১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মুসলমানদের বানানো হয়েছে ভিনদেশী দখলদার শাসক

নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তরালে-৭
-


নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে মুসলমানদের আসল পরিচয়ই আড়াল করা হয়েছে। ইতিহাসের বর্ণনায় বরাবরই মুসলমান শাসকদের ভিনদেশ থেকে আগত বহিরাগত ও দখলদার শাসক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ১১২ পৃষ্ঠায় একটি অধ্যায়ে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের এই অধ্যায়ে মুসলমানদের বাইরে থেকে এ দেশে এসে যুদ্ধ করে দখল করার ঘটনা বর্ণনা করে মুসলমানদের বহিরাগত প্রমাণ করার কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। একই অধ্যায়ে বখতিয়ার খলজিকে বলা হয়েছে ভাগ্যন্বেষী তুর্কি-আফগান শাসক।
পাঠ্যবইয়ের অপর এক জায়গায় মুসলিম শাসকদের নিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে কয়েকটি ভুল ও আপত্তিকর শব্দ। যেমন বলা হয়েছে ‘বাইরে থেকে যুদ্ধ করে দখল করা’ ইত্যাদি। ক্লাস নাইনের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ১০১ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে ১২০০ সালের পর থেকে বখতিয়ার খলজি একজন ভাগ্যান্বেষী তুর্কী আফগান বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার প্রদেশের একাংশে রাজ্য বিস্তার করেন। তিনি রাজ্য বিস্তারের জন্য সেন রাজ্যে এসে উপস্থিত হলে রাজা লক্ষ্যণ সেন বিক্রমপুরে (বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলা) অবস্থিত রাজধানীতে ফিরে আসেন বলে জানা যায়। লক্ষণ সেন আরো কিছুকাল বাংলার পূর্বাংশে শাসনক্ষমতা পরিচালনার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১২২০ সালে তিনি মধ্য এশিয়া থেকে আগত। (ক্লাস নাইন, পৃষ্ঠা ১০১)

অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে আলাউদ্দীন হোসেন শাহ বহুদূর থেকে এসে ভারতের পূর্বপ্রান্তে এসেছিলেন। (এখানেও আলাউদ্দীন হোসেন শাহকেও পরদেশী বলা হয়েছে)। আবার বলা হয়েছে ইলিয়াস শাহী বংশের পর বাংলার ইতিহাসে আরেকটি বংশধরের শাসন দেখা যায়। এটি হলো শাহী বংশ। অপর বর্ণনায় বলা হয়েছে আবিসিনীয় হাবসী ক্রীতদাস প্রায় ছয় বছর বাংলার রাজক্ষমতায় ছিলেন। একেকজন শাসককে হত্যা করে অন্য একজন শাসক ক্ষমতায় এসেছিলেন। হাবসী ক্রীতদাসের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে ১৪৯৩ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন আলাউদ্দীন হোসেন শাহ। বহুদূরের ভুখণ্ড থেকে ভারত বর্ষের পূর্বপ্রান্ত অর্থাৎ বাংলা অঞ্চলে এসেছিলেন। তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন মধ্য এশিয়ার অধিবাসী। যাহোক ক্ষমতা অধিকার করে হোসেন শাহ গোলযোগ সৃষ্টিকারি হাবসী ক্রীতদাস ও তাদের অনেককেই হত্যা করেন। এবং বাকিদের বিতাড়িত করেন। রাজ কাজে সহায়তা করার জন্য তিনি তথাকথিত উচ্চ বংশ অভিজাত ও শিক্ষিত মুসলমান এবং হিন্দুদের নিয়োগ দান করেন। হোসেন শাহ একজন সা¤্রাজ্য সম্প্রসারণবাদী শাসক ছিলেন। নিজের রাজ্য সীমা বৃদ্ধি এবং ধন সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে তিনি কামরুপ, কামতা, বিহার ও উড়িষ্যার দিকে বারংবার যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেছেন।

এখানে যেভাবে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে তাতে আমাদের নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস তো জানতেই পারবে না বরং মুসলিম শাসকদের সম্পর্কে তাদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হবে। তারা শিখবে জানবেও ভুল। বিশেষ করে উপরে বর্ণিত ঘটনা ঐতিহাসিকভাবে মিথ্যা না হলেও এর উদ্দেশ্য কিন্তু খারাপ। শুধু বখতিয়ার খলজি না সব মুসলিম শাসকদের ক্ষেত্রেই বহিরাগত, বহুদূরের, এমন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো মুসলিম শাসন শুরু হওয়ারও আগে এ অঞ্চলে মুসলিম জনবসতি ও ইসলামের ব্যাপক পচার প্রসার শুরু হয়। অধিকাংশ মুসলিমের পূর্বপুরুষই এ অঞ্চলে বহিরাগত নন। বরং ভূমিপূত্র। বহিরাগত যারা এসেছেন তারাও স্থানীয় জনগণের সাথে সামাজিক ও নিতান্তিকভাবে মিলে গেছেন।
ড. দীনেশ চন্দ্র সেন লিখেছেন হিরা কয়লা খনির মধ্যে থেকে যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকাইয়া থাকে যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করে থাকে বঙ্গভাষা তেমনি কোনো শুভদিন শুভক্ষণের জন্য প্রতিক্ষা করতে ছিল মুসলাম বিজয় বাঙ্গালা ভাষার সেই শুভ দিন শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হয়ে গেল। তাহারা ইরান তুরান যে দেশ থেকে আসুন না কেন বঙ্গদেশ বিজয় করে বাঙ্গালি সাজিলেন। (তথ্য সূত্র: শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেন বঙ্গভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব সওগাত ১৩৩৫ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত।)
সবচেয়ে ন্যক্কারজনক বিষয় হলো এ অংশে বাংলার যেসব মুসলমান শাসকদের কথা বলা হয়েছে এরা আরব পারস্য থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। এরা সকলেই এই মাটিরই সন্তান। বাংলার আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা এদের শরীরে বাঙ্গালি রক্ত। মুসলমান নাম দেখলেই বহিরাগত ভাবার কোনো সুযোগ নেই।

ইতিহাস পর্যালোচনায় উঠে এসেছে আলাউদ্দীন হোসেন শাহের মতো জনদরদি ও হিন্দুদের কাছে জনপ্রিয় এমন শাসককেও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অপর এক বর্ণনায় হুসেন শাহের অবদানকে খাটো করা হয়েছে। (ক্লাস নাইন পৃষ্ঠা ১০১।) আবার সপ্তম শ্রেণীর ৬৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে মুসলিম শাসকদের প্রাচীন ইতিহাসেই নাকি বলা হয়েছে তুরুস্কাস, যবন, তাজিক ইত্যাদি। যদিও মুসলমান শাসকদের নামের সাথে এসব বিশেষণ নিঃসন্দেহে আপত্তিকর ও নিন্দনীয়।
ক্লাস নাইনের বইয়ের একটি অধ্যায়ে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, ইসলামকে বলা হচ্ছে আরব ও পারস্যের ধর্ম। অর্থাৎ মুসলিমদেরকে বহিরাগত এবং ইসলামকে বহিরাগত কালচার প্রমাণের শত চেষ্টা করা হয়েছে বইটিতে। (ক্লাস নাইন পৃষ্ঠা ১০৩)।
একটু সজাগ দৃষ্টি খুলে দেখলেই অনুমান করা যাবে যে, বাংলা অঞ্চলে বৃহৎ একটি অংশে যেসব শাসনকর্তা শাসন করেছে তাদের প্রায় সবাই ছিলেন আরব ও পারস্যের ইসলাম ধর্মের সংস্কৃতির অনুসারী ও অভিজাত মুসলমান। এরা এক দিকে নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দে্ব লিপ্ত ছিলেন। অন্য দিকে দিল্লির মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধেও দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়ে নিজেদের শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন। ক্ষমতার এই টানাপড়েনে বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কোনো ভূমিকা ছিল না তা বলাই বাহুল্য। সপ্তম শ্রেণীর ৭০ পৃষ্ঠায় যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে তা সঠিক ইতিহাসের অপলাপ মাত্র। বলা হয়েছে মুসলিম শাসকরা ছাড়াও বিপুল জনগোষ্ঠীও যে এক সময় মুসলিম ও ক্ষমতা সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সে কথা অস্বীকার করা হয়েছে।
অপর বর্ণনায় ব্রিটিশদের সাথে মুসলিম শাসনকেও একই কাতারে ফেলে দেয়া হচ্ছে। ব্রিটিশরা হলো কলোনাইজার। তারা সম্পদ পাচার করেছে নিজ দেশে। আর মুসলিমরা এ দেশে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য এসেছেন। তারা মিশে গেছেন স্থানীয় গণমানুষের সাথে। (ক্লাস সেভেন ৭/৭০।)
ইতিহাসবিদদের মতে, মুসলিমরা এদেশে কখনোই বহিরাগত ছিলেন না। আর্যরা যেমন বাইরে থেকে এ দেশে এসে শত শত বছর এই দেশে বসবাস করে দেশীয় নাগরিক হয়ে গেছেন, ঠিক তেমনিই এই প্রক্রিয়ায় মুসলিমরাও এই দেশের নাগরিক। তাদেরকে বহিরাগত বলাটা ইতিহাসের জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম শাসক বা মুসলমানদেরকে বহিরাগত বলা একটা সাম্প্রদায়িক বয়ান মাত্র।

 


আরো সংবাদ



premium cement
র‍্যাবে আয়নাঘর ছিল, স্বীকার করলেন ডিজি আবারো গাজায় অবিলম্বে নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাশ জাতিসঙ্ঘের ডিএসইতে মূল্যসূচক বাড়ল ১৪.৪৮ পয়েন্ট সিরিয়ায় বাশার সরকারের পতনে ইরানি মুদ্রার মান রেকর্ড তলানিতে নারায়ণগঞ্জে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে কলেজেছাত্র আহত তারেক রহমান কবে ফিরবেন, জানালেন মির্জা ফখরুল কালিয়াকৈরে ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা ৫ আগস্টের পর চাঁদাবাজি-ছিনতাইয়ে র‍্যাবের ১৬ সদস্য আটক : ডিজি মিয়ানমারে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী শহর থেকে শত শত সৈন্যসহ জেনারেল আটক শনিবার থেকে শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে’

সকল