বেড়েই চলেছে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ
- সৈয়দ সামসুজ্জামান নীপু
- ২৩ জুন ২০২৪, ০৩:০৬, আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:১৩
- পুঞ্জীভূত গ্যারান্টি ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৪ কোটি টাকা
- ব্যাংক গ্যারান্টির অর্ধেকই বিদ্যুৎ খাতে
সরকার কর্র্তৃক ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির কাছে সরকার প্রদত্ত পুঞ্জীভূত ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে সরকারের পুঞ্জীভূত ব্যাংক গ্যারান্টির স্থিতি ছিল ৯৮ হাজার ৫৯১ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির স্থিতি বেড়েছে ১৮ হাজার ৫০২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। যার পরিমাণ ৫৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এখানে আবার অভ্যন্তরীণ ঋণের চেয়ে বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করতে হয়েছে সরকারকে।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের দেশী-বিদেশী ঋণের বিপরীতে সরকার এই ব্যাংক গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। এখানে বলা থাকে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হলে সরকারের পক্ষ থেকে তা পরিশোধ করা হবে। এটি সরকারের একটি প্রচ্ছন্ন দায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
জানা গেছে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সার আমদানি, বাংলাদেশ বিমানের জন্য বোয়িং ক্রয়, জ্বালানি তেল আমদানি, কৃষি ঋণ বিতরণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থা দেশী-বিদেশী ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দাতাসংস্থার কাছ থেকে ২০০৪ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে এসব ঋণ নিয়েছে। এর বিপরীতে সরকারকে ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদান করতে হয়েছে।
ব্যাংক গ্যারান্টির খাতওয়ারি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদানের শীর্ষে রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এ খাতের ১৭টি প্রকল্পের বিপরীতে মোট পুঞ্জীভূত গ্যারান্টির স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৫৯৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। গত অর্থবছর (২০২২-২৩) শেষে এ খাতে মোট পুঞ্জীভূত গ্যারান্টির স্থিতি ছিল ৫১ হাজার ৪৯৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, একক প্রকল্প হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ‘এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র ঋণে বাস্তবায়নাধীন ‘মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার’ প্রকল্পে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ১৬ হাজার ৮১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা (২০২৩ সালের জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার ৮২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা)।
বিদ্যুৎ খাতে গ্যারান্টির দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে- ‘পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট’। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ‘বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’। এই প্ল্যান্ট তৈরির জন্য ‘এক্সিম ব্যাংক অব চায়না’র কাছ থেকে ঋণ নেয়া হয়েছে। এই ঋণের ৫০ ভাগের বিপরীতে সরকার গ্যারান্টি প্রদান করেছে। গ্যারান্টির পরিমাণ হচ্ছে- ১৬ হাজার ৪০৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা (২০২৩ সালের জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৯০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা)।
তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে- রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ও নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন পটুয়াখালি ১,৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ৭ হাজার ১৫৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা (২০২৩ সালের জুন শেষে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬০০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা)। ‘এক্সিম ব্যাংক অব চায়না’র কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে- ‘খুলনা ৩৩০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নে ‘এক্সিম ব্যাংক অব চায়না’কে ২ হাজার ৮৫৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা; ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড’ কর্তৃক ‘বিবিয়ানা-১১১-৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন’কে ১ হাজার ৩৭৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা; ‘ঘোড়াশাল ৩য় ইউনিট রি-পাওয়ার প্রকল্প’ বাস্তবায়নে এইচএসবিসি ব্যাংককে ১ হাজার ২৭১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা; নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড’ কর্তৃক ‘সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট (৩য় ইউনিট-ডুয়েল-ফুয়েল) প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক’কে ১ হাজার ২৪৭ কোটি ৪ লাখ টাকা; ‘ঘোড়াশাল ৩৬৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘আইসিবিসি ব্যাংক চায়না’কে ১ হাজার ৯৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং বড় পুকুরিয়া ২৭৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্প্রসারণ (৩য় ইউনিট) প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘আইসিবিসি ব্যাংক চায়না’কে ১ হাজার ২১ কোটি ৪১ লাখ টাকার গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।
অন্যান্য খাতের মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংক গ্যারান্টির দ্বিতীয় শীর্ষ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। সার আমদানির বিপরীতে এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে গ্যারান্টির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে বিএডিসির পক্ষে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংককে প্রদত্ত গ্যারান্টির স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৯৮৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ১৬৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
অন্যান্যের মধ্যে ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপানের জেবিআইসি ও এমইউএফজি এবং হংকং-এর এইচএসবিসি ব্যাংককে ১০ হাজার ১১৩ কোটি টাকা; বিসিআইসি কর্তৃক ইউরিয়া সার আমদানির জন্য চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে (সোনালী ব্যাংককে ৪,৮০১.৫৭ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংককে ১,৬১৬.৫৮ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংককে ১,১৩৬.৪০ কোটি টাকা ও কৃষি ব্যাংককে ১,৪৩৩.৯০ কোটি টাকা) মোট ৮ হাজার ৯৮৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা; পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ¦ালানি তেল আমদানির লক্ষ্যে বিপিসির অনুকূলে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৭ হাজার ৬৬০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। উড়োজাহাজ ক্রয়সহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ বিমানকে ১৭টি গ্যারান্টির বিপরীতে মোট ৭ হাজার ৩৯৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা; কৃষি ঋণ প্রদানে বিকেবি ও রাকাবকে ৩ হাজার ৫৭৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা এবং নিত্যপণ্য ক্রয়ের জন্য টিসিবির অনুকূলে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী/রূপালী ব্যাংককে ২ হাজার ৪৩২ কোটি ১১ লাখ টাকা গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।
এ দিকে, অর্থ বিভাগের প্রকাশিত সর্বশেষ যেটা বুলেটিন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারের মোট আর্থিক গ্যারান্টির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ লাখ ২ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎসের গ্যারান্টির পরিমাণ ৬৭ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎসের গ্যারান্টির পরিমাণ ৩৪ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ উৎসের তুলনায় বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সরকারের গ্যারান্টির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা