে হবে, যাতে শেয়াল বা অন্য কোনো পশুপাখি মাটি খুঁড়ে এর নাগাল না পায়। খালি হাতে অসুস্থ ও মৃত গবাদিপশু ধরবেন না, দুই হাতে গ্লাভস বা মোটা পলিথিনের আবরণ ব্যবহার করুন। কোনো এলাকায় অ্যানথ্রাক্স দেখা দিলে সে এলাকার গবাদিপশু মাঠে না চড়ানোই ভালো। পশু জবাইয়ের কাজে যারা নিয়োজিত, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তাদের বেশি। কাজেই নিজেদের স্বার্থে তাদের সচেতন থাকতে হবে লক্ষণ দেখা দিলে আক্রান্ত পশু জবাই করা যাবে না।
কোথাও অ্যানথ্রাক্স দেখা দিলে সরকারিভাবে সেখানে মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়। রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি যারা জবাই বা রান্নার সাথে জড়িত তাদের পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা হয়। অ্যানথ্রাক্স রোগের চিকিৎসা যেকোনো সরকারি হাসপাতালে পাওয়া সম্ভব।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই।
অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু মারা যায় খুব তাড়াতাড়ি। তাই বাজারে যে পশু পাওয়া যায় সেগুলো অ্যানথ্রাক্সমুক্ত বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। কারণ দূরবর্তী কোনো এলাকা থেকে পশু ঢাকায় আনতে যে সময় ব্যয় হয় তাতে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত পশু জীবিত থাকার সম্ভাবনা কম। পশু কেনার সময় অসুস্থ কি না তা নিশ্চিত হয়ে কিনুন। পরিশেষে বলা যায় অ্যানথ্রাক্স ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী রোগ নয়, নিরাময় ও প্রতিরোধযোগ্য সাধারণ একটি রোগ।


আরো সংবাদ



premium cement