১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
বাজেট প্রতিক্রিয়া

ব্যবসায়ীদের দাবিতেই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী : নয়া দিগন্ত -

- আলোচিত সাবেক আইজিপি বেনজীর এই সুযোগ পাচ্ছেন না
- বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে মেজাজ হারিয়ে ফেললেন অর্থমন্ত্রী


ব্যবসায়ীদের দাবির কারণে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো: রহমাতুল মুনিম।
তিনি বলেছেন, অডিটজনিত কারণে কিছু ব্যবসায়ী তাদের বৈধ সম্পদ রিটার্ন দাখিলের সময় দেখাতে পারছেন না, সে কারণে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও কিছু ব্যক্তিও এই সুযোগ চেয়েছিল। তারা বলেছে, আয়কর ফাইল অন্যদের দিয়ে করার কারণে তাদের এই অবস্থা হয়েছে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি (সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ) তা পারবেন না। কারণ এখানে ফৌজদারি মামলা চলমান রয়েছে।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অর্থ মন্ত্রণালয় আয়োজিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি তথ্য জানান। উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগ দেয়া হয়। এতে ব্যক্তির পাশাপাশি কোম্পানিও কালো টাকা সাদা করতে পারবে। এ সিদ্ধান্তে অর্থনীতিবিদসহ দেশের সৎ করদাতা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে কালো টাকা নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্যবসায়ী মহলের পক্ষ থেকে একটা দাবি এসেছিল, সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে একটা দাবি এসেছিল, অডিটজনিত কারণে কিছু ব্যবসায়ী তাদের বৈধ সম্পদ দেখাতে পারছেন না, সে কারণে আমরা এই সুযোগটা দিয়েছি।
তিনি আরো বলেন, কালো টাকা যারা তৈরি করেন তারা ইকোনমিকে ব্যবহার করার জন্য তৈরি করেন না। কালো টাকা দেশের বাইরে চলে যায়। কালো টাকাটা ভোগ বিলাসের জন্য তৈরি করা হয়। জমি ক্রয়-বিক্রয় করার সময় কিছু টাকা কালো হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে যারা রিটার্নে যেসব সম্পদ দেখাতে পারেননি, সেই সম্পদ দেখানোর জন্য এ সুযোগ দেয়া হয়েছে। যা অনেক দেশেও দেয়া হয়ে থাকে।

সাংবাদিকরা অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন রাখেন, বেনজীর সাহেবরা (পুলিশের সাবেক আইজি) কালো টাকা সাদা করার সুযোগ পাবেন কি না- এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে অর্থমন্ত্রী এনবিআর চেয়ারম্যানকে উত্তর দিতে বলেন। এর জবাবে তিনি বলেন, এই টাকা কেইসে (মামলায়) পড়ে গেছে, এটা কিভাবে সাদা হবে। এখন ফৌজদারি মামলা চলছে।
বেনজীর আহমেদের বিষয়ে আরেক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, সাবেক কর্মকর্তা নিয়ে আপনারা প্রশ্ন করেছেন, উনার বিচার হবে না এটা কেউ বলেননি। দুদক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। তার বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহ না করে তাকে জেলে বা ফাঁসি দেবো বিষয়টি এমন নয়, কারণ উনি তো এ দেশের মানুষ। বেনজীর বিদেশে আছেন, দুদকের কাছে সময় চেয়েছেন।
এবারই রেকর্ড পরিমাণ মন্ত্রী ও আমলা পরিবেষ্টিত হয়ে কোনো অর্থমন্ত্রী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করলেন। এই সংবাদ সম্মেলনে ১০ জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী এবং তিনজন আমলা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর উপস্থিত ছিলেন।

প্রশ্ন শুনে অর্থমন্ত্রী মেজাজ হারিয়ে ফেললেন
সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রাণবন্ত ছিল সংবাদ সম্মেলন। তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অর্থমন্ত্রীর বিরক্তি প্রকাশ ও প্রশ্নের অবমূল্যায়ন করা বক্তব্যে একাধিকবার হাস্যরসের সৃষ্টি হয় সংবাদ সম্মেলনে। অনেক সময় তিনি মেজাজও হারিয়ে ফেলেন। সাংবাদিকদের আরো ‘পড়াশোনা’ করে আসারও পরামর্শ দেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে অর্থমন্ত্রী বারবার প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ও অন্যান্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের দারস্থ হন। প্রথম থেকেই বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনে বিরক্তবোধ করেছেন অর্থমন্ত্রী। সেই সাথে তিনি বাজেটের নানা বিষয়ে করা সাংবাদিকদের প্রশ্নের মান এবং ম্যাচিউরিটি নিয়েও কথা বলেছেন। পুরো সংবাদ সম্মেলনজুড়েই বিরক্তি প্রকাশ করেছেন মন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটের বিষয়ে যে পর্যায়ের প্রশ্ন আশা করেছিলাম সে রকম হয়নি। তবে কয়েকজনের প্রশ্ন বেশ ভালো ছিল। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা একেবারেই নন-সিরিয়াস প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার যোগ্য না আমি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি একটু ম্যাচিউরড প্রশ্ন আশা করেছিলাম। আমি খুবই নিরাশ হয়েছি। আপনারা (সাংবাদিকরা) আরো একটু পড়ে আসবেন। এভাবে অতি সরলীকরণ করবেন না। একটু ম্যাচুউরিটি নিয়ে আসেন।
যারা আর্থিক খাতের বিভিন্ন অনিয়মের সাথে জড়িত তাদের জন্য আপনার কী বার্তা থাকবে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আমরা তো খোলাখুলি সব বলেছি। কোনো রাখঢাক করিনি। আপনি ঘুরেফিরে একই কথায় যাচ্ছেন কেন? এইটা তো বুঝতে পারলাম না। এটা কী ধরনের প্রশ্ন! কিভাবে প্রশ্ন করে এগুলো একটু শিখতে হবে তো। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে। এটা কোনো জার্নালিজম না। খালি এক কথাই ঘুরে ফিরে বলেন। এগুলো একটু দেখেন। দেখে একটু শেখেন। তাহলে আমাদেরও কাজ করতে সুবিধা হবে। তিনি অনেক প্রশ্ন উত্তর- দেখছি, করছি, দিয়ে শেষ করেন।

আওয়ামী লীগ সরকার না থাকলে মূল্যস্ফীতি আরো বেশি হতো : অর্থমন্ত্রী
মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়ে বাজেটে কিছু নেই- এ প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে যখন ক্ষমতায় আসে তখন মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের কাছাকাছি ছিল, ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশে। কিন্তু সরকার দুই বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। পরবর্তী এক দশক মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ছিল। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেও মূল্যস্ফীতি আরো বেশি হতো।
এ সময় তিনি আরো বলেন, তবে কোভিড-১৯ মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বৈদেশিক মুদ্রা সঙ্কটের কারণে গত কয়েক বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
আপাতত সঙ্কোচনমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ আরো কিছুদিন চালু থাকবে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি এবং তা নিয়ন্ত্রণে আমরা আরো কী করতে পারি তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করছি।
পুঁজিবাজার নিয়ে যা বলা হলো
তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট করহার দীর্ঘদিন কমিয়ে রাখা হলেও পুঁজিবাজার ফুলেফেঁপে খুব বেশি ভালো অবস্থায় ছিল কি না, সেই প্রশ্ন রেখে রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো: রহমাতুল মুনিম বলেছেন, ক্যাপিটাল মার্কেটের (পুঁজিবাজার) সমস্যা আসলেই কি চিহ্নিত করা হয়েছে?
বাজেটে পুঁজি বাজার নিয়ে কিছুই বলা হয়নি- এর জবাবে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, অনেকেই মনে করেন ক্যাপিটাল মার্কেটের জন্য ইফেক্টিভ টুলস অনলি- ডিউটি রেট কমিয়ে রাখা। এটা দীর্ঘদিন কমিয়ে রাখা হয়েছিল। তাতে ক্যাপিটাল মার্কেট ফুলেফেঁপে খুব বেশি ভালো অবস্থায় কি ছিল? আগে অনেক বেশি কর সুবিধা দেয়া ছিল, তার রেজাল্ট কি আমরা খুব বেশি ভালো দেখতে পেয়েছি ক্যাপিটাল মার্কেটে? নাকি ক্যাপিটাল মার্কেটের সমস্যা অন্য কোথাও রয়েছে? ক্যাপিটাল মার্কেটের সমস্যা আসলেই কি চিহ্নিত করা হয়েছে?
এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, আপনারা সব সময় মনে করছেন যে, শুধু বুঝি কর ছাড়ই ক্যাপিটাল মার্কেট গ্রো (ভালো) করার জন্য একটি ভালো জায়গা। ক্যাপিটাল মার্কেটে কর ছাড়ের এই চর্চা দীর্ঘ সময় ছিল। এখন যেটি হয়েছে, আমাকে রেভিনিউ জেনারেট করতে হবে। কর ছাড়ের যে জায়গাটি রয়েছে, সেটা ধীরে ধীরে আমাদের কমিয়ে আনার প্রচেষ্টার মধ্যে আছে। অনেকেই নিজ খরচে পদ্মা সেতু করার কথা বলেছেন। আমরা আরো পদ্মা সেতু করতে চাই। সেটার জন্য আমাদের রেভিনিউ জেনারেট (রাজস্ব আহরণ) করতে হবে। সেটারই একটি প্রক্রিয়া হলো কর ছাড়ের জায়গাটা কমিয়ে আনা।
তিনি বলেন, এখানে ৫ শতাংশ যে ব্যবধান দেয়া হয়েছে, এর ফলে করপোরেট ট্যাক্স ২০ শতাংশ রয়েছে। ২০ শতাংশের নিচে যদি করপোরেট ট্যাক্স করা হয়, তাহলে আমাদের রেভিনিউ জেনারেট করবে না। ১৫ শতাংশ করপোরেট ট্যাক্স করার পর্যায়ে আমাদের দেশ এখনো আসেনি। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত এ দুই ধরনের কোম্পানির কর কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। এটা করা হলে এনবিআরের রেভিনিউ কালেকশনের (রাজস্ব আদায়) ওপর বিরাট হুমকি হয়ে যাবে।

আরেক প্রশ্নের উত্তরে অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে যে কিছুই নাই এটা ঠিক না। বাজেট বক্তৃতায় যেসব কথা বলা থাকবে এমনটি নয়। তারপরেও আমরা বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেছি। বিশেষ করে গ্রিন বন্ড ফাইন্যান্সিং নিয়ে কাজ করছি। দীর্ঘমেয়াদে বন্ড মার্কেট নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছি। এ জন্য বাজেটে গ্রিন বন্ডকে হাইলাইট করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন- স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো: তাজুল ইসলাম, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, পরিকল্পনা মন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব:) আব্দুস সালাম, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, কৃষিমন্ত্রী ড. মো: আব্দুস শহীদ, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো: মাহবুব হোসেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো: রহমাতুল মুনিম।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। বিশাল অঙ্কের এ বাজেটের ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।


আরো সংবাদ



premium cement