১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

গরিবের হক সিন্ডিকেটের পকেটে

বিনামূল্যে চামড়া নেয়ার লোক মিলেনি বহু স্থানে : ক্ষতিগ্রস্ত মাদরাসা ও এতিমখানা
দাম না পাওয়ায় গরুর চামড়া ও এর অংশবিশেষ রাস্তার পাশে ফেলে দেয়া হচ্ছে। রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকার ছবি : নয়া দিগন্ত -


গরিবের হক কোরবানির পশুর চামড়া সরকার নির্ধারিতমূল্য তো দূরের কথা নামমাত্র দামেও এবার বিক্রি হয়নি বহু স্থানে। শহরাঞ্চলে কিছু কিছু বিক্রি হলেও গ্রামে গঞ্জে বিনামূল্যে চামড়া নেয়ার লোকও পাওয়া যায়নি। ক্রেতার দেখা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকে বিভিন্ন মাদরাসার সংগ্রহকারীদের হাতে চামড়া গছিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। আড়তদার ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে কারসাজির অভিযোগ করছেন। তবে চামড়ার লাভ শেষ পর্যন্ত দেশী-বিদেশী সিন্ডিকেটের হাতেই চলে যাচ্ছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, এই সিন্ডিকেট চামড়ার চাহিদা একবারে নিচে ঠেলে দিয়ে দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হতদরিদ্রদের কিছু পাওয়ার বার্ষিক অবলম্বনটি নিঃশেষ করেছে। অন্যদিকে কাঁচা চামড়া নামমাত্র দামে সংগ্রহ করে ভারতে পাচার করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে মুনাফা লুটার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
চামড়ার দাম নিয়ে নৈরাজ্য : কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নিয়ে এবার চরম নৈরাজ্য তৈরি করা হয়েছে। সরকার ঢাকার মধ্যে গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৫৫ থেকে ৬০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুটের মূল্য ৫০ থেকে ৫৫ টাকা নির্ধারণ করলেও কোথাও তা মানা হয়নি। দেড় থেকে দুই লাখ টাকার গরুর চামড়া মাত্র ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এর থেকে কম দামের গরুর চামড়া ২০০ থেকে ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ কারণে অনেকে চামড়া বিক্রি না করে এতিমখানায় দিয়ে দিয়েছেন। আর ছাগলের চামড়া কিনতে আগ্রহ ছিল না ক্রেতাদের। গরুর চামড়ার সাথে খাসির চামড়া ফ্রি দিয়েছেন কোরবানিদাতারা। অনেক স্থানে বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকায়। এ কারণে অনেকে বিক্রি না করে চামড়া মাটি চাপা দিয়ে দিয়েছেন।

গত ৩ জুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম চামড়ার দাম নির্ধারণ সভায় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ঢাকায় এক লাখ টাকা দামের একটি গরুর চামড়া যদি ২০ বর্গফুট হয়, তখন ওই গরুর চামড়ার দাম হবে এক হাজার ২০০ টাকা। ঢাকার বাইরে হবে এক হাজার টাকা।’ প্রতি বছর সরকার চামড়ার দাম নির্ধারণ করলেও মানুষ সে দাম পান না, সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এবার ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা নজরদারি করবে। এখানে সরকারের ভাবমর্যাদা নির্ভর করে। তাই কোরবানির পশুর চামড়া কম দামে বিক্রি হবে না।’
গত সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, যারা কোরবানি দিয়েছেন তারা কাঁচা চামড়া বিক্রির লোক খুঁজে পাচ্ছেন না। যারা বিক্রি করতে পেরেছেন তারাও নামমাত্র দাম পেয়েছেন। আবার অনেকে কাক্সিক্ষত দাম ও ক্রেতা না পেয়ে মাদরাসা ও এতিমখানার লোকজনকে বিনা পয়সায় দিয়ে দিচ্ছেন।
রাজধানীর বাসাবোর বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এক লাখ ৩২ হাজার টাকার গরুর চামড়া বিক্রি করেছি মাত্র ৫০০ টাকা। গত কয়েক বছর ধরে এত কম দামে চামড়া বিক্রি করছি। আগামীতে মাদরাসায় দান করে দেবো।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে একই রকম চিত্র দেখা গেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকায় গরুর চামড়া কিনেছেন। ছোট মাঝারি গরুর চামড়া আকারভেদে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। এক লাখ ২০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
ঈদের দিন মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী ফজলুল হক বলেন, ২০টি চামড়া কিনে বিক্রি করেছি। কিন্তু চামড়ার দাম পাওয়া যাচ্ছে না। আড়ত থেকে আমাদের সঙ্কেত দেয়া হয়েছে ৮০০ টাকার বেশি দাম যেনথচামড়া নাথ কিনি। পোস্তার লোকজনের সাথে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন ৭০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনবে না। তাই আমরা গড়ে একটা চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনেছি। প্রতি চামড়ায় এক দেড় শ’ টাকা খরচ আছে। এরপরও বিক্রি কর। লাভ থাকবে কি না জানা।

সিন্ডিকেটে জিম্মি চামড়া ব্যবসা!
চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে নূরুল মোস্তফা কাজী জানিয়েছেন, বৃহত্তর চট্টগ্রামে আড়তদারদের প্রতিনিধিদের সিন্ডিকেটের কারণে শেষ পর্যন্ত শহরের কোরবানিদাতাদের কেউ কেউ ৪-৫ লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া সর্বোচ্চ সাত শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পেরেছেন, তবে অধিকাংশ এলাকায় গরু যত বড়ই হোক চামড়া সর্বোচ্চ ৩ থেকে ৫ শ’ টাকার বেশি দাম পাওয়া যায়নি।
কয়েক বছর আগেও একটি মাঝারি সাইজের কোরবানির গরুর চামড়া প্রায় তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দামে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কিনে নিতেন। আর সেই টাকা যেত কোরবানির বিধান অনুযায়ী গরিব মানুষের কাছে। গ্রামে এখন সেই চামড়ার ক্রেতা পর্যন্ত নেই। গ্রামের মানুষেরা নিজেদের কোরবানির পশুর চামড়াটা কোনো রকমে এতিমখানার হুজুরদের হাতে দিয়েই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। আবার শহরে মৌসুমি ক্রেতা থাকলেও কিছু কিছু এলাকায় দাম মিলেছে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা।
২০১৯ সাল থেকে মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের চাপে পড়তে দেখা যায়। তারা কিছু মুনাফা করার উদ্দেশ্যে নামমাত্র মূল্যে কেনা চামড়া বিক্রি করতে গিয়েও আড়তদারদের কারসাজিতে বিপদে পড়েছে। সে বছর চট্টগ্রামে প্রায় সোয়া লাখ চামড়া রাস্তার ওপরেই নষ্ট হয়। এর পরের বছরও বিপুল চামড়া পথে পথে নষ্ট হয়েছে। ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে চামড়া নষ্ট হওয়ার খবর না এলেও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়ে।

এবার অবশ্য আড়তদারদের দাবি মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভালো দামই পেয়েছেন। এর পাশাপাশি দাম না পেয়ে এ বছরও বেশ কিছু চামড়া সিটি করপোরেশনের ভাগাড়ে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি।
সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, রাজধানীর বাইরে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরু বা মহিষের চামড়া কিনতে হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। সে হিসাবে সরকার নির্ধারিত দামে একটি গরুর চামড়ার গড় দাম ন্যূনতম সাড়ে ৮ শ’ হতে ১৪ শ’ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বেশির ভাগ লবণযুক্ত গরুর চামড়া কেনা হয়েছে গড়ে ৩ শ’ হতে ৫ শ’ টাকায়। যদিও কোন কোন আড়তদার ৭শ’ টাকায় একপিস গরুর চামড়া কেনারও দাবি করেছেন।
আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দরদামে সময় ক্ষেপণ করা হয় কিংবা কিনতে অনাগ্রহ প্রকাশ করা হয়। এভাবেই আড়তদার সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বিপুল পরিমাণ চামড়া অতি কমমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। একই সাথে চামড়ার অস্বাভাবিক কম মূল্যের কারণে হক বঞ্চিত হয়েছে দেশের বিপুল দরিদ্র মানুষ।
আবু তাহের নামে এক মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, চামড়ার দাম ঠিক করে দিয়ে সরকার দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে। আগে আমরা যে চামড়া ৭ শ’ থেকে ৮ শ’ টাকা পেয়েছি, এখন সেটা ৩০০ টাকাও ঠিক মতো পাচ্ছি না। পাটের ব্যবসার মতো চামড়া ব্যবসাও একদিন হারিয়ে যাবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সরকার আন্তরিক না হলে চামড়া ব্যবসা টিকবে না।
এদিকে সরেজমিন দেখা গেছে, আড়তদাররা লবণজাত চামড়া স্তূপ করে নগরীর মুরাদপুর হতে আতুরার ডিপো পর্যন্ত সড়কের ওপর ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রেখে দিয়েছেন। সড়কে এসব চামড়া বেশি সময় থাকলে এলাকার পরিবেশ বিষিয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা অনেকেরই।

চট্টগ্রাম কাঁচাচামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির বর্তমান কমিটির সহ-সভাপতি আবদুল কাদের নয়া দিগন্তের কাছে দাবি করেছেন, এবার মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভালোই দাম পেয়েছেন। তিনি জানান, সরকারনির্ধারিত চামড়ার মূল্য থেকে বর্গফুট প্রতি চট্টগ্রামের ট্যানারিতে বিক্রি করলে ১৫ টাকা এবং ঢাকায় প্রেরণ করলে ১৭-১৮ টাকা ব্যয় বাদ দিয়েই তারা চামড়া কিনেন। কারণ সরকার প্রতি ফুট ৫০ টাকা যে দাম নির্ধারণ করেছে সেটা লবণযুক্ত। আর একটি চামড়া লবণজাত করতে প্রায় ৫ শ’ টাকার লবণ লাগে। কিন্তু সেই খরচের টাকার হিসাব না করেই অনেক আনাড়ি মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনে লোকসান গুনছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

তিনি দাবি করেন, বড় সাইজের গরুর চামড়ার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ৬ শ’-৭ শ’ টাকা দরে কেনা হয়েছে এবং অপেক্ষাকৃত ছোট সাইজের গরুর চামড়া ৩০০ টাকা দরে কেনা হয়েছে। আমরা গরু জবাইয়ের ৬-৭ ঘণ্টার মধ্যে আড়তে চামড়া পৌঁছানোর সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকেই দেরিতে চামড়া পৌঁছানোর কারণে এর গুণগত মান নষ্ট হয়েছে। ফলে সেসব চামড়ার দাম অবশ্যই কম পাবে। এ বছর চট্টগ্রামের আড়তদাররা সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছেন বলে তিনি জানান।
উত্তরবঙ্গে চামড়া দামে ধস : শুধু রাজধানী নয় সারা দেশেই চামড়ার দামে ধস নেমেছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারো রংপুরে কোরবানির পশুর চামড়া ‘সস্তা দামে’ বেচাকেনা হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে সরকারনির্ধারিত ন্যায্য দাম পাননি কেউ। সরকারের বেঁধে দেয়া চামড়া দাম নির্ধারণ শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকায় ‘সিন্ডিকেট’ বলয় এবারো ভাঙতে পারেননি সাধারণ ব্যবসায়ী ও ফড়িয়ারা। ঈদের দিন রংপুর নগরীর চামড়া কেনাবেচার সবচেয়ে বৃহৎ এলাকা হাজীপাড়া চামড়াপট্টিতে ছিল না ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নজরদারি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুরো চামড়ার বাজার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে নেন আড়তদারসহ বড় বড় ব্যবসায়ীরা।

নগরীর বিভিন্ন স্থানে দেখা যায়, এবার প্রতি পিস গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ২৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। আর ছাগলের চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র ৫ থেকে ১০ টাকায়। মৌসুমি চামড়া বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে চামড়া কিনে আনার পর আড়তদারদের কাছে চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যায়নি। এতে করে হতাশ তারা।
ইকবাল সুমন নামের একজন তার কোরবানির গরুর চামড়া বিক্রি করেছেন মাত্র ৪০০ টাকায়। তিনি বলেন, চামড়া বেচতে এসে দাম শুনে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এক লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনে, সেই গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয় পানির দামে। সরকারের বেঁধে দেয়া দামের কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং বড় বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের ফাঁদের প্রভাব পুরো চামড়াপট্টি জুড়ে। উপায় না থাকায় কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। এতে করে আমার ক্ষতি না হলেও সাধারণ গরিব-মিসকিনের তো ঠিকই ক্ষতি হচ্ছে। কারণ কোরবানির পশুর চামড়ার টাকায় তো তাদের হক রয়েছে।
রংপুর নগরীর হাজিরহাট থেকে ১৫০ পিস চামড়া নিয়ে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান জানান, প্রতি বর্গফুট মাঝারি গরুর চামড়া সর্বনি¤œ ৭০০ থেকে ৮০০ এবং বড় গরুর চামড়া এক হাজার থেকে বারোশ দাম হওয়ার কথা। তিনি ওই হিসাবে গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কিনেছেন। গাড়ি ভাড়া আনুষঙ্গিক খরচসহ সাড়ে ৬০০ টাকা পড়েছে প্রতি পিস চামড়া কিনতে। কিন্তু আড়তদাররা ৫০০ টাকার বেশি দামে চামড়া কিনতে রাজি না হওয়ায় তাকে মোটা অঙ্কের লোকসান মেনে নিতে হয়েছে। একই কথা জানিয়েছেন নগরীর সিও বাজার এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সোলায়মান আলী। তিনিও গড়ে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কিনে এনে সস্তা দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।

ভালো দাম না পাওয়া প্রসঙ্গে প্রবীণ চামড়া ব্যবসায়ী আইয়ুব আলী বলেন, চামড়ার সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বর্তমানে সাধারণ লোকজন থেকে শুরু করে চামড়া ব্যবসায়ীদের কেউই ভালো দাম পাচ্ছেন না। এমনিতে দীর্ঘদিন থেকে ট্যানারি মালিকদের কাছে এখানকার ব্যবসায়ীদের লাখ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ব্যবসায়ীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পেশা পরিবর্তন করেছে অথবা পুঁজি হারিয়ে পথে বসেছে। তাই চামড়া শিল্পে ব্যাংকঋণ চালু করাসহ সুষ্ঠু বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন জরুরি।
যশোর অঞ্চলের সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট বসে রাজারহাটে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চামড়ার ক্রেতা-বিক্রেতারা এই মোকামে আসেন। মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে হাটে গিয়ে দেখা গেছে, সুনসান নীরবতা। কয়েক ফড়িয়া গরুর চামড়া সাজিয়ে বসেছেন। কেউ কেউ চামড়ার লবণ মাখানোর কাজ করছেন। ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতি একেবারেই কম। হাটের বিভিন্ন স্থানে ছাগলের চামড়া ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। হাটের শ্রমিক লিয়াকত খান বলেন, ঈদের দিন বিকেলে বিভিন্ন মাদরাসা থেকে হুজুররা ছাগলের চামড়া বিক্রি করতে হাটে আসেন। প্রতিটা চামড়ার দাম ৫ থেকে ১০ টাকার বেশি কেউ বলেনি। এতে তাদের রিকশা ভাড়াও উঠছে না দেখে রাগে ক্ষোভে তারা চামড়া হাটে ফেলে গেছেন। অন্তত হাজারখানেক ছাগলের চামড়া কাল পড়ে ছিল। সেখান থেকে ২০০ চামড়া কুড়িয়ে আজ লবণ মাখিয়ে রেখেছি। শনিবার হাটের দিন বিক্রির আশায় রয়েছি।

পানির দামে গরুর চামড়া : ছাগলের চামড়া ভাগাড়ে : বগুড়া অফিস থেকে আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন, বগুড়ায় এবারো চামড়া সিন্ডিকেটের কারণে কোরবানির উপযুক্ত দাম না পেয়ে পানির দামে গরুর চামড়া বিক্রি হলেও ছাগল ও ভেড়ার চামড়া বিক্রি না হওয়ায় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন কোরবানিদাতারা। এতে বঞ্চিত হয়েছেন গরিব দুস্থ, অসহায় মানুষ এবং মাদরাসাসহ এতিমখানাগুলো।
জানা গেছে, বগুড়া শহরের বাদুরতলা, বড়গোলা, বনানী-মাটিডালী রোড, থানা রোডে চামড়া বিক্রি করেন মৌসুমি ব্যবসায়ী ও কোরবানিদাতারা । এসব এলাকায় গরুর চামড়া ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকায় কেনাবেচা হয়েছে। ঈদের দিন ছাগল ও ভেড়ার চামড়া তারা কেনেননি। যারা ছাগল কিংবা ভেড়ার চামড়া বিক্রির জন্য এনেছিলেন বিক্রি না হওয়ায় ফেলে রেখে চলে গেছেন। কেউ ছাগলের চামড়া ১০-২০ টাকায় বিক্রি করলেও বেশির ভাগ লোকজন বিনামূল্যে চামড়া দিয়ে গেছেন।
শহরের বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা ৩০০ থেকে ৭০০ টাকায় গরুর চামড়া কিনলেও ছাগলের চামড়া কেউ নেননি। ফলে কোরবানিদাতারা বাধ্য হয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন বা কেউ রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড়ে রেখে দেন। সেখান থেকে পৌরসভার আবর্জনার গাড়ি নিয়ে গেছে।
চামড়া ব্যবসায়ী জমসেদ আলী জানান, গত কয়েক বছর যাবৎ চামড়া কিনে লোকসানের মুখে পড়েছি। তাই এবার চড়া দামে চামড়া কিনিনি। ভালো মানের বড় চামড়া ৮০০ টাকা পর্যন্ত কিনছি। আর ছোট গরুর চামড়া ২০০ টাকায় কিনেছি। চামড়া ব্যবসায়ী আব্দুস সাত্তার জানান, আড়তে চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়নি। এ ছাড়া আড়ত থেকে চামড়া কেনার কোনো টার্গেটও দেয়া হয়নি। এ কারণে আমরা কম দামেই চামড়া কিনেছি।

বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি আসাদুজ্জামান খান বলেন, ঢাকায় ট্যানারিতে ব্যবসায়ীদের কাছে বগুড়ার ব্যবসায়ীদের প্রায় ৩২ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। সেই টাকা না পাওয়ায় পাড়া-মহল্লার ফড়িয়া ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের হাতে আগাম টাকা দেয়া যায়নি। নগদ টাকা না থাকায় অনেকেই চামড়া কেনেননি। এ ছাড়া গরুর চামড়া প্রক্রিয়া করে প্রায় এক মাস রাখা যায়, কিন্তু ছাগলের চামড়া বেশি দিন রাখা যায় না। এ কারণে অনেক এলাকায় ছাগলের চামড়া কেউ কেনেনি।
ধুনট থেকে রাকিবুল ইসলাম জানান, বগুড়ার ধুনটে কোরবানি পশুর চামড়ার দাম নিয়ে হতাশ ব্যবসায়ীরা। গতবারের তুলনায় মাঠ পর্যায়ে যেমন দাম কম তেমনি খুচরা ক্রেতারা ব্যবসায়ীদের কাছেও বিক্রি করেছে কম দামে। ফলে লাভবান হতে পারছে না অনেক ব্যাসায়ী। উপজেলার কালের পাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন শিপন জানান, দুই লাখ টাকায় কেনা গরুর চামড়া বিক্রি এবার ৪০০ টাকা এবং এক লাখ ২৫ হাজার টাকার গরুর চামড়া বিক্রি ২ শ’ টাকা আর ছাগলের চামড়া ফ্রি নিয়েছে ।
শাজাহানপুর থেকে সংবাদদাতা জানান, কোরবানির পশুর চামড়া কিনে বিপদে পড়েছেন শাজাহানপুরের ব্যবসায়ীরা। গরুর চামড়ার দামে ধসের পর ছাগলের চামড়া কেউ কিনেনি। শাজাহানপুরের ক্যান্টনমেন্ট ও আশপাশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চামড়ার দাম কম থাকায় অবিক্রীত চামড়া রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। এতে করে এলাকায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, সরকারনির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক কম দামে চামড়া কিনেছি। এর পরও লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হয়েছে। চামড়া বাজারে অতিরিক্ত সিন্ডিকেটের কারণে এ শিল্পে ধস নেমেছে।
শিবগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা জানান, জেলার শিবগঞ্জে কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। এই উপজেলায় গরুর চামড়া ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় কেনাবেচা হলেও ছাগল ও ভেড়ার চামড়ার দামই করেনি কেউ। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, স্থানীয় মৌসুমি ব্যবসায়ীদের চামড়া ক্রয়ে বিনিয়োগ না করায় এবার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

উপজেলার রায়নগর গ্রামের মামুন মিয়া বলেন, আমার এক লাখ ১৭ হাজার টাকার গরুর চামড়া একজন ৮০০ টাকা দাম করেছিল আমি দেইনি। কিন্তু, দুপুরের পর ওই চামড়া আর কেউ কিনতেই আসেনি। পরে ওই চামড়া ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছি। গুজিয়া এলাকার আল মাহমুদ বলেন, আমার ৭০ হাজার টাকার গরুর চামড়া ২০০ টাকায় বিক্রি করেছি। উপজেলার মোকামতলা এলাকার মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম জানান, আমি ছাগলের চামড়া ২০-৩০ টাকা দরে কিনে শহরে বিক্রি করতে গেছি। কিন্তু কেউ চামড়া নেয়নি। পরে, ফেরার পথে মহাস্থান ব্রিজের নিচে করতোয়া নদীতে ফেলে দিয়ে এসেছি।
সোনাতলা থেকে মিনাজুুল ইসলাম জানান, জেলার সোনাতলায় নামমাত্র মূল্যে বিক্রয় হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। গরুর চামড়া নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে পারলেও ছাগল এবং ভেড়ার চামড়া মাটিতে পুঁতে রেখেছে বলে এলাকা সূত্রে জানা যায়। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে চামড়ার সঠিক মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে সুবিধাভোগীরা। কামারপাড়া এলাকার অধ্যাপক ফজলুল করিম জানান, আমি একটি গরু ৮০ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেছি আর চামড়া ২ শত টাকা দিয়ে বিক্রি করেছি।

চাটমোহর (পাবনা) সংবাদদাতা জানান, গত কয়েক বছরের মতো এবারো কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েন পশু কোরবানিদাতারা। ক্রেতার অভাবে অনেককে তাদের চামড়া নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে। ক্রেতাদের যেন কোনো আগ্রহই নেই চামড়ার প্রতি। এ চিত্র চাটমোহরের এগারো ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার। সোমবার ও মঙ্গলবার চাটমোহরের বেশ কিছু এলাকা ঘুরে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের নতুন বাজার এলাকার চামড়া ব্যবসায়ী কৃষ্ণ চন্দ্র দাস জানান, ভালো মানের গরু এবং মহিষের চামড়া ৯০০ থেকে ১০০০ টাকায়, ছাগলের চামড়া ১০ থেকে ৩০ টাকায় এবং ভেড়া ও গাড়লের চামড়া ১০ থেকে ২০ টাকায় কিনছেন তিনি। গত বছরের চেয়ে এবার চামড়ার দাম সামান্য কিছু বেশি বলে জানান তিনি। বড় শালিখা মহল্লার চামড়া ব্যবসায়ী সুজন আলী জানান, ৫০টি গরুর চামড়া কিনেছেন তিনি। প্রতিটির গড় দাম পড়েছে ৬৫০ টাকা। ছাগলের চামড়া কিনেছেন ১০ থেকে ৩৫ টাকায়। অপর চামড়া ব্যবসায়ী সুকুমার চন্দ্র দাস জানান, গরুর চামড়া ৭০০ থেকে ১০০০ টাকায় কিনেছেন তিনি। ঋষি পল্লীতে প্রায় দুই হাজারটি গরুর চামড়া এবং চার হাজার ছাগলের চামড়া ক্রয় বিক্রয় হয়েছে। লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করার পর নাটোর এবং ঢাকার বড় মহাজনদের কাছে চামড়া বিক্রি করবেন তারা।

চাটমোহর এনায়েতুল্লাহ ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার জুনিয়র সহকারী শিক্ষক মাওলানা আমির হোসেন জানান, আট হাজার টাকা দামের একটি ছাগলের চামড়া ১০ টাকায় বিক্রি করেছেন। চাটমোহর পৌর সদরের আতাহার আলী জানান, এক লাখ ৮ হাজার টাকা দামের একটি গরুর চামড়া মাত্র ৫০০ টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি। হাটে আলাপকালে ছোটগুয়াখড়া সম্মিলিত মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল শামসুল আলম তুহীন জানান, মাদরাসার সংগৃহীত চামড়া বিক্রির জন্য তিন ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন তিনি। ছাগলের চামড়া প্রতিটি ২০ টাকা (কাটা থাকলে ১০ টাকা) এবং গরুর চামড়া প্রতিটি ৮৫০ টাকা (কাটা থাকলে ৩৫০ টাকা), গাভীর চামড়া ৩৫০ টাকা করে দাম বলছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা।
চাটমোহর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো: মোখলেছুর রহমান বিদ্যুৎ জানান, ক্রেতাদের আগ্রহ না থাকায় ঈদের দিন চামড়া নিয়ে অনেকেই বিপাকে পড়েন। দশ বিশ টাকায় খাশির চামড়া, গড়ে চার থেকে পাঁচশত টাকায় গরুর চামড়া ও পাঁচশত থেকে সাড়ে পাঁচশত টাকায় মহিষের চামড়া বিক্রি হয়েছে।

ছাগল ফ্রি : গরুর চামড়া মাত্র ৩ শ!
বরিশাল ব্যুরো জানায়, বরিশালের আড়তগুলোতে গরুর কাঁচাচামড়া মান ও আকারভেদে ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় বিক্রি করেছেন মাঠপর্যায়ে চামড়া সংগ্রহকারীরা। কিন্তু ছাগলের চামড়া প্রক্রিয়াজাত খরচ বেশি হওয়ায় তা ব্যবসায়ীরা ক্রয় করেনি। ফলে সংগ্রহকারীরা ছাগলের চামড়াগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনেই ফেলে রেখে চলে গেছেন সংগ্রহকারীরা।
সরেজমিন দেখা গেছে, বরিশাল নগরীর হাটখোলা ও পদ্মাবতী এলাকার তিন-চারজন ব্যবসায়ী কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে কিনেছেন। তারা কেউই ছাগলের চামড়ার দাম করেননি।
আর মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া সংগ্রহকারীরা বলছেন, গতবারের থেকে গরুর চামড়ার দর কিছুটা বেশি। তবে ছাগলের চামড়া নিয়ে বিপদে পড়েছি। টাকাই দিতে চাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা।
চামড়া সংগ্রহকারী মর্তুজা বলেন, বাজারের অবস্থা না বুঝে এবারে ছাগলের চামড়াও সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু ছাগলের চামড়া নিয়ে কোনো ধরনের দরদামই করেনি পাইকাররা। তাই ছাগলের চামড়া ফেলে দিতে হয়েছে। ছাগলের চামড়া প্রতি ৫০ টাকা করেও দিলেও অন্তত গাড়ি ভাড়ার খরচ উঠতো বলে জানান তিনি।
হাইড অ্যান্ড স্কিন অ্যাসোসিয়েশন বরিশালের সভাপতি বাচ্চু মিয়া বলেন, গরুর চামড়া কিনে রেখেছি। তবে ছাগলের চামড়া নিতে চাই না। কারণ ছাগলের একটি চামড়ার পেছনে শ্রম দিয়ে সংরক্ষণ করতে যে খরচ হবে তা ট্যানারি মালিকরা দেবেন না।
নগরীর পদ্মাবতী এলাকার ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান মাসুম বলেন, সময়মতো সংরক্ষণ না করলে চামড়া নষ্ট হয়ে যায়, তাই গরুর চামড়া সংরক্ষণেই সবাই ব্যস্ত থাকি। কারণ ট্যানারিতে পৌঁছানোর আগে নষ্ট হলে সব লোকসান আমাকেই গুনতে হবে। আর এর মধ্যে ছাগলের চামড়া কেনার সুযোগই নেই। এর পেছনে এখন দেয়া সময়, অর্থ ও শ্রম সবই বৃথা যাবে।

ভারতে পাচাররোধে নিরাপত্তা জোরদার
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কোরবানির পশুসহ সব জিনিসের দাম বাড়লেও এবার কমেছে চামড়ার দাম।
ফলে ঈদের পর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চামড়া পাচার রোধে সাতক্ষীরার ২৭৮ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বিজিবি ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সূত্র মতে, সাতক্ষীরায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দু’টি ব্যাটালিয়নের অধীনে জল ও স্থল মিলে সীমান্ত এলাকা রয়েছে ২৭৮ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ সীমান্তের প্রায় ৩০টি চোরাঘাট দিয়ে চামড়াসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। দেশে সবচেয়ে বেশি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয় ঈদুল আজহায়। এ সময় দেশে বিভিন্ন ধরনের পশু কোরবানি করা হয়, যা থেকে সারা বছরের অন্তত ৬০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ হয়। আবার এই সময়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও পাচারকারী সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে কাঁচাচামড়া। এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় পাচারের আশঙ্কা বেশি করে দেখা দিয়েছে।

সাতক্ষীরা ৩৩ বিজিবি সূত্র জানায়, ঈদের পর পশুর চামড়া পাচার রোধে সীমান্তে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে বিজিবি। একই সাথে টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। চোরাইপথে গরু আমদানি ও চামড়া পাচার প্রতিরোধে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জেলার চামড়া ব্যবসায়ীরা জানান, একটা চামড়া প্রস্তুত করতে শ্রমিক মজুরি, লবণ, পরিবহন ও অন্যান্য খরচ বাবদ ৩০০ টাকা পড়ে। সরকার একটা চামড়ার দাম এক হাজার টাকা বেঁধে দিলেও, বড় গরু ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং মাঝারি ৪০০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় কেনা যায়।
সাতক্ষীরার চামড়া ব্যবসায়ী অনিল কুমার দাশ জানান, ট্যানারি মালিক সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীরা। ট্যানারি মালিকরা সময়মতো বকেয়া পরিশোধ না করায় এবারো সাতক্ষীরায় কোরবানির পশুর চামড়ার বাজারে ধস নামতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মতিউর রহমান সিদ্দিকী বলেন, সীমান্ত পথে চামড়া পাচার রোধে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। সীমান্তের সড়কে কোনো চামড়াবাহী যানবাহন ঢুকতে পারবে না। অন্য জেলা থেকেও চামড়াবাহী কোনো যানবাহন সাতক্ষীরা জেলায় প্রবেশ করতে পারবে না। তবে সাতক্ষীরা জেলার চামড়া ব্যবসায়ীরা তাদের সংগৃহীত চামড়া যশোর ও ঢাকার আড়ত এবং ট্যানারিতে নিয়ে যেতে পারবেন। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ূন কবির জানান, জাতীয় সম্পদ চামড়া যেন নষ্ট না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোরবানিদাতাদের স্বার্থে সরকার এবার প্রতি বর্গফুট চামড়ার মূল্য ৫-৭ টাকা বৃদ্ধি করেছে। তিনি আরো বলেন, ঢাকায় প্রতি পিস গরুর চামড়ার দাম হবে এক হাজার ২০০ টাকা ও সাতক্ষীরা জেলা পর্যায়ে দাম হবে এক হাজার টাকা।

২০০ টাকা বলেনি কেউ, পুঁতে দিয়েছি
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) সংবাদদাতা জানিয়েছেন, দুই লাখ টাকার গরুর চামড়া কেউ ২০০ টাকাও বলেনি, তাই মাটিতে পুঁতে ফেলেছি। কোরবানির দিন দুপুরে শুধু একজন আসছিল তাও দাম বলেছে ১৫০ টাকা। সারা দিন আর কেউ আসেনি। গরুর চামড়া এতটা অবহেলার বস্তু হয়ে গেছে। আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের ডোমখালী গ্রামের বাসিন্দা নুরুল গনি। এবারো উপজেলাজুড়ে চামড়ার ন্যায্যমূল্য পায়নি কেউ। প্রতিটি গরুর চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকায়। অনেক বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে দিয়েছেন। অনেকে এতিমখানায় দান করেছেন। মধ্যম ওয়াহেদপুর এলাকার জহির উদ্দিন জানান, আজ থেকে ২০ বছর আগে গরুর চামড়া বিক্রি করছে এক থেকে দেড় হাজার টাকায় তখন গরুর দাম ছিল ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায়। অথচ এখন লাখ টাকার নিচে গরু নেই। কিন্তু চামড়ার দাম পানির চাইতে কম।
বারইয়ারহাট পৌরসভার জামালপুর এলাকার দিদারুল আলম সুমন বলেন, সব জিনিসের দাম অনেক বেশি। গত এক যুগে চামড়াজাত জিনিসের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। উল্টো দফায় দফায় কমেছে পশু চামড়ার দাম। চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যের শেষ নেই।

মৌসুমি চামড়া ক্রেতা সজিব বলেন, আমাদেরকে বড় ব্যবসায়ীরা একটা রেট নির্ধারণ করে দিয়েছে, আমরা ওই রেটের চেয়ে বেশি টাকায় চামড়া কিনতে পারব না। সারা দিনে আমি প্রায় ৫০০ চামড়া সংগ্রহ করেছি। এখন সেগুলো পাইকারের কাছে বিক্রির অপেক্ষায়।
মিরসরাই উপজেলা কাঁচা চামড়া সমিতির সভাপতি কামাল উদ্দিন জানান, খুচরা ব্যবসায়ীদের আমার আড়তে চামড়া দিয়ে যেতে আগে থেকে বলা হয়েছে। দুপুরের পর থেকে তারা চামড়া দিয়ে যাচ্ছে। আবার আমাদের লোকজন বিভিন্ন বাজারে গিয়ে ক্রয় করছেন। ইতোমধ্যে চার হাজার চামড়া কালেকশন হয়েছে। আশা করছি রাতের মধ্যে আরো অনেক চামড়া আসবে।
পাটের মতো চামড়া শিল্পও ধ্বংস করেছে সরকার : সরকার পাটশিল্পকে ধ্বংসের পর এখন চামড়া শিল্পকেও ধ্বংস করে গরিব ও অসহায়দের হক থেকে বঞ্চিত করছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ। ইউনুছ আহমাদ বলেন, সরকার লোকদেখানো চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করেছে যা তা খুবই সামান্য। কিন্তু এ দামেও কেউ চামড়া ক্রয় না করে পাটের মতো চামড়াকেও ধ্বংসের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে। কোরবানির চামড়ার বাজারে এবারো দরপতন। লাখ টাকার গরুর চামড়া এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। সেখানে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব বলেন, চামড়ার ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করতে না পারা সরকারের চরম ব্যর্থতা। আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ হিসেবেই কোরবানির চামড়ার ভয়াবহ দরপতন হচ্ছে। সরকার আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে পাট শিল্পের মতো চামড়া শিল্পকেও ধ্বংসে কাজ করছে। এতে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী এতিম, অসহায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মধ্যে পড়ল। অপরদিকে কওমি মাদরাসা যা সরকারের কোনো প্রকার সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই দেশের শিক্ষা খাতে অসামান্য অবদান রাখছে, সে কওমি মাদরাসাগুলোকে ধ্বংসের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে কাজ চলছে।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement