বছর শেষে ফোকলা অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে
- মঈন উদ্দিন খান
- ০৮ জুন ২০২৪, ০২:৩১
দেশের অর্থনীতির পায়ের নিচে এখন মাটি নেই। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট তাই একটি ফোকলা অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সরকার মনে করতে পারে তারা একটি বিশাল অঙ্কের বাজেট দিয়েছে। কিন্তু বিগত বছরের চেয়ে এই বাজেট ৫ শতাংশও বেশি নয়। যদি বিগত অর্থবছরের টাকার মূল্যমানে এটি হিসাব করা হয়, তাহলে ডলারের বিপরীতে বাজেটের আকার দাঁড়াবে পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার কোটিতে। পাশাপাশি দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের শতকরা ৯৭ শতাংশই ভিক্ষে করে আনতে হবে। তাহলে উন্নয়নের নামে কেন আমরা আবার ৪০ বছর আগের সামরিক শাসনের আমলের অসম্মানজনক ঋণের বেড়াজালে পুনরায় আবদ্ধ হয়ে পড়লাম?
২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট এবং দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের এই সিনিয়র নেতা বিএনপি সরকারের বিভিন্ন সময়ে তথ্যমন্ত্রী, বিজ্ঞান ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী এবং পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ড. মঈন খান বলেন, গণতন্ত্র ও সুশাসন ব্যতিরেকে কোনো জাতি কোনো দিন বিশ্বের বুকে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশে বর্তমান শাসকরা যদি ভেবে থাকেন যে ভুয়া বাজেট সাজিয়ে উন্নয়নের জিকির তুলে জাতিকে বিব্রত করে যাবেন, তাহলে সেই পুরনো প্রবাদটিই আবার মনে করেই দিতে হয়। ‘কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য অথবা সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা যায়, তবে সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা যায় না।’
নিচে সাক্ষাৎকারের পুরো অংশ তুলে ধরা হলো
প্রশ্ন : ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আপনার সার্বিক ধ্যান-ধারণা কি?
ড. মঈন খান : এক কথায় বলতে গেলে, এই পুরো বাজেট প্রক্রিয়াটি হচ্ছে এ দেশের দরিদ্র মানুষকে শোষণের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের সাজানো একটি হাতিয়ার। এই কল্পনার ফানুস একদিকে দেশের বর্তমান ধ্বংসপ্রায় দুর্নীতিগ্রস্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নিয়ে এবং অন্য দিকে গণমানুষের চলমান ত্রাহি ত্রাহি অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে এক নিষ্ঠুর খেলা মাত্র। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তায় এ বাজেট দেয়া না দেয়ার কোনোরকম সম্পর্ক তো নেইই, বরঞ্চ এই অলিগার্কিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের নির্বাচন নাটকের পরে আগামী বছরের এই বাজেট জনগণকে নিয়ে আরও একটি করুণ ও হৃদয়বিদারক প্রতারণার কথাই মনে করিয়ে দেয়।
প্রশ্ন : বলা হচ্ছে, এটি বিশাল অঙ্কের এক বাজেট। আপনার মন্তব্য কি?
ড. মঈন খান : প্রথমত: আগামী বাজেট বিশাল অঙ্কের সরকার সেটা মনে করতে পারবে না। কারণ বিগত বছরের চেয়ে এই বাজেট ৫ শতাংশও বেশি নয়। যেখানে বিগত বছরগুলোতে পরবর্তী বছরের বাজেট গড়ে ১১ শতাংশ করে বেড়েছিল। এবার নমিনাল যে পরিমাণ বেড়েছে, সেটাও আগামী বছরের শেষে গিয়ে দেখতে হবে সত্যিকার বৃদ্ধি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, কেননা এই বাজেট আসলে এবার একটি ফোকলা অর্থনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আর যদিও প্রস্তাবিত বাজেট আজকের টাকার অঙ্কে দাঁড়িয়েছে প্রায় আট লাখ কোটি টাকার মতো, তবে বলা বাহুল্য যদি এক বছর আগের টাকার মূল্যমানেও ধরা হয় তাহলে আজ সেটা সত্যিকার অর্থে বিগত বছরের হিসাবে দাঁড়াবে পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার কোটিতে। বাজেটের আকার নিয়ে এর চেয়ে বেশি কোনো মন্তব্য বোধ হয় আর নিষ্প্রয়োজন। একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাকিয়ে বলতে হয়, দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেটের শতকরা ৯৭ শতাংশই ভিক্ষে করে আনতে হবে। তাহলে উন্নয়নের নামে কেন আমরা আবার ৪০ বছর আগের সামরিক শাসনের আমলের অসম্মানজনক ঋণের বেড়াজালে পুনরায় আবদ্ধ হয়ে পড়লাম?
প্রশ্ন : ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর টানা চতুর্থ মেয়াদের জন্য ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটি প্রথম বাজেট। সাধ এবং সাধ্যের সাথে লড়াই চালিয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষের জন্য এ বাজেট কতটা সুখবর দিচ্ছে?
ড. মঈন খান : আমি আগেই বলেছি, এই বাজেট আসলে শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সাত লাখ ৯৭ কোটির মধ্যে দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটিই ঘাটতি! অর্থাৎ পুরো বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘাটতি এবং এটা মেটানোর প্রস্তাব করা হয়েছে কোথা থেকে? অভ্যন্তরীণ দেড় লাখ কোটি ও বৈদেশিক এক লাখ কোটি টাকার ঋণ নিয়ে। তাহলে কী হলো? ওই যে কথায় বলে না যে, কৈর তেলে কৈ ভাজা ? সরকার ঋণ নিয়ে তা থেকে আবার আগের ঋণ মেটাতে ফন্দি এঁটেছে। প্রশ্ন হলো, এই ঋণ কোন কোলাটেরালের বিপরীতে আসবে তার কোনো উল্লেখ নেই। মানি, সরকার বলবে কোলাটেরাল লাগে না, সরকার নিজেই কোলাটেরাল। হ্যাঁ, সেটা স্বাভাবিক অবস্থায় হয়ে থাকে, কিন্তু এই দেউলিয়া সরকারের ওপর কার আস্থা আছে যে লাখ লাখ কোটি টাকা আকাশ থেকে ঋণ দেবে ? ফলে যা হবার তাই হবে। বছরের শেষে গিয়ে দেখতে পাবেন অর্থনীতি কিভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে। মাশুল তো আর সরকারের সুবিধা ভোগীদের দিতে হবে না, মাথা কুটে মরবে দেশের দরিদ্র জনগণ!
প্রশ্ন : ডলার সঙ্কট, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, ব্যাংকিং খাতের অবস্থা নাজুক, এরকম নানা সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এরকম অবস্থা কেন হলো? মূল সমস্যা কোথায়?
ড. মঈন খান : নির্বাচনী ধুয়া তুলে সরকার মানুষকে যতই ধোঁকা দিক না কেন, এখন দেশের অর্থনীতির পায়ের নিচে যে মাটি নেই সেটা আর ঢাকার উপায় নেই সরকারের। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিচ্ছি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আজ ১৩ বিলিয়ন ডলারের তলানিতে এসে ঠেকেছে। আর এটা তো হবেই, যখন সরকারের সুবিধাভোগীরা নিজেরাই এক একজন লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেয়। গ্রাহকরা ব্যাংকে গিয়ে চেক ভাঙাতে গেলে ম্যানেজাররা হাত কাঁচুমাঁচু করে বলে, জনাব আপনি দয়া করে কাল আসবেন, আমি আপনার টাকাটা ঠিক মিটিয়ে দেবো। এর চেয়ে মারাত্মক অর্থনীতির অবস্থা আর কী হতে পারে? মূল্যস্ফীতির কথা আর কি বলবো। জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের সম্পূর্ণ নাগালের বাইরে। সরকার নিজেই স্বীকার করেছে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, আপনারা যারা নিজে বাজারে যান তারা জানেন, বিগত এক বছরে সেটা শতকরা ৫০ শতাংশেরও বেশি ছাড়িয়ে গিয়েছে। ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্সের দেয়া সংখ্যার ওপর কতটুকু ভরসা করবেন তা আর নাই বা আলাপ করলাম। আর তারাই বা কি করবেন সত্যিকার ফিগারগুলো প্রকাশ করলে তাদের কারোরই কি চাকরি থাকবে? এরকম কেন হলো সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে? রক্ষক যদি ভক্ষক হয় তাহলে তো এটাই পরিণতি, সে বিষয়ে কি কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে? সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এ দেশকে কব্জা করে ফেলেছে, যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে সে একই উত্তর দেবে। মূল সমস্যা একটি জায়গাতেই। সেটা হচ্ছে, সুশাসনের অভাব আর জবাবদিহিবিহীন সরকার ব্যবস্থা। এর কোনো আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেবার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই।
প্রশ্ন: অর্থনীতির এমন সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় কি?
ড. মঈন খান : এই সঙ্কট অতি মারাত্মক, কিন্তু এই মারাত্মক সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথটি কিন্তু অত্যন্ত সহজ। এক কথায় বলতে গেলে দেশকে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে মুক্ত করতে হবে। তার উপায় কি? দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সীমাহীন দুর্নীতি আর চরম দুঃশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করে আনতে হবে। একটি জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে অবিলম্বে, যেটা একমাত্র সম্ভব কেবল একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমেই।
প্রশ্ন: সু-অর্থনীতির জন্য সুশাসন কতটা জরুরি?
ড. মঈন খান : আমরা আজকাল দেখছি, একটি মজার তত্ত্ব বেশ প্রচলিত হচ্ছে, সেটা কি? আগে আমরা উন্নয়ন করি, পরে গণতন্ত্রের বিষয়টি দেখা যাবে। দেশ পরিচালনায় এর চেয়ে বড় ধাপ্পাবাজি আর হতে পারে না। দেশের ১৮ কোটি মানুষকে এভাবে প্রতারিত করে বন্দুকের জোরে দেশের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার এই যে অপচেষ্টা তা থেকে এই জাতিকে বেরিয়ে আসতে হবেই। গণতন্ত্র ও সুশাসন ব্যতিরেকে কোনো জাতি কোনো দিন বিশ্বের বুকে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
প্রশ্ন: বৃহৎ দল হিসেবে বিএনপি দেশের চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটে কী ভূমিকা রাখতে পারে?
ড. মঈন খান : যে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল লাখ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, সে দেশে আমরা গণতন্ত্র আবার ফিরিয়ে আনবই। এ দেশে আবার বাজেট প্রণীত হবে এ দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই। বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছে জনগণের দল বিএনপির এটাই অঙ্গীকার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা