লোহার খাঁচার কাঠগড়ায় দাঁড়ালেন ড. ইউনূস
অভিশপ্ত জীবনের একটা বড় পর্যায়ে পৌঁছে গেছি- ০৩ জুন ২০২৪, ০০:০০
শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলের ২৬ কোটি টাকা আত্মসাতে অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি শেষ হয়েছে। দুদকের পক্ষে অভিযোগ গঠনের আবেদন এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্য আসামিদের পক্ষে অব্যাহতি চেয়ে আবেদনের শুনানি গ্রহণ করে আদালত আগামী ১২ জুন আদেশের দিন ধার্য করেছেন। গতকাল রোববার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেনের আদালত উভয়পক্ষের দীর্ঘ শুনানি গ্রহণ শেষে ১২ জুন আদেশের জন্য রাখেন।
লোহার খাঁচার তৈরি আদালতের কাঠগড়ায় ড. ইউনূস : এ দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আদালতে আসেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সকাল ১০টায় ৪২ মিনিটে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেনের আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দুদকের মামলার কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় আদালত ড. ইউনূস বাদে অন্য আসামিদের আদালতে স্থাপিত লোহার খাঁচার কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে বলেন। তখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্য আসামিদের সাথে আদালতে স্থাপিত লোহার খাঁচার কাঠগোড়ায় দাঁড়ান। এ সময় ড. ইউনূসের আইনজীবীরা তাকে বলেন, আপনাকে নয়, অন্যদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে বলেছে। তবে ড. ইউনূস বলেন, অসুবিধা কি সবাই দাঁড়ালে আমিও দাঁড়াই। এরপর বেলা ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে আদালত সবাইকে বসতে বলেন। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্য সবাইকে নিয়ে আদালতে থাকা সিটে বসেন।
অন্য দিকে বেলা আড়াইটার দিকে আদালত থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ড. ইউনূস। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিশপ্ত জীবনের একটা বড় পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। সেটা বুঝলাম যে এই অভিশাপ অনেক ওপরে নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, অভিশপ্ত জীবনেও একটি শীর্ষ বিন্দু আছে। আজ সে রকম একটা শীর্ষ বিন্দুতে। এই প্রথম লোহার খাঁচায় কাঠগড়াতে দাঁড়ালাম। এটা একটা দেখার মতো দৃশ্য। এটা আমার জীবনের একটা স্মরণীয় ঘটনা যে লোহার খাঁচার ভেতরে দাঁড়িয়ে আছি, আদালতের কাঠগড়ায়। এটি অভিশপ্ত জীবনের একটা অংশ।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আদালত থেকে বের হয়ে বলেন, আমরা নোবেল পুরস্কারের কথা সবাই জানি। দুটো নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। একটা আমার নামে, আরেকটা গ্রামীণ ব্যাংকের নামে। দুটোরই সমান মর্যাদা। এটা যৌথভাবে দেয়া হয়েছে তা-ও না, দুটোই ইনডিপেন্ডেন্ট। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো নজির নাই যে, এক নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে আরেক নোবেল বিজয়ী মামলা করেছে, দুদকে হাজির হয়েছে। এটা আমাদের কপালে হয়েছে, এটা অভিশাপের একটা অংশ। এই অভিশাপ আমরা বহন করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, বিষয়টা এমন হয়েছে যে পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মতো দুই নোবেল বিজয়ী, আমার কারণে যেটা সৃষ্টি হয়েছে। নোবেল পুরস্কার পেয়েছে, সেটাও আমার সাথে সম্পৃক্ত থেকে; কিন্তু তারা আমার বিরুদ্ধে এমনভাবে নিয়ে আসল, খুব কঠিন ভাষায়, রূঢ় ভাষায় আক্রমণ করল। তিনি আরো বলেন, অভিযোগ থাকতে পারে; কিন্তু রূঢ় ভাষায় আক্রমণ করে অভিযোগ করল, যে অভিযোগের ভিত্তি নেই। ঘটনার মধ্যে কোনো সত্যতা তো নেই, যে জিনিস দিয়েছিলাম, সেটার জন্যই আমাকে অভিযুক্ত করা হলো যে অনেক টাকা মেরে দিয়েছি ইত্যাদি।
ড. ইউনূস বলেন, এ পর্যন্ত যত অভিযোগ এসেছে আমার বিরুদ্ধে এবং আমার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে, এটা আমার মনে কঠিনভাবে দাগ কেটেছে। কষ্ট লেগেছে কারণ আমার পরিবারকে আক্রমণ করেছে। কেন আমাদের এ অভিশাপ বহন করতে হচ্ছে- সেটা আমাদের আইনজীবী বলবেন।
এর আগে রোববার সকাল পৌনে ১১টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল শুনানি করেন। তিনি ড. ইউনূসসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করার আবেদন করেন।
বেলা সোয়া ১১টায় দুদকের আইনজীবীর শুনানি শেষ হওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন শুনানি শুরু করেন। বেলা ১টা ২৬ মিনিটে ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন শুনানি শেষ করেন। তিনি বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে ড. ইউনূসসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে করা এ মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চান। এরপর অন্য আসামিদের পক্ষে আইনজীবী মো: শাহীনুর ইসলাম শুনানি করেন। এ ছাড়া মামলার আসামি অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী নিজেই অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদনের শুনানি করেন।
উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত ১২ জুন আদেশের দিন ঠিক করেন।
আদালতে ড. ইউনূসের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন। সাথে ছিলেন ব্যারিস্টার খাজা তানভীর আহমেদ ও অ্যাডভোকেট এস এম মিজানুর রহমান। অন্য দিকে দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। এর আগে গত ২ মে এ মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। একই সাথে তাদের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য ২ জুন দিন ধার্য করেন। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক সৈয়দ আরাফাত হোসেন এ আদেশ দেন।
এর আগে গত ২ এপ্রিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আমলে নেন আদালত। একই সাথে ২ মে এ মামলার অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করা হয়। ঢাকা মহানগর সিনিয়র বিশেষ জজ মোহাম্মদ আস সামছ জগলুল হোসেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র আমলে নেন। একই সাথে মামলাটি বিচারের জন্য বিশেষ জজ আদালত-৪-এ বদলির আদেশ দেন। এর আগে গত ৩ মার্চ ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালতে তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। আদালত উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ড. ইউনূসসহ সাতজনের জামিন মঞ্জুর করেন। একই সাথে এ মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য ২ এপ্রিল দিন ধার্য করেন আদালত।
গ্রামীণ টেলিকমের কর্মীদের লভ্যাংশের ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে করা এই মামলায় গত ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ আছাদুজ্জামানের আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। অন্য দিকে গত ২৯ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দেয়া হয়।
চার্জশিটভুক্ত ১৪ আসামি হলেন- গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম, পরিচালক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফুল হাসান, পরিচালক পারভীন মাহমুদ, নাজনীন সুলতানা, মো. শাহজাহান, নূরজাহান বেগম ও পরিচালক এস এম হাজ্জাতুল ইসলাম লতিফী, অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী, অ্যাডভোকেট জাফরুল হাসান শরীফ, গ্রামীণ টেলিকম শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মো: কামরুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ মাহমুদ হাসান, শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের দফতর সম্পাদক কামরুল হাসান ও প্রতিনিধি মো: মাইনুল ইসলাম।
দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদি হয়ে গত বছরের ৩০ মে মামলাটি করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আসামিরা ২৫ কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে, যা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অপরাধ।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা