কলাপাড়ায় উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনের গাছ
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব- কলাপাড়া (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা
- ২৮ জুন ২০২৪, ০০:০৫
সৈকতের গঙ্গামতি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের হাজারো মৃত গাছ বিবর্ণ হয়ে কঙ্কালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এসব গাছ আবার কেটে নিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষ। কোনটি মরা গাছে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলায়। সাগরে ভেসে গেছে হাজারো গাছ। বন বিভাগের উদাসীনতা আর নানামুখী প্রাকৃতিক সমস্যায় গঙ্গামতির সংরক্ষিত বনাঞ্চল এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের অন্যতম আকর্ষণ এখানকার বনাঞ্চল। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে সংরক্ষিত এ বনে প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এর সাথে যোগ হয়েছে স্থানীয় বনদস্যুরা।
সামুদ্রিক ভাঙন, জোয়ারের পানি বৃদ্ধি এবং বনদস্যুদের দৌরাত্ম্যে উজাড় হচ্ছে সৈকতের রক্ষাকবচ এ বন। এতে একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলবাসীর ঝুঁকি বাড়ছে। পরিবেশ প্রতিবেশের বিরূপ প্রভাবের পাশাপাশি বন বিভাগের উদাসীনতায় সবচেয়ে বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে গেছে বলে সেখানকার সাধারণ মানুষের দাবি। কুয়াকাটা বিট থেকে গঙ্গামতি লেকের দুই দিকে প্রায় ছয় কিলোমিটারজুড়ে হাজারো মরা গাছে সয়লাব হয়ে আছে। এসব গাছ আবার এখন একশ্রেণীর বনদস্যুরা কেটে সাবাড় করছে। যে হারে সংরক্ষিত বনের ম্যানগ্রোভ প্রজাতির প্রাচীন গাছগুলো মারা পড়ছে তাতে আগামী ১০ বছরে গোটা এলাকা বিরাণভূমিতে পরিণত হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলায় বন বিভাগের মোট আয়তন ১০ হাজার ১৭৭ দশমিক ১১ একর। এর মধ্যে সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে তিন হাজার ৯৭৮ দশমিক ৩৩ একর। যার মধ্যে কুয়াকাটা বিটে ১৯৩ একর। কুয়াকাটা ক্যাম্পের অধীন ১৮১৮ দশমিক ৯৩ একর। গঙ্গামতি ক্যাম্পে ১১২৮ একর। খাজুরা ক্যাম্পে ৩৪৬ দশমিক ৮৭ একর এবং ধুলাসার ক্যাম্পের অধীন ৪৬১ দশমিক ৫৩ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকার কথা। একসময় এখানকার দৃষ্টিনন্দন নারিকেল, তাল ও ঝাউবাগান পর্যটককে আকৃষ্ট করত। সাগরের অব্যাহত ভাঙনে নারিকেল ও তালবাগান ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকে নিয়মিত বনের গাছ মারা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে গত ১৭ বছরে ভাঙন ও প্রাকৃতিক কারণে প্রায় দুই হাজার একর বনাঞ্চল হারিয়ে গেছে। উজাড় হয়েছে দুই লক্ষাধিক গাছ।
সৈকতের প্রায় ২০ একর জায়গাজুড়ে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে মরা গাছ। এর বেশির ভাগই কেওড়া ও গেওয়া। গত কয়েক বছরে এখানে কমপক্ষে ১০ হাজার কেওড়াগাছ মারা গেছে।
বন বিভাগ ও পরিবেশকর্মীরা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে স্ফীত জোয়ারের পানির সাথে সৈকতের বালু জমা হচ্ছে গাছের শিকড়ে। এতে শ্বাসমূল ঢাকা পড়ায় কেওড়ার মতো গাছ মারা যাচ্ছে।
পটুয়াখালী বন বিভাগ ২০০৫-০৬ অর্থবছরে কুয়াকাটা সৈকতে ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ইকোপার্কও গড়ে তোলে। এ পার্কে পিকনিক শেড, দৃষ্টিনন্দন কাঠের ব্রিজ, কালভার্ট, মাটির রাস্তাসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। রোপণ করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির ৪২ হাজার গাছ। তবে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে এ পার্কের অসংখ্য গাছও বিলীন হয়েছে।
গঙ্গামতী এলাকার জেলে আবুল হোসেন বলেন, সৈকতের গাছগুলো বিভিন্ন সময় ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে আমাদের জানমাল রক্ষা করেছে। ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর থেকেই মূলত গাছ মারা যেতে শুরু করে। এখন আগের চেয়ে জোয়ারের পানি বেড়েছে। গাছের সংখ্যা কমতে থাকায় আমরা আতঙ্কে আছি।
ইউছুফ খাঁ নামের আরেকজন বলেন, সাগরের ঢেউয়ের কারণে গাছ মরছে। এর মধ্যেই আবার একশ্রেণীর লোকজন গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে আবার গাছে আগুন লাগিয়ে মেরে ফেলে। পরে সেই গাছ জ্বালানির জন্য কেটে নিয়ে যায়।
ঢাকা থেকে কুয়াকাটা-গঙ্গামতি ঘুরতে আসা হামিম বলেন, এই বনাঞ্চলের নৈসর্গিক সৌন্দর্য পর্যটককে আকৃষ্ট করে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে স্থানীয়দের জানমাল রক্ষা করে। বন রক্ষায় তাই সবার এগিয়ে আসা জরুরি।
বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে জানা যায়, ২০০৮-০৯ সালে শুধু গঙ্গামতী এলাকায় সাগরের কোল ঘেঁষে প্রায় ১০ হাজার আকাশমণি গাছ রোপণ করা হয়েছিল। জোয়ারের বালুর কারণে বেশ কিছু গাছ মারা গেলে স্থানীয় একটি চক্র মরা গাছসহ জীবিত গাছও কেটে নিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। এ নিয়ে গত দুই বছরে ২৫টির মতো মামলা হয়েছে।
পটুয়াখালী বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, কুয়াকাটা সৈকতে একসময় তিন হাজার ৩৮৭ একর বনভূমি থাকলেও এখন মাত্র ১ হাজার ৩০০ একর অবশিষ্ট আছে। বাকি প্রায় দুই হাজার একর বিলীন হয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, কয়েক বছরে অন্তত ১০ হাজার কেওড়া গাছসহ বিভিন্ন জাতের কয়েক হাজার গাছ হারিয়েছি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবই এর প্রধান কারণ। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, শ্বাসমূলে বালু ভরাট হওয়ায়ই মূলত গাছগুলো মারা যাচ্ছে। তবে কুয়াকাটায় বৃহৎ পরিসরে বনায়নের জন্য ‘সুফল’ নামে একটি নতুন প্রকল্প শিগগিরই শুরু হচ্ছে। এর আওতায় এখানে ব্যাপক বনায়ন করা হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা