মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিকদের অবদানের কথা অনুপস্থিত
নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তরালে-৯- শাহেদ মতিউর রহমান
- ২৯ মে ২০২৪, ০০:০০
নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক আলোচনায় যুদ্ধের প্রধান বীর সেনাদের ভূমিকা ও তাদের অবদানের কথা বর্ণনায় কার্পণ্য করা হয়েছে। শুধু তাই নয় অনেক স্থানে বীরত্বগাঁথা যুদ্ধে অংশ নেয়া বীরদের কথা অনেক অনেক আলোচনায়ও অনুপস্থিত। ষষ্ঠ শ্রেণীর ৯৪ পৃষ্ঠায় একটি বর্ণনায় শরণার্থীদের বর্ণনা, গেরিলা যুদ্ধ, প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক যোগাযোগ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা করা হলেও যুদ্ধের অগ্রনায়ক বীরশ্রেষ্ঠ ও বীর সেনাদের ভূমিকা ও তাদের অবদানকে সেভাবে আলোচনায় আনা হয়নি। আবার ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে যেভাবে বিষয়টিকে পাঠ্যপুস্তকে স্থান দেয়া হয়েছে তাতেও কিশোর-কিশোরী শিক্ষার্থীদের অনেক তথ্য জানার ক্ষেত্রেও গ্যাপ তৈরি হবে।
সপ্তম শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ‘আমাদের এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে অধ্যায়ে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাসকে পাশ কাটিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের আলোচনাই বেশি করা হয়েছে। অপর দিকে ক্লাস সিক্সের ৯৬ পৃষ্ঠায় এক কোটি শরণার্থী বিষয়ে বলা হয়েছে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার শুরু করে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় তখন নিরুপায় হয়েই বহু মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ইতিহাসের ভাষায় এরাই ৭১ এর শরণার্থী। এদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, নানাভাবে সহায়তাও করেছেন। এই অধ্যায়ে আরো বলা হয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ত্রিপুরা রাজ্য সরকার এবং এসব অঞ্চলের মানুষজন শরণার্থীদের যেমন নানাভাবে সাহায্য করেছেন, তেমনি বাড়তি মানুষের চাপও তারা সয়েছেন। ফলে শরণার্থীদের ত্যাগ এং সহায়তাকারীদের অবদান এই দু’টি বিষয়ই আমাদের কৃতজ্ঞতার সাথে মনে রাখতে হবে।
অপর দিকে ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১৭৬নং পৃষ্ঠায় ‘শরণার্থী : ১৯৭১’ অধ্যায়ে বলা হয়েছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের নৃশংসতার হাত থেকে রক্ষা পেতে এ দেশের মানুষ বিভিন্ন পথে শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রায় ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) শরণার্থীকে আশ্রয়, খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করে। তবে পরবর্তীতে ভারতের এই সাহায্য সহযোগিতার বিষয়ে কিছু প্রশ্ন উঠে। যেমন এ বিষয়ে হায়দার আকবর খান রনো তার লেখা বই ‘শতাব্দী পেরিয়ে’ আত্মজীবনীমূলক বইয়ে লিখেছেন, তিনি একবার ভারতে গিয়ে শরণার্থীশিবিরে কি হয় তা দেখেছেন। তিনি তার সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে, প্রায় কয়েক মাইল পথ হেঁটে আমি ছোট একটি বাজারে গিয়ে পৌঁছলাম। ওই ছোট বাজারের যা লোকজন তার চারগুণ বেশি ছিল শরণার্থী। তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। বাজারে কোনো খাবার নাই। আমরা সবাই ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত। একটি টিউবওয়েল আছে। পানির জন্য দীর্ঘ লাইন। আমি একটি পাত্র হাতে জাফর ভাইয়ের (প্রয়াত কাজী জাফর আহমেদ) দুই বছরের মেয়ে জয়াকে কোলে করে লাইনে দাঁড়ালাম। প্রায় চল্লিশ মিনিট পর টিউবওয়েলের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি। আত্মজীবনীমূলক এই লেখায় শরণার্থীদের খাবার সঙ্কটের কথাটি স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। অপর দিকে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির জন্য প্রতিদিন বরাদ্দ করা হতো ৩০০ গ্রাম চাল, ১০০ গ্রাম আটা, ১০০ গ্রাম ডাল, ২৫ গ্রাম ভোজ্যতেল এবং ২৫ গ্রাম চিনি। কিন্তু এসব ত্রাণসামগ্রী ঠিকমতো সবার কাছে পৌঁছত না বলেও অভিযোগ উঠে।
যুদ্ধপরবর্তী অনেক বর্ণনায় শরণার্থীদের খাবার ও বিশুদ্ধ পানির শঙ্কটের কথাও উঠে এসেছে। আর এর প্রমাণ পাওয়া যায় যুদ্ধপরবর্তী বেশ কিছু বিদেশী পত্রিকার প্রবন্ধ ও বিদেশী সাংবাদিকদের লেখার মাধ্যমেও।
শরণার্থীদের কলেরায় মৃত্যুর হার বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালের ২১ অক্টোবর দ্য ল্যানসেট-এ। নিবন্ধটি লিখেছিলেন সেভ দ্য চিলড্রেনের বৈদেশিক ত্রাণ ও কল্যাণ বিভাগের তদানীন্তন কর্মকর্তা জন সিম্যান। তিনি ১৯৭১ সালের অক্টোবর নভেম্বর মাসে কলকাতার সল্টলেক শরণার্থী শিবিরের প্রতি সাত পরিবারের পরপর একটি পরিবারের সমীক্ষা করেন এবং জুন মাস থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শিবিরের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করেন। এতে তিনি দেখতে পান সল্টলেক শিবিরে এক লাখ ৭০ হাজার শরণার্থীর মধ্যে মৃত্যু ঘটেছে ৪ হাজারের। এই মৃত্যুহার বিবেচনা করে সিম্যান বলেছিলেন, ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীর মৃত্যুর সংখ্যা হবে দুই লাখের মতো। অপর এক বর্ণনায় এসেছে শুধু সল্টলেক নয়, ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে আশ্রিত শরণার্থীদের ভেতরে কলেরার প্রকোপ হয়েছিল আরো ভয়াবহ। দিনে ৭০-৮০ জন থেকে শুরু করে কোনো কোনো দিন ৩০০ জন পর্যন্ত মানুষ মারা গেছেন কলেরা ও পেটের অন্যান্য অসুখে। বাংলাদেশী শরণার্থীদের কলেরায় মৃত্যুর হার বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেন ডক্টর দিলীপ মহলানবিস জনস হপকিনস মেডিক্যাল জার্নালে ১৯৭৩ সালে। সেখানে তিনি কলেরা এবং কলেরাসদৃশ রোগে মৃত্যুহার ৩০ শতাংশ বলে উল্লেখ করেছেন। তথ্য সূত্র : (Oral fluid therapy of cholera among Bangladesh refugees; D Mahalanabis, A B Choudhuri, N. G. Bagchi, A.K. Bhattacharya and T. W. Simpson, The Jhons Hopkins University, centre for medical Research and training, Calcutta, India: The johns Hopkins Medical Journal, volume 132 pp 197-205)
একই সাথে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত নতুন কারিকুলামের পাঠ্যপুস্তকে যেসব বিষয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ বা অধ্যয়নের জন্য আলোচনা করা হয়েছে সেখানে মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান, সেক্টর কমান্ডার এবং বীরশ্রেষ্ঠদের জীবনী সম্পর্কে তেমন কোনো বর্ণনাই নেই। অথচ তারাই (মুক্তিযোদ্ধারাই) জীবন বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করেছেন। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দিয়ে বা তাদের অবদানকে গৌণ করে অন্যসব বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা অথবা অন্যদের মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করা আমাদের মূল ইতিহাসের মৌলিক বর্ণনায় ত্রুটি বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন।
ইতিহাসবিদগণের মতে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী কারোর অবদানকেই আমরা ছোট করে দেখতে চাই না। তবে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে চাই আমাদের বীর সেনানিদের। যাদের আত্মত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধের শ্রেষ্ঠ বীর সৈনিক, বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীকদের এই অবদানকে কোনোভাবেই গুরুত্বহীন করা বা কম গুরুত্ব দেয়া আমাদের সমুচীন নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বীরদের আমরা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কম গুরুত্ব দিয়ে মূলত আমাদের নতুন প্রজন্মকেই মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করছি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা