১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

যুদ্ধবিরতি চুক্তির নতুন কাঠামোতে সম্মত হামাস-ইসরাইল

-

- ফিলিস্তিনিদের গুলি করছে ইসরাইলি স্নাইপার
- পশ্চিমতীর থেকে ৯ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনি অপহরণ
- গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরো অর্ধশতাধিক

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতকামী সংগঠন হামাস ও দখলদার ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, চুক্তির এ কাঠামোতে রাজি হয়েছে উভয় পক্ষ। এখন চুক্তিটি কিভাবে কার্যকর করা হবে সেটি নিয়ে আলোচনা করছে তারা।
সংবাদমাধ্যমটি আরো জানিয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে গাজার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছে হামাস। ওই সময় উপত্যকাটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের কাছে রাখবে না ইসরাইলও। এর বদলে গাজায় প্রতিষ্ঠিত হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর এর নিয়ন্ত্রণে থাকবে ফিলিস্তিনি অথরিটির (পিএ) সমর্থিত বাহিনী।
যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তার বরাতে ওয়াশিংটন পোস্টে মার্কিন সাংবাদিক ডেভিড ইগনাটিয়াস লিখেছেন, চুক্তির কাঠামোতে দুই পক্ষ সম্মত। কিভাবে এটি কার্যকর করা হবে এ নিয়ে তারা আলোচনা করছে। তবে চুক্তির কাঠামো তৈরি হলেও চুক্তি যে এখনই হয়ে যাবে এমন কিছু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। এই সাংবাদিক লিখেছেন, চুক্তির মূল প্রতিবন্ধক হলো দ্বিতীয় ধাপ। এই ধাপে হামাস ইসরাইলি পুরুষ সৈন্যদের মুক্তি দেবে, দুই পক্ষ একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে এবং ইসরাইল তাদের সব সেনাকে গাজা থেকে প্রত্যাহার করে নেবে।
তিনি আরো জানিয়েছেন, আলোচনায় বড় যে বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে সেটি হলো হামাস ও ইসরাইল উভয়ই গাজায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজি হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। যেটি যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে শুরু হবে। ওই সময় হামাস ও ইসরাইল কেউই গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। তিনি আরো জানিয়েছেন, গাজার নিরাপত্তা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষিত বাহিনী। আর এতে সমর্থন দেবে মধ্যপন্থী আরব দেশগুলো।
এই বাহিনীর সদস্যদের নেয়া হবে ফিলিস্তিনি অথরিটির দুই হাজার ৫০০ শক্তিশালী সদস্যদের মধ্য থেকে। যাদের ব্যাপারে ইসরাইল জানে। ওয়াশিংটন পোস্টকে মার্কিন এক কর্মকর্তা বলেছেন, হামাস মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোকে জানিয়েছে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছে। ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে দাবি করা হয়েছে, দুই পক্ষই চায় যুদ্ধ শেষ করতে। কারণ এখন ইসরাইলের লক্ষ্য হলো ওই অঞ্চলে ইরানপন্থী যেসব সশস্ত্র গোষ্ঠী আছে তাদের মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নেয়া।
ফিলিস্তিনিদের গুলি করছে ইসরাইলি স্নাইপার: গাজার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত গাজা সিটি খালি করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত ফিলিস্তিনিদের দিকে ইসরাইলি স্নাইপাররা গুলি ছুড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বৃহস্পতিবার আলজাজিরার লাইভ আপডেটে এই তথ্য জানানো হয়েছে। খবর আলজাজিরার।
গাজা সিটির শুজাইয়া মহল্লার ইয়ারমৌক স্টেডিয়ামের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন এক ফিলিস্তিনি নারী। কিন্তু তাকে জানানো হয়, সেই সড়কে ইসরাইলি স্নাইপারের গুলিতে নিহত ফিলিস্তিনিদের লাশের স্তূপ জমে আছে। তিনি বলেন, আমরা প্যারামেডিক ও দমকল বাহিনীর সদস্যদের কাছে সাহায্য চাই। তারা যেন অন্তত লাশগুলো সড়ক থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এটা না করা হলে রাস্তার কুকুর এসে লাশ খেতে শুরু করবে। তাদেরকে কবর দেয়া প্রয়োজন।
ওই এলাকার অপর এক ব্যক্তি জানান, প্যারামেডিকরা লাশের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, তারা নিজেদের চোখে দেখেছেন, এক ব্যক্তি হেঁটে যাওয়ার সময় মাথায় রাইফেলের গুলির আঘাত পেয়ে টলে পড়ে যান। পরে কোনোমতে তারা এই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
বুধবার জারি করা বিবৃতিতে ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, গাজায় অবস্থিত ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসঙ্ঘের সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) একটি সদর দফতরের অভ্যন্তরে কাজ করা হামাস ও প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে রাতভর অভিযান চালিয়েছে তারা।
ওই কার্যালয়ে অভিযান চালানোর আগেও ওই এলাকা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছে আইডিএফ। ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, তারা কিছু বাসিন্দাদের কাছ থেকে ফোনকল পেয়েছে। বোমা হামলার তীব্রতার কারণে তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে যেতে পারেননি। সংস্থাটি বলছে, গাজা থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, সেখানকার বাসিন্দারা করুণ অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছেন। ইসরাইলি দখলদার বাহিনী আবাসিক এলাকাগুলোতে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং লোকজনকে তাদের বাড়িঘর ও আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাস্তুচ্যুত করছে। ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়ায় জাতিসঙ্ঘ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। জাতিসঙ্ঘ বলছে, গাজা নগরী খালি করার ইসরাইলি নির্দেশ ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোর ভোগান্তিকে আরো তীব্র করে তুলবে। তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা বহুবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
পশ্চিমতীর থেকে ৯ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনি অপহরণ : এ দিকে ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিমতীর এবং পূর্ব জেরুসালেম বা আল-কুদস শহর থেকে গত ৯ মাসে ৯ হাজার ৬০০ ফিলিস্তিনিকে অপহরণ করেছে ইসরাইল। ফিলিস্তিনের বন্দিবিষয়ক কমিশন, ফিলিস্তিনি প্রিজনার্স ক্লাব, আদামির প্রিজনার্স সাপোর্ট এবং হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশন বুধবার এ তথ্য জানিয়েছে।
সংগঠনগুলোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অপহৃত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের মধ্যে ৩২৫ জন নারী, ৬৭০টি শিশু এবং ৮৮ জন সাংবাদিক রয়েছেন। পাশাপাশি অক্টোবর মাসের প্রথম দিক থেকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সাড়ে ৭ হাজার কথিত প্রশাসনিক আটকাদেশ জারি করেছে ইসরাইল। বহু সংখ্যক নারী ও শিশুর বিরুদ্ধেও এই আটকাদেশ জারি করা হয়। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইল যেসব অমানবিক নীতি চর্চা করে আসছে, তার মধ্যে এই প্রশাসনিক আটকাদেশ অন্যতম। এই আটকাদেশের মাধ্যমে ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের অনির্দিষ্টকালের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই কারাগারে আটক রাখতে পারে। এ সময় ফিলিস্তিনিরা কোনো আইনজীবীও নিয়োগ দিতে পারবে না। গাজায় গত অক্টোবর থেকে ইসরাইল যে অপহরণ ও ধরপাকড় অভিযান চালাচ্ছে, তার পাশাপাশি সমান তালে চলছে কঠোর নির্যাতন ও হত্যার হুমকি। ইসরাইলি বাহিনীর হাতে অপহৃত বেশ কিছু ফিলিস্তিনি প্রাণও হারিয়েছেন। অন্য দিকে অবরুদ্ধ গাজায় গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলি সামরিক অভিযানে এ পর্যন্ত ৩৮ হাজার ৩৪৫ জন নিহত এবং ৮৮ হাজার ২৯৫ জন আহত হয়েছেন।
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহত আরো অর্ধশতাধিক : গাজায় ইসরাইলি বর্বর হামলায় আরো অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি মারা গেছেন। এতে করে উপত্যকাটিতে নিহতের মোট সংখ্যা পৌঁছে গেছে প্রায় ৩৮ হাজার ৩৪৫ জনে। এ ছাড়া গত বছরের অক্টোবর থেকে চলা এই হামলায় আহত হয়েছেন আরো ৮৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার এই তথ্য জানিয়েছে তুরস্কের বার্তাসংস্থা আনাদোলু।
খবরে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান হামলায় আরও ৫২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এতে করে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৮ হাজার ৩৪৫ জনে পৌঁছেছে বলে বুধবার অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, নিরলস এই হামলায় আরো অন্তত ৮৮ হাজার ২৪১ জন ব্যক্তিও আহত হয়েছেন।
মন্ত্রণালয় বলেছে, শেষ ২৪ ঘণ্টায় ইসরাইলি বাহিনীর করা চারটি ‘গণহত্যায়’ ৫২ জন নিহত এবং আরো ২০৮ জন আহত হয়েছেন। অনেক মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় আটকা পড়ে আছেন কারণ উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। মূলত গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানিয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব সত্ত্বেও ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে তার নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় অবিরাম বিমান ও স্থল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলি এই হামলায় হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থী শিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজার হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে প্রায় ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা তাদের বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ইসরাইলি আক্রমণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। জাতিসঙ্ঘের মতে, ইসরাইলের বর্বর আক্রমণের কারণে গাজার প্রায় ৮৫ শতাংশ ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি এবং ওষুধের তীব্র সঙ্কটের মধ্যে গাজার সবাই এখন খাদ্য নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। এ ছাড়া অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের ৬০ শতাংশ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইল ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement