১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইসরাইলকে হিজবুল্লাহর সাথে সঙ্ঘাত এড়ানোর পরামর্শ ব্লিনকেনের

-

- গাজায় ইসরাইলি সেনা নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১৪
- অস্ত্রচালানের বিষয়ে ইসরাইলের সমালোচনায় হতাশ যুক্তরাষ্ট্র
- বিনিয়োগ সংস্থাগুলোকে জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা

লেবাননের রাজনৈতিক সংগঠন হিজবুল্লাহর সাথে বড় ধরনের সঙ্ঘাত এড়াতে ইসরাইলকে পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন। লেবাননে হামলা করলে তেলআবিবকে ঝাঁঝরা করে দেয়া হবে বলে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ হুমকি দেয়ার পর বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ইসরাইলি কর্মকর্তাদের এ পরামর্শ দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এদিকে হামাসের অভিযানে আরো দুই ইসরাইলি সৈন্য নিহত হওয়ায় গাজা যুদ্ধে ইসরাইলের নিহত সৈন্যের সংখ্যা বেড়ে ৩১৪-এ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে অস্তিত্বের লড়াইয়ে মার্কিন গোলাবারুদ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। অথচ বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলে অস্ত্রের চালান বিলম্বিত করছে। নেতানিয়াহুর এমন মন্তব্যে হতাশা প্রকাশ করেছে বাইডেন সরকার। এতে ঘনিষ্ঠতম মিত্র দেশটির সাথে ইসরাইলের বিরল টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে ইসরাইলের ক্ষমতাসীন সরকারের। রয়টার্স ও আলজাজিরা।

রয়টার্সের খবরে বলা হয়, চলমান গাজা যুদ্ধের মধ্যে হিজবুল্লাহর সাথে সংঘাত যাতে আর না বাড়ে, তা ঠেকানোর প্রয়োজনীয়তার কথা ইসরাইলি কর্মকর্তাদের কাছে তুলে ধরেন ব্লিনকেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জাচি হানেগবি ও কৌশলগত বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রী রন ডারমারের সাথে এ বৈঠক করেন ব্লিঙ্কেন। ইসরাইল লেবাননে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালালে জবাবে ‘সর্বাত্মক’ হামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরাল্লাহ। গত বুধবার টেলিভিশনে দেয়া ভাষণে তিনি এ হুঁশিয়ারি দেন। হাসান নাসরাল্লাহ বলেন, লেবাননে ইসরাইল হামলা চালালে কোনো নিয়মনীতি মানবে না হিজবুল্লাহ। কোনো ধরনের সংযমও দেখাবে না তারা। হিজবুল্লাহপ্রধানের এ হুমকির পরই ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সাথে ব্লিনকেনের বৈঠকটি হলো। বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়, ইসরাইলের সেনাবাহিনী গত মঙ্গলবার ঘোষণা দিয়েছে, তারা লেবাননে সামরিক অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছে।

গাজায় ইসরাইলি সেনা নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১৪
এদিকে গাজার কেন্দ্রে অবস্থিত গাজা সিটিতে হামাসের মর্টার হামলায় দুই ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছেন। যার ফলে গাজায় চলমান সঙ্ঘাতে নিহত ইসরাইলি সেনার সংখ্যা বেড়ে ৩১৪ হয়েছে। টাইমস অব ইসরাইল জানিয়েছে, নিহত ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) সেনারা হলেন সার্জেন্ট ফার্স্ট ক্লাস ওমর স্মাগদা (২৫)। তিনি গানোত হাদার এলাকার বাসিন্দা ছিলেন এবং আলেক্সান্দ্রোনি ব্রিগেডের ৯ হাজার ২০৩তম ব্যাটালিয়নের সদস্য ছিলেন। অপর নিহত সেনা হলেন তেলআবিবের বাসিন্দা সার্জেন্ট ফার্স্টক্লাস সাদিয়া ইয়াকভ দেরাই (২৭)। তিনিও একই ব্রিগেড ও ব্যাটালিয়নের সদস্য। ওমর ও ইয়াকভ উভয়ই এই ব্যাটালিয়নের ‘রিজার্ভ সেনা’ ছিলেন বলে জানিয়েছে আইডিএফ। আলেক্সান্দ্রোনি ব্রিগেডের আরো তিন সেনা এই হামলায় গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার হামাস এই হামলার দায় নিয়েছে। গাজা সিটির জেইতুন মহল্লায় ইসরাইলি সামরিক অবস্থানকে লক্ষ করে তারা মর্টার হামলা চালায়। এই দুই সেনার মৃত্যুতে হামাসের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে নিহত ইসরাইলি সেনার সংখ্যা বেড়ে ৩১৪ হয়েছে। নিহতদের মধ্যে একজন পুলিশ কর্মকর্তাও আছেন, যিনি বন্দী উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়ার সময় নিহত হন। তবে ইসরাইলি হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৪৩১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮৫ হাজার ৬৫৩ জন। নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
কোনো ধরনের অর্জন ছাড়াই পার হলো গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি আগ্রাসনের ৯ মাস। উল্টো তেল আবিবের জন্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ এবং সেনাদের রক্ষণাবেক্ষণে সঙ্কটের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি ইসরাইলের চ্যানেল সেভেন জানিয়েছে, গত ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৬৬৩ জন আহতসহ ইসরাইলি সেনাবাহিনীতে পঙ্গু সদস্যের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে। চ্যানেলটি আরো জানায়, এদের মধ্যে শতকরা ৩৫ ভাগ সেনা ৭ অক্টোবরের পর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে এবং শতকরা ২১ ভাগ সেনা শারীরিকভাবে মারাত্মক আহত হয়ে চিকিৎসাধীন। ইসরাইল সরকারের যুদ্ধ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ আরো প্রায় ২০ হাজার নতুন আহত সেনা সদস্যকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা।

অস্ত্রচালানের বিষয়ে ইসরাইলের সমালোচনায় হতাশ যুক্তরাষ্ট্র
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তার দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ করার বিষয়ে সম্প্রতি যে সমালোচনা করেছেন তাতে হোয়াইট হাউজ অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। একই সাথে নেতানিয়াহুর বিবৃতিকে বিরক্তিকর বলে অভিহিত করেছে হোয়াইট হাউজ।
ভয়েস অব আমেরিকা জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ওই মন্তব্যগুলো ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক এবং আমরা যে পরিমাণ সমর্থন তাদের দিয়েছি এবং দেবো তার প্রেক্ষাপটে এটা ছিল অত্যন্ত বিরক্তিকর বিবৃতি।’ মঙ্গলবার প্রকাশিত একটি ভিডিও বিবৃতিতে নেতানিয়াহু বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে ইসরাইলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে তিনি যদিও কৃতজ্ঞ। তবে এটা ধারণার বাইরে যে গত কয়েক মাস (যুক্তরাষ্ট্রের) প্রশাসন ইসরাইলেকে অস্ত্রশস্ত্র এবং সাজসরঞ্জাম দিচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য বলেছে, ৯০০ কিলোগ্রাম ও ২০০ কিলোগ্রাম ওজনের বোমা সম্বলিত একটি মাত্র চালান এমন উদ্বেগের কারণে বিরতি দেয়া হয়েছে যে এগুলো গাজার জনঅধ্যুষিত এলাকায় কিভাবে ব্যবহার করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইসরাইল আরো কয়েক বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ইতোমধ্যেই বৃহস্পতিবার জাতিসঙ্ঘের ৩০ জন বিশেষজ্ঞ সম্বলিত একটি দল সতর্ক করে দিয়েছে যে অস্ত্র-শস্ত্রের যেসব নির্মাতা ইসরাইলকে অস্ত্র দেয়া অব্যাহত রাখবে তারা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনলঙ্ঘনে যুক্ত বলে মনে করা হতে পারে। কিরবি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার অসন্তুষ্টির কথা সরাসরি ইসরাইলকে জানিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় ওই ভিডিওতে দেয়া বিবৃতি এবং বিবৃতির শুদ্ধতা সম্পর্কে আমরা আমাদের হতাশার কথা নানান মাধ্যমে ইসরাইলকে যথেষ্ট পরিষ্কার করে জানিয়েছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই ধারণা যে আত্মরক্ষার ব্যাপারে ইসরাইলকে সাহায্য করা আমরা কোনোভাবে বন্ধ করে দিয়েছি, তা কোনোমতেই ঠিক নয়।’ হোয়াইট হাউজের এই মন্তব্যগুলো এমন এক সময়ে এলো যখন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন গাজায় চলমান যুদ্ধ নিয়ে নেতানিয়াহুর দু’জন শীর্ষ সহযোগীর সাথে বৈঠক করার পরিকল্পনা করেছেন।

গাজায় ইসরাইলের কারাগার থেকে ৩৩ ফিলিস্তিনির মুক্তি
ইসরাইলি সেনাবাহিনী বৃহস্পতিবার গাজা উপত্যকা থেকে ৩৩ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। গাজার একটি হাসপাতালের সূত্রের বরাতে খবরটি দিয়েছে তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি। সূত্রটি বলেছে, মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনিদের শরীর অপুষ্ট এবং নির্যাতনের অনেক চিহ্ন আছে। তাদের আল-আকসা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বন্দীদের মুক্তির পর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস বলেছে, ইসরাইলের কারাগারে ভয়াবহ নির্যাতনের সাক্ষ্য নিয়ে এসেছেন বন্দীরা। হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, সেদে তেমান ডিটেনশন সেন্টার থেকে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেয়া হয়েছিল। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বন্দীদের আটক রাখা হয়েছিল সেখানে। গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের দখলদাররা ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক তুলে নিয়ে সেখানে আটক রাখত। গাজা মিডিয়া অফিস বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলি বাহিনীর হাতে আটক অন্তত ৩৬ ফিলিস্তিনি বন্দী ইসরাইলি কারাগারে কঠোর নির্যাতনের কারণে মারা গেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী কর্তৃক মুক্তি পাওয়া কয়েক ডজন বন্দী আটক অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহারের বর্ণনা দিয়েছেন। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গাজায় এখনো গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। আন্তর্জাতিক নিন্দার পরোয়াও করছে না নেতানিয়াহু সরকার। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মতে, ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৭ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু এবং ৮৫ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

বিনিয়োগ সংস্থাগুলোকে জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা
ইসরাইলি বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহে আইনি ঝুঁকির বিষয়ে অস্ত্র প্রস্তুতকারক ও বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলোকে সতর্ক করেছেন জাতিসঙ্ঘের একদল বিশেষজ্ঞ। গাজায় হামলা নিয়ে ইসরাইল যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের মুখোমুখি হওয়ার প্রেক্ষাপটে এ সতর্ক বার্তা দিলেন তারা। গতকাল শুক্রবার আল-জাজিরার এক খবরে বলা হয়েছে, জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞদের স্বাধীন একটি গ্রুপ বলেছে, ‘ইসরাইলের কাছে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয়, হস্তান্তর এবং স্থানান্তর’ বন্ধ করতে হবে। কারণ, অস্ত্র প্রস্তুতকারকদের বিনিয়োগকারী ব্যাংক ও বিনিয়োগ কোম্পানিগুলোও আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বিচারের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক নীতির গুরুতর লঙ্ঘনের সাথে জড়িত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহকারী অস্ত্র-প্রস্তুতকারকদের আর্থিক বিনিয়োগকারীদেরও অবশ্যই ‘হিসাব নেয়া’ হবে। এক বিবৃতিতে তারা বলেন, এসব অস্ত্র-প্রস্তুতকারকের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক বন্ধ রাখতে ব্যর্থ হলে তা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নৃশংস অপরাধ সংঘটনের সাথে সরাসরি যুক্ত হওয়া বা অবদান রাখা হিসেবে গণ্য হতে পারে। বৈশ্বিক বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক অব আমেরিকা, সিটিগ্রুপ, জেপি মরগান চেজ, মরগান স্ট্যানলি, নরজেস ব্যাংক ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ওয়েলস ফার্গো অ্যান্ড কোম্পানি।


আরো সংবাদ



premium cement