শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে সমর্থন বিএনপির
ক্ষমতায় গেলে প্রত্যয় স্কিম বাতিল, কোটা সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১৫ শতাংশ : মির্জা ফখরুল- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ০৭ জুলাই ২০২৪, ০২:৩৪
সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থীদের চলমান দুই আন্দোলনকে যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত বলেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই দুই আন্দোলন সম্পর্কে দলের অবস্থান জানাতে গিয়ে গতকাল শনিবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে প্রযুক্তি ও জ্ঞান ভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থায় টিকে থাকতে হলে মেধাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। তাই সাধারণ ছাত্র সমাজের কোটা সংস্কার আন্দোলনের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবিগুলোর সাথে আমরা একমত। আমরা আশা করি, সময় থাকতে সরকার ছাত্র সমাজের ন্যায়সঙ্গত যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেবে। আমরা এই সমস্যার সমাধানের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে তা অবশ্যই যৌক্তিক ও সমর্থন যোগ্য। আমরা তাদের এই যৌক্তিক আন্দোলন সমর্থন করছি এবং অবিলম্বে এই পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য ‘প্রত্যয়’ নামে একটি স্কিম চালু করেছে সরকার। কিন্তু তাতে যুক্ত হলে অবসর-পরবর্তী আর্থিক সুবিধা কমে যাওয়ার শঙ্কায় আন্দোলন করছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা। অন্য দিকে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা।
এটা (প্রত্যয় স্কিম) বাতিল করব : শিক্ষকদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, সবচেয়ে শিক্ষকদের ব্যাপারটা সেনসেটিভ এই জন্য যে, তাদের তো অন্য কোনো সোর্স অব ইনকাম নেই। অন্যান্যের চুরি-চামারি, দুর্নীতির অভিযোগ থাকতে পারে, শিক্ষকদের তো সেটা নেই। সে জন্য তাদেরকে শুধু বাধ্য হয়ে এই বেতনের ওপরে নির্ভর করতে হয়। এ জন্য তারা বেশি বিক্ষুব্ধ এবং তারা মনে করে যে এটা তাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অবশ্যই এ ব্যাপারে পজেটিভ ব্যাপার থাকবে। অর্থাৎ আমরা যদি কখনো সরকারের যাই, এটা (প্রত্যয় স্কিম) যদি তখন পর্যন্ত টিকে থাকে- এটা আমরা বাতিল করব।
কোটা ৫৬% নয়, বড়জোর ১৫% : মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা মনে করি, কোটা মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী ও নৃজাতিসহ পিছিয়ে পরার জন্য থাকতে পারে, তবে ৫৬ শতাংশ নয়। এটা বড়জোর ফাইভ থেকে ফিফটিন পারসেন্ট হতে পারে। এর বেশি হলে মেধার বিষয়টা থাকে না। এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধা নেই এখন। অনেকের বয়স হয়ে গেছে। আমাদের বয়সের জায়গায় চলে গেছেন। তাদের সন্তানেরা পাবেন, সেটায় আপত্তি নেই আমাদের। তবে সেটার নাম করে যে কাউকে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে, হাজার হাজার সার্টিফিকেট দিয়ে তাদেরকে চাকরি ব্যবস্থা করে দেয়া হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। সেটা তো আমরা কখনোই সমর্থন করতে পারি না।
সংবাদ সম্মেলনে এই দুই আন্দোলনের বিষয়ে দলের অবস্থানও স্পষ্ট করেন, বিএনপি মহাসচিব যা সম্প্রতি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, গত কয়েকদিন ধরে শিক্ষার্থীরা চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি বাতিলের জন্য হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন করছে। এই আন্দোলন আস্তে আস্তে বেগবান হচ্ছে এবং সম্পৃক্ততা বাড়ছে। যে দাবি নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছে তারা অতীতেও আন্দোলন করেছিল। অবশ্যই ওই আন্দোলনে কিন্তু সরকার যেটা করতে চাচ্ছিল তখন সেটা তারা পারিনি। অর্থাৎ কোটা অনেক কমিয়ে নিয়ে এসছিল। এখন আবার আমরা দেখতে পারছি যে, হাইকোর্ট থেকে একটা রায় দিয়েছে যে রায়ে আগে সেই অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ কোটা থাকবে। এখানে সমস্যাগুলো হচ্ছে যে, ৫৬ শতাংশ যদি কোটাতেই চলে যায় তাহলে কিন্তু মেধার বিকাশ একেবারেই সম্ভব হবে না। আজকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে মেধার শূণ্যতা দেখা দিচ্ছে, সেটি মূলত এ কারণেই।
কোটা নিয়ে বিএনপির অবস্থান : মির্জা ফখরুল বলেন, কয়েকদিন ধরে ছাত্ররা কোটা পদ্ধতি বাতিলের জন্য হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে রাস্তায় আন্দোলন করছে। এটা ছাত্রদের আন্দোলন, আমাদের এখানে সম্পৃক্ততা হওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশের একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে কোটার বিষয়ে বিএনপির মতামত তুলে ধরে তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা দেয়া হয়। রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবসসমূহ এমনকি তাদের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মানের সাথে দাফন করা হয়। এগুলো তাদের প্রাপ্য। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ নানা সুবিধা আছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধান অঙ্গীকার ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণ করা। সাংবিধানিকভাবে ও আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান। কিন্তু সংবিধানের ২৮(৪) ও ২৯(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নারী ও নাগরিকদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া অংশ এবং প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও শারীরিক প্রতিবন্ধীর বাইরে ব্যতিক্রম হিসেবে কিছু সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা বহাল রেখে প্রযুক্তি ও মেধানির্ভর বিশ্বব্যবস্থার জাতি হিসেবে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী কোনো শ্রেণীতেই কোটা পদ্ধতি মেধা বিকাশের সহায়ক হতে পারে না এবং মেধাভিত্তিক বৈষম্যহীন জাতি ও সমাজ বিনির্মাণের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের সাথে সাংঘর্ষিক।
আদালতকে সরকার ব্যবহার করছে : বিএনপি মহাসচিব বলেন, বর্তমান অবৈধ, অনির্বাচিত, কর্তৃত্ববাদী সরকার বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে অর্থাৎ আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে জনগণের ন্যায্য দাবিগুলো দমিয়ে রাখার ঘৃণ্য পুরনো কৌশলেই ছাত্র সমাজের ন্যায্য আন্দোলনকে দমানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আইন ও বিচার বিভাগের দোহাই দিয়ে ছাত্র সমাজের যৌক্তিক দাবিগুলো দমানোর সব অপচেষ্টা ব্যর্থ বলে আমরা বিশ্বাস করি। কারণ ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, জনগনের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন কখনো দমানো যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন নিয়ে বিএনপির অবস্থান : মির্জা ফখরুল বলেন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদান, পরীক্ষা নেয়াসহ সব ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরা। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রকৃত পক্ষে এটি এই দেউলিয়া সরকারের দুর্নীতির আরেকটি পথ খুলে দেয়া। যেহেতু দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা চরম সংকটাপন্ন, সেহেতু অন্যান্য খাতসহ শিক্ষকদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে এই পেনশনের টাকা তুলে নিতে চাচ্ছে। আমরা মনে করি, সরকারের আর্থিক দুরাবস্থার মধ্যে সর্বজনীন পেনশন স্কিম নামে নতুন স্কিম চালু করা সরকারের দুর্বল আর্থিক খাত মেরামত করার একটা কৌশল। এটি এই অবৈধ ও আর্থিক দেউলিয়া সরকারের আরেকটি নতুন লুটপাটের স্কিম যার নাম পেনশন স্কিম, প্রত্যয় স্কিম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীদের সাথে অর্থাৎ অংশীজনদের সাথে কোনো রকম আলোচনা ছাড়াই স্বেচ্ছাচারী কায়দায় বাধ্যতামূলকভাবে চালু করতে চাচ্ছে বর্তমান অবৈধ সরকার। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষক সমাজের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা অবশ্যই যৌক্তিক ও সমর্থনযোগ্য। তিনি বলেন, সরকারের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতাকে পুঁজি করে শাসকগোষ্ঠীর আশীর্বাদপুষ্ট এক শ্রেণীর ব্যবসায়িক লুটেরা সিন্ডিকেট ও কিছু কিছু সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী সীমাহীন লুটপাট করছে। ব্যাংক ও সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাত সম্পূর্ণভাবে ধবংস করে তারা বিদেশে অর্থ পাচার করছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সে রকম পরিস্থিতিতে নাগরিকরা সারাজীবনের অর্জিত সম্পদ কোন ভরসায় এই নতুন লুটপাট স্কিমে বিনিয়োগ করবে? তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় কোষাগার প্রায় শূন্য, ব্যাংকিং খাত প্রায় দেউলিয়া, এরকম লুটেরা তন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য এ রকম পেনসন স্কিমের মতো আরো স্কিম চালু করে জনগণের পকেট শূন্য করতে চায় এই লুটেরা সরকার। সরকারের এই হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত ও অনৈতিক তথাকথিত পেনসন স্কিমসহ ইত্যকার সব প্রকল্প প্রত্যাখ্যান করেছে জনগণ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা