১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিনের মন্তব্য

চ্যালেঞ্জিং সময়ে উচ্চাভিলাষী টার্গেটের গতানুগতিক বাজেট

-


আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যে প্রস্তাবিত বাজেটের আকারে আমি সন্তুষ্ট। কারণ আকারে বাজেটটি বড় না। বাস্তবসম্মত। কিন্তু বড় ব্যাপার হলো, আকার না বাড়লেও ব্যয়ের ব্যাপারটা কমেনি। এ জন্য রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে চাপ আছে। চ্যালেঞ্জিং সময়ে উচ্চাভিলাষী টার্গেটের গতানুগতিক একটি বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার মতে, এ বাজেট ব্যবসাবান্ধব ও জনবান্ধব নয়। লোকজনকে সুখী করার মতো তেমন কিছু নেই। মূল্যস্ফীতির ব্যাপারে তেমন কিছু দেখিনি। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, সম্ভব না। রাজস্ব বোর্ডের জন্য যে চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে তা আদায় সম্ভব হবে না।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেট ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পেশ করেছেন নতুন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, লোকজন সুখী হওয়া মানে তো মূল্যস্ফীতি কমবে, কর্মসংস্থান বাড়বে, আয়ের উৎস বাড়বে, ছোট ব্যবসায়ীরা ব্যবসা প্রসারের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এগুলো নিশ্চিত করা গেলেই মানুষ সুখী হবে। তিনি বলেন, সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা চাপে পড়বে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আমদানি শুল্ক কমানোর কথা বলা হলেও তাতে খুব বেশি কাজ হবে না। আর ২০ শতাংশ থেকে এক বছরে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, সম্ভব না। এ জন্য এক বছরের মধ্যে সরবরাহ বাড়াতে হবে, চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাজার মনিটর করলে হয়তো কিছু কমবে। কিন্তু ৬ দশমিক ৫-এ আনা যাবে না। যেখানে বর্তমানে বিবিএসের হিসাবে মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে সরবরাহ বাড়াতে হবে। কিন্তু আমি বাজেটে সেই চাহিদা বাড়ানোর কোনো পদক্ষেপ দেখলাম না।

আকার বিশ্লেষণ করে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, বাজেটের আকার গতবারের চেয়ে বেশি বড় হয়নি। এদিক থেকে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যয়ের কোনো সঙ্কোচন হয়নি। উচিত ছিল আকারের মতো করে ব্যয়ও কমানো। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমালে ঘাটতি কম হতো। তিনি বলেন, বাজেটে ঘাটতি দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কারণ এমনিতেই দেশের ব্যাংকিং খাত তারল্য সঙ্কটে ভুগছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোতে নানান রকম অরাজকতা। সেখানে ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে সরকার। এটা বাস্তবসম্মত না। সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে টাকা নিয়ে গেলে ব্যবসায়ীরা কী করবে? ব্যবসা না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না, আবার ট্যাক্সও না। তবে জ্বালানি ও কৃষিতে সরকার যে ভর্তুকি দেবে এটা ভালো পদক্ষেপ।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগের ব্যাপারে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, নৈতিকতার দিক দিয়ে এবং আর্থিক বিবেচনায় মোটেও ঠিক হয়নি। এটা একটা কম্প্রমাইজ করে বলছে টাকা আসবে। আসলে টাকা আসবে না, যা অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে। যারা সৎভাবে আয় করে ঘোষণা দিয়ে ৩০ শতাংশ সর্বোচ্চ কর দিচ্ছে। আর কালো টাকার লোকেরা দেবে ১৫ শতাংশ। এখানে সৎ লোকেরা ভাববে টাকা কালো করলেই তো ভালো। পরে ১৫ শতাংশ দিয়ে আমি ঠিক করে নিলাম। চট করে না দেখিয়ে পরে কারো হিসাবে দেখালে ১৫ শতাংশ কর কম দিতে পারবো। এটা মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।

উন্নয়ন ব্যয়ের ব্যাপারে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিশ্লেষণ করে বলেন, এবারে যে এডিপি নেয়া হয়েছে বিরাট আকারের এটা বাস্তবায়ন হবে না। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা দুর্নীতি ও অনিয়ম দেখছি। ব্যয়ের দিকটাতে সরকারকে সাশ্রয়ী হতে হবে। ১২৯৮টি প্রকল্প যে এডিপি দিয়েছে, এগুলোর বেশির ভাগই কিন্তু অর্থহীন। এগুলো কমিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, এ সময়ে এতগুলো প্রকল্প নেয়ার কোনো অর্থ হয় না। এ রকম সময় আইটি, জ্বালানির মতো অত্যন্ত জরুরি কতগুলো অবকাঠামো বাদে বাকিগুলো যদি এডিপি অর্ধেক করে ফেলত, তাহলে ঘাটতিও অর্ধেক কমে যেতো। তিনি বলেন, আমলারা এডিপি তো ঠিক মতো বাস্তবায়ন করে না। সামর্থ্য ও নজরদারির অভাব।
প্রবৃদ্ধি যা ধরা হয়েছে তা হবে না। কারণ বাজেট বাস্তবায়নে ঘাটতি মোকাবেলায় ব্যাংক থেকে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে। ব্যাংকে দুর্নীতি। সরকার যদি ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিয়ে যায় তাহলে বেসরকারি খাতের ঋণ দেয়ার মতো কোনো টাকা থাকবে না। তারা যদি টাকা না পায় তাহলে কিভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হবে। কর্মসংস্থান কিভাবে হবে। কর কিভাবে পাবে।
বাস্তবায়নের বিষয়ে তিনি বলেন, এই বাজেট বাস্তবায়ন হবে না। কঠিন এই চ্যালেঞ্জের সময় বাজেটে হওয়া উচিত ছিল কঠিন কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ। অপ্রিয় হলেও এইটা করা উচিত ছিল সরকারের। সেটা হতো মানুষের ভালোর জন্য, ব্যবসার জন্য। সুখী, সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কোনোটাই তো আপনি পূর্ণ করতে পারবেন না। মানুষ তো সুখী হবে না। সমৃদ্ধ কিভাবে হবে? ব্যবসার জন্য কোনো বিশেষ পদক্ষেপ নেই। তবে স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য আইটি খাতে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। আর সরাসরি বিনিয়োগ কিভাবে আসবে। এখানে ব্যবসার পরিবেশই তো ভালো না। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নেই। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের সাথে সরকারের দীর্ঘসূত্রতা। বাইরের লোক কিভাবে বিনিয়োগে আসবে। দেশের লোকেরাই তো ব্যবসা করে না।


আরো সংবাদ



premium cement