চরম দুর্দশায় বানভাসিরা
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২১ জুন ২০২৪, ০২:৫১
- পানিবন্দী সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের লাখ লাখ মানুষ
- উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব নদীর পানি বিপদসীমার উপরে
- ভারী বৃষ্টিপাতে বাড়বে বন্যার পরিধি
- পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
- বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় সব নদীর পানিই বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এবং এসব উঞ্চলের উজানে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। ফলে আরো দুই দিন এই অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে এবং একই সাথে সার্বিকভাবে বাড়তে পারে বন্যার পরিধি। বিশেষ করে সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে বয়ে চলা নদীগুলোর তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যার পরিস্থিতির অবনতি ঘটার পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। তবে আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোনা জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে ও সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অপরদিকে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু-খোয়াই নদীসংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের চলমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে বন্যার সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে। চরম দুর্দশায় পড়েছে সিলেট ও ময়মনসিংহের বানভাসিরা। ভারী বৃষ্টির কারণে এ দুই বিভাগে ঢলের পানি কমছে না।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অর্থাৎ সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে বয়ে চলা ৬ নদী ১১ পয়েন্টে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে কানাইঘাটে সুরমায় ১১ সেন্টিমিটার পানি কমলে নদীতে গতকাল পর্যন্ত ৮০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। অন্যদিকে এই সুরমা নদীই সিলেট পয়েন্টে ২৯ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জ পয়েন্টে বিপদ সীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর পানি সাময়িকভাবে হ্রাস পেলেও ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে আবারো এই নদীর পানি বৃদ্ধি পাবে এবং এই নদীর তীরবর্তী বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ছাড়া কুশিয়ারা অমলশীদে ৮৭ সেন্টিমিটার, শেওলায় ৪২ সেন্টিমিটার, শেরপুর-সিলেটে ১৯ সেন্টিমিটার, মালকুলিতে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট বিভাগের মনু নদী মৌলভীবাজার পয়েন্টে ৪১ সেন্টিমিটার, খোয়াই নদী বল্লাহ পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার, পুরাতন সুরমা নদী দিরাই পয়েন্টে বিপদ সীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোনার সৌমেশ্বরী নদী কমলাকান্দা পয়েন্টে বিপদ সীমার ৪৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এসব পয়েন্টে নদীগুলো দুই তীরে ইতোমধ্যে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
ইতোমধ্যে দেশের বড় প্রায় সবগুলো নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি আগামী ২ থেকে ৩ দিন বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। সংস্থাটি বলছে, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর কিছু পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। ইতোমধ্যে রংপুর বিভাগের আরেক খরস্রোতা ও শক্তিশালী নদী তিস্তা বিপদ সীমা অতিক্রম করেছে এবং নদীটি ইতোমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও রংপুর জেলায় কিছু কিছু অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে বিপদ সীমা অতিক্রম করতে পারে কিছু সময়ের জন্য। পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভাষায় তিস্তা ডালিয়া পয়েন্টে স্বল্প মেয়াদে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড পর্যবেক্ষণ করে এমন নদীগুলোর ১১০ স্টেশনের মধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত ৭৪ স্টেশনে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এই ভরা বর্ষার মধ্যেই গতকাল ৩৪ নদীর পানি কমেছে। গতকাল বিপদ সীমার উপর দিয়ে বয়ে চলা স্টেশন সংখ্যা ছিল ১২টি।
সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে বৃষ্টি কিছুটা কমলেও এখনো দুটি নদীর ছয়টি পয়েন্টের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। বাড়িঘরে থাকতে না পেরে আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটছেন মানুষ।
জেলা প্রশাসনের হিসেবে সিলেট জেলায় প্রায় ৯ লাখ ৫৮ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। বাড়িঘরে পানি উঠে পড়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন প্রায় ২২ হাজার মানুষ। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ১৩ উপজেলা ও সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ অবস্থা জানিয়েছে সিলেটের জেলা প্রশাসন। জেলার ৬৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার ৭৮৬ জন আশ্রয় নিয়েছেন। জেলায় বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন ৯ লাখ ৫৭ হাজার ৪৪৮ জন। এর মধ্যে ওসমানীনগরে ১ লাখ ৮৫ হাজার ও গোয়াইনঘাটে ১ লাখ ৪৫ হাজার ২০০ মানুষের অবস্থা বেশি খারাপ। জেলার ১৫৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৩০টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০২টি গ্রাম বন্যায় প্লাবিত। আর সিটি করপোরেশনের ২৩টি ওয়ার্ডে বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা ৫৫ হাজার।
সিলেট আবহাওয়া অফিস বলছে, সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় ১১০.২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর সকাল ৬টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ২০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে আগামী ৭২ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জে পাঁচ দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গত রাতে আকাশে চাঁদ উঁকি দিলেও শেষ রাতে মুশলধারে বৃষ্টি হয়েছে। শহরের পানির কিছুটা কমলেও শহরতলীর আশপাশে অধিকাংশ এলাকায় পানি স্থিতিশীল রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনে সূর্যের আলোর ঝিলিকে কিছুটা আশা সঞ্চার হয়েছে গৃহবন্দী লাখো মানুষের। পৌর শহরের বেশ কিছু জায়গায় পানি কমলেও শহরতলীর আশপাশে অধিকাংশ এলাকায় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এতে ঘরবন্দী লোকজন পড়েছেন বেকায়দায়। জেলার কন্ট্রোলরুম থেকে জানা গেছে, জেলার ১২ উপজেলায় প্রায়-৬ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছে।
এদিকে, সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার কারণ ইটনা-মিঠামইন সড়ক, এ সড়ক নির্মাণে কোনো হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে হয়নি। বৃহদাকার কোনো নির্মাণ প্রজেক্ট করার আগে নদীর পানি প্রবাহ,পানির উৎস, বৃষ্টির পানি, হাওরের পানির উপর এর কী প্রভাব পড়বে এসব সার্ভে করতে হয় উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুনামগঞ্জের হাজার হাজার লোকজন দাবি করেন। পর পর বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে ২৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ইটনা-মিঠামইন সড়কটি। যার প্রবল বাধার কারণে জেলার প্রধান নদী সুরমা কালনী ও কুশিয়ারার পানি মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হতে পারে না।
বানের পানিতে ভেসে গেছে খামারের মাছ। আউশ, আমন, ইরি ধানী মাঠ পানির নিচে। নলকূপ নিমজ্জিত থাকায় বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গো-খাদ্যের অভাবে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গন, মসজিদ, মন্দির ও কবরস্থান প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি ও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বানভাসিদের। রাস্তাঘাটের পাশাপাশি বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। অনেক জায়গায় রান্নাঘরের চুলা-নলকূপও ডুবেছে। বন্যায় পানিবন্দী অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন জেলার লাখো মানুষ।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত, বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ভোর পর্যন্ত জেলার প্রধান নদী সুরমা,কালনী, কুশিয়ারা ও জাদুকাটা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, বুধবার বিকেল ২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পানি স্থির রয়েছে। প্রথম দিকে জেলার ৩টি উপজেলা বন্যাকবলিত হলেও এখন সারা জেলার ১২টি উপজেলা ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মামুন হাওলাদার বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ছাতক উপজেলায় ১৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় ভারতের মেঘালয়, আসাম ও চেরাপুঞ্জিসহ সীমান্তে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে পারে।
দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বেশির ভাগ গ্রামীণ সড়কই এখন বন্যার পানিতে প্লাবিত। কোনো কোনো সড়কে ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি পানির স্রোতে ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার পানি ঢুকেছে মানুষের ঘরবাড়ি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মানুষের বসতঘরে পানি ঢোকায় বিপাকে পড়েছেন তারা। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। আবার কেউ কেউ যাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
গত সোমবার সকাল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বর্ষা আসলেই চোখে ভাসে’ ২০২২ সালের সেই ভয়ঙ্কর বন্যা, তাই ঈদের দিনটি নিয়েই ছিল ভয় বেশি। মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দের চেয়ে আত্মরক্ষার চিন্তাই কাজ করছে বেশি। তিনি জানান, বোগলাবাজার ও লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা সদর পর্যন্ত সব কয়টি চলাচলের রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথায়ও হাঁটু, কোথাওবা তার চেয়ে বেশি পানি। কোথাও কোথাও পানির স্রোতে রাস্তা ভেঙে যাওয়ায় সেখানে নৌকায় যাতায়াত করছেন লোকজন।
লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ওমরগনি বলেন, চলতি বন্যায় লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চলাচলের রাস্তা ও বসতঘরের বেশি ক্ষতি হয়েছে। ঈদের আগের দিনেই রাস্তাঘাট ভেঙে বসতঘরে পানি ডুকে সর্বস্ব ভাসিয়ে ঈদ আনন্দ মাটি করে দিয়েছে। এখনো পানি বেশি। দোকানপাটে পানি ঢোকায় সেগুলো বন্ধ। রাত থেকে পানি স্থির হয়ে আছে।
দোহালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামিমুল ইসলাম শামিম বলেন, এলাকার সব সরকারি-বেসরকারি স্কুল খুলে দেয়া হয়েছে মানুষ আশ্রয় নেয়ার জন্য।
উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম জানান, এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়িতে পানি। গতকাল মঙ্গলবার থেকে লোকজন এলাকার স্কুল ও মাদরসায় আশ্রয় নিয়েছেন। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় দোয়ারাবাজার উপজেলায় বৃষ্টিপাত কম হলেও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে টানা বর্ষণের ফলে পাহাড়ি ঢলের কারণে নদনদীর পানি কমার সুযোগ পায়নি।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মামুন হাওলাদার দুপুরে বলেন, সুনামগঞ্জে গত ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় পানি কিছুটা কমলেও উজানে বৃষ্টিপাত হওয়ায় পানি বেড়েছে। যদি উজানে বেশি বৃষ্টি হয়, তাহলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।
ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সুরমা নদীসহ নদনদীর পানি বিপদসীমার ওপর প্রবাহিত হয়ে ধর্মপাশা-মধ্যনগর এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ইউপি কমপ্লেক্সসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের উদ্যোগে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
টানা চার দিনের বৃষ্টি ও ভারতের মেঘালয় ও মাটিয়ান পাহাড়ের ঢলের পানি সুরমা ও সুমেশ^রী নদী দিয়ে বিপদসীমায় প্রবাহিত হয়ে ধর্মপাশা ও নবগঠিত মধ্যনগর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। গ্রামীণ সংযোগ কাঁচা, পাকা সড়কগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ধর্মপাশা ও নবগঠিত মধ্যনগর এ দুই উপজেলায় ১০টি গ্রাম রয়েছে। এর মধ্যে মধ্যনগর বাজার হতে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে উত্তর বংশীকুণ্ডা ইউনিয়নের (মহেষখলা সড়ক) ৩০ কিলোমিটার। ওই সড়কটি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। জয়শ্রী ইউনিয়নের জয়শ্রী বাজার হতে চামরদানী ইউনিয়নের সোলেমানপুর গ্রাম পর্যন্ত স্থানীয় সরকার এলজিইডির অর্থায়নে প্রায় ১৫ কিলোমিটার সাবমার্সিবল পাকা সড়ক তলিয়ে গেছে।
ধর্মপাশা উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান শামীম আহমেদ মুরাদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার গিয়াস উদ্দিন ও উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নেতৃত্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যদের নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গৃহবন্দী পরিবারগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে তাদের মধ্যে শুকনো খাবার ও খিচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে বলে প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের শ্যামেরকোনা গ্রামে মনু নদী ডুবে এক শিশু ও এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে এ ঘটনাটি ঘটে। নিহতরা হলেন পশ্চিম শ্যামেরকোনা গ্রামের জমির মিয়ার ছেলে হৃদয়-(১৫) ও পছন মিয়ার ছেলে ছাইম (১০)।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে ছাইম ও তার এক বন্ধু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মনু নদীর স্রোতে পানিতে ভেসে যায় তারা। এ সময় তাদের বাঁচানোর জন্য এগিয়ে যান নিহত হৃদয়। সে একজনকে উদ্ধার করে। কিন্তু দ্বিতীয়জন ছাইমকে উদ্ধার করতে গিয়ে হৃদয় নিজেই ডুবে যান। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার দু’জনকে মৃত বলে ঘোষণা দেন।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার নাসরিন চৌধুরী বলেন, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের পশ্চিম শ্যামেরকোনা এলাকায় বন্যার পানিতে ভেসে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দু’জনের পরিবারকে ২৫ হাজার করে ৫০ হাজার টাকার অনুদান প্রদান করা হয়েছে।
কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) সংবাদদাতা জানান, মৗলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও কুলাউড়া পৌরসভার বৃহৎ অংশ ঈদের দিন থেকে বন্যায় প্লাবিত হয়ে গত ৪ দিনে কমপক্ষে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বৃষ্টি না হলেও উজানের পানিতে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। পৌর এলাকার মাগুরার বাসিন্দারা জানান, বন্যার পানির যে অবস্থা, ২০২২ সালের বন্যার ন্যায় জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। পৌর এলাকার উত্তর মাগুরা, উপজেলা টিটিডিসি এরিয়া, সাদেকপুর, আহমদাবাদ, বিহালা, সোনাপুর, হাসপাতাল এরিয়া ঘুরে দেখা গেছে, সব কয়টি সড়কে কোমর পানি। মানুষ একেবারে পানিবন্দী। ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। নৌকায় আহমদাবাদ ও রাবেয়া স্কুল থেকে চলাচল করলেও তা খুবই সংখ্যায় কম। বাসার মানুষজন ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। অনেকে বাধ্য হয়ে কোমর সমান পানি পেরিয়ে বাজার সদাইয়ের জন্য বের হচ্ছেন। এক কথায় পৌরবাসীকে চরম বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে বন্যা। এ ছাড়াও উপজেলার ৬ ইউনিয়নে বন্যায় লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ত্রাণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, হাকালুকি হাওর এলাকার ভুকশিমইল ইউনিয়নের ৩৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এছাড়াও জয়চন্ডি ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের ১৫ হাজার, পৌর সভার ১২টি গ্রামের ২০ হাজার, সদর ইউনিয়নের দুটি গ্রামের ২ হাজার, ব্রাহ্মণবাজারের ১০টি গ্রামের ১৫ হাজার, কাদিপুরের ২০ হাজার, ভাটেরা ও বরমচাল ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
আগাম বন্যা থেকে রক্ষা পেতে সুরমা নদী ড্রেজিং করা হবে : পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী
বাসস জানায়, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেছেন, ‘সিলেট নগরকে আগাম বন্যা থেকে রক্ষায় সুরমা নদী খনন করা হবে।’ তিনি গতকাল সকালে সিলেট সিটি করপোরেশনের টুকেরবাজার এলাকায় শাদীখাল পরিদর্শনকালে এ কথা বলেন।
প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আসা ঢলের পানি বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত হয়। এ কারণে সিলেট অঞ্চলে যুগ যুগ ধরে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে। পলিমাটিতে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। তাই পানি উপচে শহরেও প্রবেশ করছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণে দেশের ৯টি স্থানে নদীতে ড্রেজিং স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘নদীতে পলিমাটি থাকায় এর আগেও ড্রেজিং কাজ ব্যাহত হয়েছিল। উজান থেকে আসা পানির সাথে পলিমাটিও আসে। সে পলিমাটি নদীর স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। প্রকৌশলীদের সাথে আলাপ করেছি দ্রুত সুরমা নদী ড্রেজিং ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ একই সাথে নদী ভাঙন, পলিমাটি অপসারণে নিয়মিত নদী খনন করা হবে।
জাহিদ ফারুক আরো বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের মিঠামইন সড়ক দিয়ে পানি দ্রুত প্রবাহের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সরকার।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আমাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আমরা আগাম বন্যা পরিস্থিতি রুখতে সুরমা নদী খননের ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’ এ সময় সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো: আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা, সিলেট জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা