প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা রূপকল্প অনুমোদন
দিল্লিতে হাসিনা মোদি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক : ১০ চুক্তি ও সমঝোতা সই- কূটনৈতিক প্রতিবেদক
- ২৩ জুন ২০২৪, ০৩:০৭
নয়াদিল্লি সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারত একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে পথ দেখানোর জন্য ‘রূপকল্প ঘোষণা’ অনুমোদন করেছে। আমরা টেকসই ভবিষ্যতের জন্য ‘ডিজিটাল অংশীদারিত্ব’ ও ‘সবুজ অংশীদারিত্ব’ বিষয়ক দু’টি সমন্বিত রূপকল্পকে সামনে রেখে কাজ করতে সম্মত হয়েছি। দুই প্রতিবেশী দেশের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সম্পর্কের সার্বিক দিকের মধ্যে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের বিষয়টি উল্লেখযোগ্যভাবে আলোচনায় এসেছে।
অন্য দিকে শেখ হাসিনার সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তারা প্রতিরক্ষা উৎপাদনের আধুনিকীকরণ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা মোকাবেলার উপায় এবং সীমান্তে শান্তি নিশ্চিত করার পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করেছেন। নরেন্দ্র মোদি যারা বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য ভারতে পৌঁছান তাদের জন্য ই-মেডিক্যাল ভিসা পরিষেবা ঘোষণা করেছেন এবং বলেছেন যে উভয়পক্ষ অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছেন।
আলোচনা শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার এক্স প্রোফাইলে বলেছেন, ‘গত বছরে ভারত ও বাংলাদেশ অবকাঠামো, সংযোগ, বাণিজ্য ও জ্বালানির মতো খাতের উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র কভার করেছে। আমরা এখন সামনের দিকে তাকিয়ে আছি, সবুজ শক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তি ও মহাকাশের মতো ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি পানিসম্পদ, নিরাপত্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো বাড়ানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা পর্যালোচনা করেছি।’
গতকাল দিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে একান্ত এবং দ্বিপক্ষীয় বৈঠকসহ বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষরের পর গণমাধ্যমের সামনে দেয়া যৌথ বিবৃতিতে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার মাধ্যমে নতুন পথচলা শুরু হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা ‘রূপকল্প-২০৪১’ এর মাধ্যমে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ অনুসরণ নিশ্চিত করার জন্য ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছি।
রাষ্ট্রীয় সফরের দ্বিতীয় দিনে দিল্লির স্থানীয় সময় সকাল ৯টায় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে পৌঁছান শেখ হাসিনা। সেখানে আগে থেকে উপস্থিত ছিলেন দেশটির রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ভারত সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এরপর শেখ হাসিনাকে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা ও গার্ড অব অনার দেয়া হয়। সশস্ত্র সালাম গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন। পরে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদিকে লাইন অব প্রেজেন্টেশনে দুই দেশের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মসূচি শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে রাজঘাট যান। সেখানে তিনি মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর হায়দরাবাদ হাউজে শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেন।
শীর্ষ বৈঠকের পর দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ঢাকা ও দিল্লি ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে। নতুন সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত-বাংলাদেশ ডিজিটাল অংশীদারিত্বে অভিন্ন ভিশন, সবুজ অংশীদারিত্বে অভিন্ন ভিশন, সামুদ্রিক সহযোগিতা ও সমুদ্র অর্থনীতি, মহাকাশ খাতে সহযোগিতা, রেলওয়ে কানেকটিভিটি, ওশেনোগ্রাফি খাতে সহযোগিতা এবং সামরিক শিক্ষা খাতে সহযোগিতা। আর নবায়ন করা সমঝোতা স্মারকগুলো হচ্ছে, স্বাস্থ্য ও ওষুধ খাতে সহযোগিতা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এবং মৎস্য খাতে সহযোগিতা।
বৈঠকের পর বেশ কয়েকটি নতুন ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়া রোগীদের জন্য ই-ভিসা চালু, রংপুরে ভারতের নতুন সহকারী হাইকমিশন স্থাপন, রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন সার্ভিস, চট্টগ্রাম ও কলকাতার মধ্যে নতুন বাস সার্ভিস এবং গেদে-দর্শনা ও হলদিবাড়ী-চিলহাটি রুটে নতুন পণ্যবাহী ট্রেন চালু, ভারতীয় ঋণসহায়তায় সিরাজগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো স্থাপন, ভারতের গ্রিড লাইন ব্যবহার করে নেপাল থেকে বাংলাদেশে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে আলোচনার জন্য যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন, তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতের কারিগরি দলের বাংলাদেশ সফর ও ইন্দো-প্যাসেফিক ওশেন ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের যোগদান।
যৌথ বিবৃতিতে নরেন্দ্র মোদি বলেন, গত এক বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আমার ১০ বার সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে আজকের দিনটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বিজেপির নেতৃত্বে ভারত সরকার তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের প্রথম রাষ্ট্রীয় অতিথি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আমাদের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি, পূর্বমুখী নীতি, বিকশিত ভারত ২০৪৭ এবং ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে। এক বছরে আমরা দুই দেশের জনগণের কল্যাণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ চালু হয়েছে, খুলনার মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বঞ্চালীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহন শুরু হয়েছে, মংলা বন্দরকে রেলসংযোগের আওতায় আনা হয়েছে, এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের মৈত্রী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে গেছে, দুই দেশের মধ্যে ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদি বলেন, গঙ্গা নদী দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ রিভার ক্রুজ সফলভাবে পরিচালনা করা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে প্রথম আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি পাইপ লাইন স্থাপন সম্পন্ন হয়েছে এবং ভারতীয় গ্রিড লাইন ব্যবহার করে নেপাল থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। এক বছরে এতগুলো অর্জন আমাদের সম্পর্কের শক্তিশালী চেতনারই প্রতিফলন।
নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্ক সঙ্কেত ও সুপেয় পানি প্রকল্পে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা রয়েছে। তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতের একটি কারিগরি দল দ্রুত বাংলাদেশে যাবে। ১৯৯৬ সালের ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়ন করার জন্য কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা শুরু করার বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি। দুই দেশের ফোকাস হচ্ছে কানেকটিভিটি, বাণিজ্য এবং অন্যান্য সহযোগিতা। ১৯৬৫ সালের আগে রেলওয়ের যে কানেকটিভিটি ছিল, আমরা গত ১০ বছরের মধ্যে সেগুলো পুনঃস্থাপন করেছি।
ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজিক সম্পর্ক আরো বাড়ানোর জন্য দুই দেশ সেপা (কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হয়েছে বলে জানান মোদি।
শীর্ষ বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সম্মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া মধাহ্নভোজে যোগ দেন। এরপর তিনি ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখারের সাথে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুই দিনের দিল্লি সফর শেষ হয়। সাক্ষাতে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশংসা করেছেন। নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকালে তিনি এ মন্তব্য করেন। রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেছেন যে ভারত ও বাংলাদেশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে এবং নতুন নতুন খাতে প্রবেশ করছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি আত্মবিশ্বাস ব্যক্ত করেন যে এটি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত শুক্রবার দুপুরে বিশেষ ফ্লাইটে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী : ভারতে দুই দিনের সরকারি সফর শেষে দেশে ফিরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল শনিবার রাত ৮টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী ফ্লাইটটি হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।
এর আগে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে (বাংলাদেশ সময়) নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দর ত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট।
ভারতের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শ্রী কীর্তিবর্ধন সিং এবং ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো: মুস্তাফিজুর রহমান বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় জানান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা