১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জাতিসঙ্ঘের অপরাধীদের কালো তালিকায় ইসরাইলি বাহিনী

-

- ইসরাইলি হামলায় কর্মী হত্যার তদন্ত চায় জাতিসঙ্ঘ
- ৪ ইসরাইলি বন্দীকে জীবিত উদ্ধারের দাবি
- নুসাইরাত শিবিরে নৃশংস হামলায় নিহত ৫৫


২০২৩ সালে শিশুদের ওপর করা সহিংসতার দায়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনীকে অপরাধীদের একটি বৈশ্বিক তালিকায় যুক্ত করেছেন জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ইসরাইলের জাতিসঙ্ঘের দূত গিলাদ এরদান এই তথ্য জানিয়েছেন। গত শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে। একে ‘লজ্জাজনক’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, হামাস এবং ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদকেও এই তালিকায় যুক্ত করা হবে।
শিশু ও সশস্ত্র সঙ্ঘাত সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে বৈশ্বিক এই তালিকাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৪ জুন এটি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে জমা দেবেন গুতেরেস। এই তালিকায় ছয় ধরনের সহিংসতার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো, হত্যা ও বিকলাঙ্গ করা, যৌন সহিংসতা, অপহরণ, শিশুদের নিয়োগ ও ব্যবহার, সাহায্য প্রবেশে অস্বীকার এবং স্কুল ও হাসপাতালে হামলা। তবে কী ধরনের সহিংসতার দায়ে ইসরাইলকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং হামাস বা ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদকে তালিকাভুক্ত করা হবে তা তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট নয়।
ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাটজ বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত ‘জাতিসঙ্ঘের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে।’ দীর্ঘ দিন ধরেই জাতিসঙ্ঘের সাথে ইসরাইলের বিতর্কিত সম্পর্ক রয়েছে, যেটি গাজা উপত্যকায় ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আরো খারাপ হয়েছে। গত মাসে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিহ্নিত লাশের তথ্যের বরাতে জাতিসঙ্ঘ বলেছিল, আট মাসব্যাপী চলমান এই যুদ্ধে গাজায় অন্তত সাত হাজার ৭৯৭ শিশু নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যকে নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে জাতিসঙ্ঘ। এ দিকে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস বলছে, এই যুদ্ধে মোট ১৫ হাজার ৫০০ শিশু নিহত হয়েছে।
কর্মী হত্যার তদন্ত চায় জাতিসঙ্ঘ : এ দিকে ইসরাইলি হামলায় নিহত জাতিসঙ্ঘের ত্রাণকর্মীসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত চেয়েছে সংস্থাটি। শুধু কর্মীদের হত্যা নয়, জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ গুদামে ইসরাইলের পরিকল্পিত হামলারও তদন্ত চেয়েছেন জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ শাখার পরিচালক জুলিয়েট টওমা। মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ দাবি জানান জুলিয়েট টওমা।

জাতিসঙ্ঘের এ ত্রাণ কর্মকর্তা শুক্রবার বলেন, জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনে উল্লেখ আছে। একইসাথে জাতিসঙ্ঘের স্থাপনাগুলো বেসামরিক নাগরিকরা নিরাপদ আশ্রয় শিবির হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
নুসাইরাতে হামলায় নিহত ৫৫ : এ দিকে গতকাল শনিবার গাজার নুসিরাত শিবিরসহ ভূখণ্ডের কেন্দ্রীয় এলাকায় ইসরাইলি হামলায় অন্তত ৫৫ জন নিহত হয়েছে। আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের মুখপাত্র ও চিকিৎসক খলিল আল-দাকরান এএফপিকে বলেন, ‘সেন্ট্রাল গভর্নরেটে তীব্র ইসরাইলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৫৫ জনের লাশ তারা হাসপাতালে আনতে দেখেছে এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে, যাদের আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে আনা হয়েছে।’ হতাহতরা নুসিরাত ক্যাম্পের পাশাপাশি দেইর আল-বালাহ থেকে এসেছে বলেও জানান তিনি, যেখানে হাসপাতালটি অবস্থিত। এ ছাড়া হামাস একটি পৃথক বিবৃতিতে বলেছে, ‘হতাহতদের কয়েক ডজন লাশ মাটিতে, রাস্তায় ও নিরাপদ কক্ষে পড়ে আছে।’ ইসরাইলি বাহিনী ‘নুসিরাত ক্যাম্পে নৃশংস ও বর্বর আগ্রাসন’ চালাচ্ছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে। পাশাপাশি ইসরাইলি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ফুটেজে নুসাইরাতের বেশ কয়েকটি ভবন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। এএফপির তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সেনাবাহিনী নুসাইরাত ও এর আশপাশে তীব্র বিমান ও স্থল হামলা চালিয়েছে।
৪ বন্দীকে জীবিত উদ্ধার : অন্য দিকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, তাদের সেনারা গতকাল শনিবার একটি ‘জটিল অভিযানের’ পর গাজা থেকে চার ইসরাইলি বন্দীকে জীবিত উদ্ধার করেছে। সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, নোয়া আরগামানি (২৫), আলমোগ মেইর জান (২১), আন্দ্রে কোজলভ (২৭) ও শ্লোমি জিভ (৪০), এই চারজনকে ৭ অক্টোবর নোভা মিউজিক ফেস্টিভাল থেকে হামাস অপহরণ করে। তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো বলেও জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, ‘বন্দীদের উদ্ধার করা হয়েছে...গাজার মধ্যঞ্চলীয় নুসাইরাতের কেন্দ্রস্থলে দু’টি পৃথক স্থান থেকে।’ বন্দীদের উদ্ধারের এ বিরল খবর গাজায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সাথে আট মাস যুদ্ধের পর এলো। এর আগে শনিবার সেনাবাহিনী একটি পৃথক বিবৃতিতে জানায়, তাদের বাহিনী ‘নুসাইরাত এলাকায় হামসের অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করছে’।

গাজায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে : কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আলজাজিরার সবশেষ তথ্য অনুসারে গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানে এ পর্যন্ত ৩৬,৮০১ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৮৩,৬৮০ জন আহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় আরো ৭০ ফিলিস্তিনি নিহত ও ১৫০ জন আহত হয়েছে।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছে ৩ হাজার শিশু : গাজায় চলমান ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় তিন হাজার শিশু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। চেতনানাশক ছাড়াই অঙ্গচ্ছেদ করাতে বাধ্য হচ্ছে শিশুরা। পুরো একটি প্রজন্ম প্রচণ্ড মানসিক আঘাত নিয়ে বেড়ে উঠছে বলেও জানান গাজার চিকিৎসকেরা। প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসাসেবা পাওয়া যেতে পারে এমন কোনো হাসপাতালই এখন আর অবশিষ্ট নেই গাজায়। আল-আকসা হাসপাতালের আবাসিক অর্থোপেডিক সার্জন মোহাম্মদ শাহীন বলেছেন, যথেষ্টসংখ্যক আঘাত এবং আহতদের সুস্থ করার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সংস্থানের অভাবে পরিস্থিতি চিকিৎসাকর্মীদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন ব্লিনকেন : যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইসরাইল ও হামাস স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাদের অস্ত্র বিরতি প্রস্তাবে রাজি করানোর আশায় আজ রোববার আবার মধ্যপ্রাচ্যের দিকে রওনা হচ্ছেন। ওই অস্ত্রবিরতির লক্ষ্য হচ্ছে লড়াই থামানো, পণবন্দীদের মুক্তি নিশ্চিত করা এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজায় আরো মানবিক সহায়তা পাঠানো। শুক্রবার পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এই শীর্ষ কূটনৈতিক হামাসের তরফ থেকে সরাসরি এই অস্ত্রবিরতি প্রস্তাব মেনে নেয়ার গুরুত্বের ওপর জোর দেবেন।
ব্লিনকেনের সর্ব সাম্প্রতিক সফরটি ওই অঞ্চলে এমন এক সময় হয় যখন ইসরাইল পুরোদমে গাজায় আক্রমণ চালাচ্ছিল। রাতের বেলায় এবং পরের দিন, শুক্রবারেও ইসরাইলের ট্যাংক ও যুদ্ধ জাহাজগুলো গাজার দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে আক্রমণ চালায়।
সমুদ্রপথে ত্রাণ প্রবেশ করবে : মার্কিন-নির্মিত ভাসমান বন্দর দিয়ে গাজায় আবারো মানবিক সহায়তা প্রবেশ করবে বলে জানিয়েছে ইসরাইল। গতকাল শনিবার ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, কাঠামোর মেরামত শেষ হলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বন্দরটি দিয়ে ত্রাণ প্রবেশ করতে পারবে। শুক্রবার ইউএস সেন্ট্রাল কমান্ড বলেছে, গাজার উপকূলের অস্থায়ী বন্দরটি পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে। এই বন্দর দিয়ে ত্রাণ প্রবেশ শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ পরই কাঠামোর কিছু অংশ ভেঙে গেলে সাময়িকভাবে এটি সরিয়ে নেয়া হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement