১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বিএনপিতে ব্যাপক রদবদল

৪৫ পদে পরিবর্তন, কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন ২ কমিটি
-

বিএনপির কেন্দ্রে ব্যাপক রদবদল করা হয়েছে। ‘প্রমোশন ও ডিমোশন’ বিবেচনায় ৪৫ নেতার পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গঠন করা হয়েছে দুটি নতুন কমিটি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপির হাইকমান্ড দল পুনর্গঠনের যে কথা বলে আসছিল, নতুন এই রদবদলের মধ্য দিয়ে সেটি সিদ্ধান্ত আকারে সামনে আসলো। এই রদবদলের পেছনে বিগত আন্দোলনে সাংগঠনিক ব্যর্থতারও প্রভাব রয়েছে বলে কেউ কেউ বলেছেন। তবে দলটির সিনিয়র নেতারা বলছেন, কমিটি গঠন, পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সাংগঠনিক প্রয়োজনেই দলে বিভিন্ন সময় শূন্যপদ পূরণ, ছোটখাট রদবদল করা হয়। এতে করে আগামীতে সংগঠন আরও সুসংহত ও গতিশীল হবে।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণে গত বুধবার রাতে ঢাকাসহ চারটি মহানগর কমিটি ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে বিএনপি। এর পরপরই গতকাল দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ৪৫ নেতার পদে পরিবর্তন আনার বিষয়টি জানানো হয়। এই পরিবর্তনে অনেক নেতার যেমন পদোন্নতি হয়েছে, তেমনি কারো কারো পদাবনতিও হয়েছে।
বিএনপির বর্তমান জাতীয় নির্বাহী কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে। খুব শিগগির দলটির জাতীয় কাউন্সিল হওয়ার সম্ভাবনাও নেই বলে জানা গেছে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলে ৫০২ সদস্যের জাতীয় নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। এ ছাড়া গঠন করা হয় চেয়ারপারসনের একটি উপদেষ্টা কাউন্সিলও, যার সর্বশেষ সংখ্যা ৮১ জন। ওই বছরের ৬ আগস্ট জাতীয় স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদ মিলিয়ে ৫৯২ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এদের মধ্যে অনেকে মৃত্যুবরণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে উপদেষ্টা ও নির্বাহী কমিটিতে আরও কিছু নেতাকে পদায়ন করা হয়।

৪৫ নেতার পদ রদবদলের বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায়, দলের বিশেষ সম্পাদক সাবেক ছাত্রদল সভাপতি আসাদুজ্জামান রিপনকে ভাইস চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া যুগ্ম মহাসচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা পাঁচজনকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদে নেয়া হয়েছে। তারা হলেন- ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, মজিবুর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, হারুন অর রশিদ ও আসলাম চৌধুরী। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদটি অনেকটা অলঙ্কারিক।

নির্বাহী কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স এবং প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম মহাসচিব করা হয়েছে। পদোন্নতি পেয়ে আরও যারা দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হয়েছেন, তারা হলেন- সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন, সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, ডা: সাখাওয়াত হাসান জীবন, সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক বেবী নাজনীন, সহ-তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক খালেদ হোসেন চৌধুরী ফাহিন এবং মেজর জেনারেল (অব:) মো: শরীফ উদ্দীন। সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে পদোন্নতি পেয়ে সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন কাজী সাইয়েদুল আলম বাবুল (ঢাকা বিভাগ), সৈয়দ শাহীন শওকত (রাজশাহী বিভাগ) ও শরীফুল আলম (ময়মনসিংহ বিভাগ)। এছাড়া সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জি কে গউছকে (সিলেট বিভাগ) সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছেন। যুবদলের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে দলের প্রচার সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই পদটি বিএনপিতে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত। শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী সর্বশেষ এই পদে ছিলেন। এছাড়া সহ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীমকে গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক, যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিএনপির সভাপতি নাহিদ খানকে সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, ডা: শাহ মুহাম্মদ আমান উল্লাহকে সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক এবং এ এস এম সাইফ আলীকে সহ-তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে। সহ-প্রচার সম্পাদক আমিরুল ইসলাম খান আলীমকে রাজশাহী বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদকে ঢাকা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাহী কমিটির সদস্য আমিনুল ইসলামকে রংপুর বিভাগের সহ-সাংগঠনিক, ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিনকে চট্টগ্রাম বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, আবু ওয়াহাব আকন্দকে ময়মনসিংহ বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং মিফতাহ সিদ্দিকীকে সিলেট বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

এই রদবদলে পাঁচজনের পদাবনতি হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জালাল উদ্দিন মজুমদার, রংপুর বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ জাহাঙ্গীর আলম, কুমিল্লা বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সায়েদুল হক সাঈদ, সহ-কৃষিবিষয়ক সম্পাদক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল ফারুক, সহ-তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক এস এম গালিবকে নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়া যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ, সুইডেন বিএনপির সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ ঝিন্টু, ডেনমার্ক বিএনপির সদস্য গাজী মনির, ছাত্রদলের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল এবং জাহান পান্না (রাজশাহী), নাজমুন নাহার বেবী (চাঁদপুর), মোঃ মাইনুল ইসলাম (টাঙ্গাইল), আজম খান (দক্ষিণ আফ্রিকা) ও বেলায়েত হোসেন মৃধাকে (নরসিংদী) জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
একদফার আন্দোলনে বিএনপির কূটনৈতিক উইংয়ের ব্যর্থতা রয়েছে, এমন অভিযোগ দলটির ভেতরে প্রায়ই শোনা যায়। জানা গেছে, বিষয়টি আমলে নিয়ে কূটনৈতিক ব্যর্থতা কাটাতে দলের চেয়ারপারসনের ‘ফরেন এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজরি কমিটি’ এবং ‘স্পেশাল অ্যাসিসট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপারসন ফরেন এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজরি কমিটি’ নামে ২৯ সদস্যের নতুন দুটি কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। সিনিয়র নেতাদের দিয়ে একটি এবং সিনিয়র নেতাদের সহায়তা করার জন্য অন্য কমিটি করা হয়েছে।

‘চেয়ারপারসনের ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইারি কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকবেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কমিটির সদস্যরা হলেন- স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, সাবেক রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম এবং কুড়িগ্রাম জেলা বিএনপির সভাপতি তাজভিরুল ইসলাম। ‘স্পেশাল অ্যাসিসট্যান্ট টু দ্য চেয়ারপার্সনস ফরেন এ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্যরা হলেন- শ্যামা ওবায়েদ, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, আফরোজা খান রিতা, অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নি, জিবা খান, অ্যাডভোকেট নিপুন রায় চৌধুরী, খান রবিউল ইসলাম রবি, ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন, তাবিথ আউয়াল, প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন, ফারজানা শারমীন পুতুল, ইসরাফিল খসরু, ব্যারিস্টার আবু সালেহ মো. সায়েম (ইউকে) এবং মো. ইকবাল হোসেন বাবু (বেলজিয়াম)। এর আগে আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির ২১ সদস্যের ‘ফরেইন অ্যাফেয়ার্স’ কমিটি ছিল।

বিএনপির ১১টি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের মধ্যে ইতোমধ্যে ছাত্রদল ও যুবদলের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দল ছাড়া বাকি অঙ্গ সংগঠনের কমিটিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। বিএনপি পর্যায়ক্রমে এসব সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দেওয়ারও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংগঠন পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পুনর্গঠন নিয়ে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে সংগঠনের সব নেতৃত্বই পাল্টে ফেলা হবে।
সরকারবিরোধী আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে ঘুরে দাঁড়াতে সংগঠনকে ঢেলে সাজাচ্ছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে সাংগঠনিকভাবে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন দলটির হাইকমান্ড। এই প্রক্রিয়ায় বিগত আন্দোলনে রাজপথে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে না পারা দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন কিংবা গুরুত্বপূর্ণ নেতা কেউ-ই ছাড় পাবেন না, এমন কথা বলা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সামনে দলে আরও রদবদল আসছে। শূন্যপদ পূরণসহ স্থায়ী কমিটি থেকে শুরু করে নির্বাহী কমিটির সহ-সম্পাদক পদ পর্যন্ত এই পরিবর্তন আনা হবে। সে ক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটির দু-একজনকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলে নেয়া হতে পারে। সব মিলিয়ে দুই শতাধিক পদে আসতে পারে রদবদল।
বিএনপিতে রদবদল প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, কমিটি গঠন, পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সাংগঠনিক প্রয়োজনেই দলে বিভিন্ন সময় শূন্যপদ পূরণ, ছোটখাটো রদবদল করা হয়। এবারও সেটা করা হয়েছে। সাংগঠনিকভাবে এতে দলের ভালোই হবে। এতে করে আগামীতে সংগঠন আরও সুসংহত, গতিশীল হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংগঠনে প্রত্যেকের একটা জবাবদিহিতা থাকে। যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়, তিনি সেটা সঠিকভাবে পালন না করলে সে ক্ষেত্রে ‘বেটার রিপ্লেসমেন্ট মাস্ট’।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল