১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

তিস্তায় উজানের ঢল

বাঁধের ৪৪ গেট উন্মুক্ত : নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
উজানের ঢলে লালমনিরহাটে তিস্তা নদী তীরবর্তী এলাকা তলিয়ে যাওয়ার দৃশ্য : নয়া দিগন্ত -

বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে পানি বাড়ছে তিস্তা অববাহিকায়। চাপ সামলাতে লালমনিরহাটের ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে সব ক’টি জলকপাট খুলে দিয়েছে পাউবো। হু হু করে পানি ঢুকছে ভাটিতে অববাহিকার দুই পাড়ের চরাঞ্চল-নিম্নাঞ্চলে। এতে তিস্তা তীরবর্তী এলাকার মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন।
উত্তরাঞ্চল পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, গত শুক্রবার বিকেল ৩টায় লালমনিরহাটের ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি রেকর্ড হয়েছে ৫১ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার দশমিক ৮৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে এই পয়েন্টে সকাল ৬টায় ৫১ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ৫১ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার ও দুপুর ১২টায় ২৮ দশমিক ৪৬ সেন্টিমিটার পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয়। এছাড়া রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ২৮ দশমিক ৬৩ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার দশমিক ১২ সেন্টিমিটার নিচে। এর আগে এই পয়েন্টে পানির প্রবাহ রেকর্ড করা হয় সকাল ৬টায় ২৮ দশমিক ৪০ সেন্টিমিটার, সকাল ৯টায় ২৮ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার, দুপুর ১২টায় ২৮ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার।
প্রকৌশলী আহসান হাবিব আরো জানান, উজানের ঢল আর গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে ডালিয়া পয়েন্টে পানি বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যারাজের ৪৪টি গেটই খুলে রাখা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলের দিকে ডালিয়া পয়েন্টে পানি কিছুটা কমতে শুরু করে। তবে ভাটির দিকে রংপুর জেলার কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার কাছ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানি আরো বাড়তে পারে।
এ দিকে তিস্তায় পানি বৃদ্ধির কারণে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারী, সদর, নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তিস্তা অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। নিমজ্জিত হচ্ছে বাদাম, শাকসবজিসহ উঠতি বিভিন্ন ফসল।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাহিদ তামান্না জানান, এখনো প্লাবন পরিস্থিতি হয়নি। তবুও আমরা সতর্ক অবস্থায় আছি। নদীর কিনারে চরাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণকে তিনি উঁচু জায়গায় গবাদিপশু ও অন্যান্য সামগ্রী রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
রংপুরের ডিসি মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান জানান, বন্যা হলে তা মোকাবেলা করতে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনকে প্রস্তুত রেখেছি। সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি আছে আমাদের।
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার জাকির হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, এখন পর্যন্ত বন্যার আভাস পাওয়া যায়নি। তবে বন্যায় যাতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে সরকারিভাবে সব ধরনের আগাম প্রস্তুতি নেয়া আছে। প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজখবর রাখছেন। যেহেতু তিস্তায় ফ্লাশ ফ্লাড হয়, সে কারণে পানি উঠলেও দ্রুত নেমে যায়। আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রেখেছি স্থানীয় প্রশাসনকে।
তিস্তায় পানি হু হু করে বাড়ছে
লালমনিরহাট থেকে আসাদুল ইসলাম সবুজ জানান, একটানা ক’দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হু হু করে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নদীপাড়ের বাসিন্দারা। গতকাল শনিবার দুপুর ১২টায় তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১.৫৭ মিটার (বিপদসীমা ৫২.১৫ মিটার), যা বিপদসীমার ৫৮ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পাটগ্রাম পয়েন্ট পানি সমতল ৫৭.২৫ মিটার (বিপদসীমা ৬০.৩৫ মিটার), যা বিপদসীমার ৩১০ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কাউনিয়া পয়েন্ট পানির সমতল ২৮.৫৫ মিটার (বিপদসীমা ২৮.৭৫ মিটার), যা বিপদসীমার ২০ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধরলা নদীর শিমুলবাড়ি পয়েন্ট পানি সমতল ২৯.৮৫ মিটার (বিপদসীমা ৩১.০৯ মিটার), যা বিপদসীমার ১২৪ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, তিস্তার পানি বাড়ায় জেলার পাটগ্রামের দহগ্রাম, হাতীবান্ধার গড্ডিমারী, দোয়ানী, সানিয়াজান ইউনিয়নের নিজ শেখ সুন্দর, বাঘের চর, সিঙ্গামারি ইউনিয়নের ধুবনী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ি, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা, পলাশী ও লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কালমাটি, রাজপুর, গোকুণ্ডা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী চরে বাদাম ক্ষেত, ধানের চারা, ভুট্টা ক্ষেত, কলা বাগান, মিষ্টি কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। অপরদিকে সদর উপজেলার মোগলহাট ও কুলাহাট ইউনিয়নের ধরলা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সেই সাথে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। ডুবে গেছে আমন ধানের চারাসহ শাকসবজির ক্ষেত। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ।
তিস্তায় পানি বাড়ছে জানিয়ে দোয়ানী গ্রামের কৃষক আনারুল হক বলেন, ভারতে বন্যা হয়েছে। ওই পানি যদি আমাদের বাংলাদেশের দিকে ছাড়ে তখন আমাদের এলাকায় বন্যা দেখা দিবে। এতে অনেক ক্ষতি হচ্ছে। ডুবে গেছে আমন ধানের চারাসহ শাকসবজির ক্ষেত। মোগলহাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান হাবিব বলেন, গত কয়েক দিনে থেমে থেমে বৃষ্টিতে ধরলা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে নদীভাঙন।
এ বিষয়ে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রাশেদীন ইসলাম বলেন, ভারতের সিকিমে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাতের কারণে সকাল থেকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি নিয়ন্ত্রণে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে তিস্তা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিবে। লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীল কুমার রায় বলেন, ভারতের সিকিমে বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য তিস্তায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে উজানের পানি ব্যাপকহারে তিস্তা নদীতে প্রবেশ করলে বাংলাদেশ অংশের তিস্তা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলে বন্যা দেখা দিবে।
দোয়ারাবাজারে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
দোয়ারাবাজার (সুনামগঞ্জ) থেকে সোহেল মিয়া জানান, টানা বর্ষণ আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। রাস্তা ভেঙে ও তলিয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন এলাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কোনো কোনো স্থানে নদীভাঙনও বেড়েছে। এতে অনেক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। উপজেলার সুরমা, চেলা, মরা চেলা, চিলাই, চলতি, কালিউরি, খাসিয়ামারা ও ধুমখালীসহ নদী-নালার পানি বিপদসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হচ্ছে। পাহাড়ি ঢলের তোড়ে উপজেলা বেশ কয়েকটি হাটবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা তলিয়ে গেছে। বিভিন্ন নদী তীরবর্তী রাস্তার একাধিক স্থানে ভাঙন শুরু হয়েছে। নিম্নাঞ্চল ও হাওরপাড়ের লোকজন বন্যার পদধ্বনিতে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভাঙনকবলিত এলাকার নদীপাড়ের বাসিন্দারা ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবার রাত থেকে টানা বর্ষণ আর ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে গতকাল শনিবার সকালে উপজেলার নরসিংপুর ইউনিয়নের চেলা নদী, লক্ষ্মপুর ইউনিয়নের খাসিয়ামারা নদীর নিকটবর্তী এলাকায় নদীভাঙনে বসতঘর বিলীন হওয়ার চিত্র দেখা যায়। ইতোমধ্যে চেলা নদীর ভাঙনে বসতঘর হারানো পরিবারগুলো এলাকায় বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
সুনামগঞ্জের পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় দোয়ারাবাজারের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement