১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মংলা মিরসরাইয়ে দ্রুত ইপিজেড চালু করতে চায় দিল্লি

-

মংলা ও মিরসরাইয়ে ভারতকে বাংলাদেশের দেয়া দু’টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (এসইজেড) কার্যক্রম দ্রুত চালু করতে চায় দিল্লি। পাশাপাশি নতুন সীমান্তহাট খোলা, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ানোর জন্য বাণিজ্য সুবিধা, সড়ক, রেল, বিমান এবং সামুদ্রিক যোগাযোগের উন্নতি করতেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। ভারত বাংলাদেশ যৌথ ইশতেহারে এমন অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়েছে।
ইশতেহারে জনগণের সমৃদ্ধির উন্নয়নে কাজ করার সঙ্কল্প এবং একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের জন্য আলোচনার প্রাথমিক সূচনাসহ একে অপরের সাথে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের সম্পর্ক জোরদার করার অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করা হয়েছে। দিল্লি মনে করে, বাণিজ্য অবকাঠামো নির্মাণের ফলে ভৌগোলিক নৈকট্যকে দুই দেশের জনগণের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগে রূপান্তর করতে পারে।
শেখ হাসিনার দিল্লি সফর শেষে প্রকাশিত যৌথ ইশতেহারে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে যৌথ নদী কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে তথ্য আদান-প্রদানকে অগ্রাধিকার প্রদান এবং অন্তর্বর্তীকালীন পানি বণ্টনের কাঠামো প্রণয়নে নিয়োজিত থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে। এ জন্য ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পুনর্নবীকরণের জন্য আলোচনা শুরু করার জন্য একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠনকে স্বাগত জানানো হয়েছে। আর এ কারণে উন্নয়ন সহযোগিতার অংশ হিসেবে, দুই দেশের পারস্পরিক সম্মতিতে ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বহুমুখী সংযোগের বিষয়ে অভিপ্রায় ব্যক্ত করে দুই নেতার যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছে, আমরা একটি রূপান্তরমূলক অংশীদারিত্ব অনুসরণ করব যা আমাদের ভৌগোলিক নৈকট্যকে নতুন অর্থনৈতিক সুযোগে রূপান্তর করে আমাদের উভয় দেশের পাশাপাশি সমগ্র অঞ্চলের জন্য ভাগ করা স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এর মধ্যে কানেক্টিভিটির বিস্তৃত অবয়বে অন্তর্ভুক্ত থাকবে ফিজিক্যাল কানেক্টিভিটি, যা মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট এবং ক্রস-বর্ডার বাণিজ্য ও ট্রানজিট অবকাঠামোকে সীমাহীন আন্তঃসীমান্ত মানুষ, পণ্য ও পরিষেবার চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করবে। সেইসাথে শক্তি সংযোগ ও ডিজিটাল সংযোগকে কভার করবে এটি।
ইশতেহারে বলা হয়, উপআঞ্চলিক সংযোগ উদ্যোগের অংশ হিসেবে, ভারত রেলওয়ে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রানজিট সুবিধা প্রসারিত করবে। উপআঞ্চলিক সংযোগ উন্নয়নের জন্য বিবিআইএন মোটর ভেহিক্যাল চুক্তির দ্রুত কার্যকরীকরণের জন্য প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয় ইশতেহারে। এই প্রেক্ষাপটে রেলওয়ে সংযোগে একটি নতুন এমওইউকে স্বাগত জানিয়ে বলা হয়, গেদে-দর্শনা থেকে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি হয়ে হাসিমারা হয়ে ডালগাঁও রেলহেড হয়ে ভারত-ভুটান সীমান্তে পণ্য-ট্রেন পরিষেবা চালু করার সিদ্ধান্ত ইতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসবে।
প্রসঙ্গত, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১-২২ জুন ভারতে রাষ্ট্রীয় সফর করেন। আর এর পরিপ্রেক্ষিতেই দুই দেশ যৌথ ইশতেহার প্রকাশ করে।
ইশতেহারে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারের বিষয়ে দিল্লি অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বলেছে, এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অংশ হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করা হবে। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকীকরণের পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য প্রতিরক্ষা শিল্পে সহযোগিতা অন্বেষণ করা হবে, যাতে প্রতিরক্ষার জন্য সক্ষমতা জোরদার করা যায়। ইশতেহারে বলা হয়েছে, আমরা আমাদের বহুমুখী সামরিক মহড়া, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ চালিয়ে যাবো।
উন্নয়ন অংশীদারিত্বের জন্য একটি নতুন ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি শেষ করার মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশ উন্নয়ন সহযোগিতাকে আরো জোরদার করার ইচ্ছা ব্যক্ত করে ইশতেহারে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্প ও কর্মসূচির আওতাকে প্রসারিত করা হবে। ইশতেহারে সিভিল সার্ভিস, জুডিশিয়াল অফিসার, পুলিশ এবং বাংলাদেশের অন্যান্য বিশেষায়িত পরিষেবাগুলোর জন্য আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির কর্মসূচি সম্প্রসারিত করতে একসাথে কাজ করার কথা বলা হয়।
একই সাথে ভাগ করা সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও প্রাণবন্ত জনগণের মধ্যে বন্ধনকে স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা, পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, পর্যটক, ছাত্র ও যুবকদের বিনিময় কর্মসূচির মাধ্যমে বিদ্যমান সংযোগগুলোকে লালন করার কথা বলা হয়। চিকিৎসা ও শিক্ষাগত সহায়তার জন্য নতুন কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রতি সহায়তার মাত্রা আরো বাড়ানো হবে বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি সহজতর আন্তঃসীমান্ত ভ্রমণের সুবিধার্থে এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য ভারতে চিকিৎসায় সে দেশ ভ্রমণকারী বাংলাদেশীদের জন্য ই-মেডিক্যাল ভিসা সুবিধা প্রসারিত করার কথা বলা হয়েছে। ইশতেহারে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের জনগণের জন্য দ্রুত কনসুলার ও ভিসা পরিষেবার সুবিধার্থে রংপুরে ভারতের একটি নতুন সহকারী হাইকমিশন খুলতে সম্মতি প্রকাশ করা হয়। প্রাপ্যতার ভিত্তিতে এবং তার সর্বোত্তম ক্ষমতার ভিত্তিতে, ভারত বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে সহায়তা করবে বলে ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়।
ইশতেহারে এ অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুরক্ষিত এবং নিয়মভিত্তিক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য রূপান্তরিত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবগুলোর জন্য এই অঞ্চলের দুর্বলতাকে স্বীকৃতি দিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক ওশান ইনিশিয়েটিভ (আইপিওআই) এর ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা’ স্তম্ভে যৌথভাবে নেতৃত্ব দেয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়। এ জন্য দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমিত করতে সহযোগিতা, দুর্যোগ প্রতিরোধী অবকাঠামো তৈরি এবং ভাগ করা সামুদ্রিক অঞ্চলের সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখতে অবদান রাখতে কাজ করার কথা ব্যক্ত করা হয়।
এতে বলা হয়েছে, বিস্তৃত দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার সাথে, বিমসটেক, সার্ক ও আইওআরএ স্থাপত্যের অধীনে আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক একীকরণের জন্য একটি প্রধান নোঙর হয়ে উঠতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়া হবে। দুই দেশ সাধারণ স্বার্থ, বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের স্বার্থের জন্য গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে একসাথে কাজ করবে।
যৌথ ইশতেহারে আগামী দিনে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সুবিধার ভিত্তিতে সম্পর্কটিকে আরো গভীর ও উচ্চ মানের সম্পর্কে নিয়ে যেতে অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতের জন্য এই ভাগ করা দৃষ্টিভঙ্গি দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বর্তমান অধ্যায়কে আরো বিকাশের মাধ্যমে ঐতিহাসিক বন্ধনকে শক্তিশালী করবে। সে সাথে একটি ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার জন্য এটি আরো অনুপ্রেরণা জোগাবে।
দুই দেশের সংযোগ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ইশতেহারে বলা হয়েছে, দুই দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সহযোগিতা প্রসারিত করা হবে এবং ভারতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটানে ক্লিন এনার্জি প্রকল্প থেকে উৎপাদিত প্রতিযোগিতামূলক-মূল্যের বিদ্যুৎসহ আন্তঃআঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্য গড়ে তোলা হবে। এই লক্ষ্যে, দুই দেশের গ্রিড সংযোগের জন্য নোঙর হিসেবে কাজ করার জন্য উপযুক্ত ভারতীয় আর্থিক সহায়তায় কাটিহার-পার্বতীপুর-বোরনগরের মধ্যে ৭৬৫ কেভি উচ্চক্ষমতার আন্তঃসংযোগ নির্মাণকে ত্বরান্বিত করা হবে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে ভবিষ্যৎভিত্তিক অংশীদারিত্বের একটি নতুন যুগে পরিচালিত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে ইশতেহারে বলা হয়েছে, এ জন্য আমরা আমাদের নিজ নিজ জাতীয় উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়নের জন্য একে অপরকে অপরিহার্য অংশীদার হিসাবে ‘ভিক্ষিত ভারত ২০৪৭’ এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১’ স্বীকৃতি দেই । ইশতেহারে বলা হয়, দ্রুত ক্রমবর্ধমান সক্ষমতার সাথে ঘনিষ্ঠ ও মূল্যবান প্রতিবেশী হিসেবে, বাংলাদেশ ভারতের ‘প্রতিবেশী ফার্স্ট’ নীতি, ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি, সাগর মতবাদ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে একটি অপরিহার্য আঞ্চলিক অংশীদার হবে। অন্য দিকে বাংলাদেশ সবচেয়ে কাছের ও বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সাথে তার সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। ভাগাভাগি শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য তার প্রতিবেশী বৈদেশিক নীতি অনুসরণে বাংলাদেশ ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করে।


আরো সংবাদ



premium cement