পাওয়া যাচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের নাম : নিশ্চিত হলেই গ্রেফতার
৩ জন ৮ দিনের রিমান্ডে, জিহাদ ১২ দিনের হেফাজতে- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৫ মে ২০২৪, ০২:১০
ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে উচ্চ পর্যায়ের বেশ কিছু ব্যক্তির নাম। তাদের মধ্যে অনেকে গা ঢাকা দেয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন বলে জানা গেছে। তবে তদন্তের কারণে ঘটনার পেছনে থাকা এসব রাঘব বোয়ালদের নাম এখনই প্রকাশ করতে চাইছে না দুই দেশের গোয়েন্দারা। মূলত স্বর্ণ চোরাচালান ও হুন্ডি ব্যবসাকে সামনে রেখেই তদন্তে এগোচ্ছে দুই দেশের গোয়েন্দারা। তবে বাদ যাচ্ছে না অন্য বিষয়গুলোও। গোয়েন্দাদের বিভিন্ন পর্যায়ের তদন্তে এসব বিষয় রয়েছে। সে সব নিশ্চিত হওয়ার পরই নামগুলো প্রকাশ্যে এনে গ্রেফতার করা হতে পারে তাদের।
এ দিকে আনোয়ারুলকে অপহরণ মামলায় গ্রেফতার তিন আসামির আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তারা হলেন, সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমান। গতকাল শুক্রবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের হাজির করা হয়। এ সময় মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি প্রত্যেককে আট দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। এ দিকে কলকাতায় ১২ দিনের পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন গ্রেফতার জিহাদ হাওলাদার। গতকাল ভারতের স্থানীয় সময় বেলা ১১টার দিকে তাকে পশ্চিমবঙ্গের বারাসাত জজ কোর্টে তোলা হয়। এর আগে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর জিহাদ নিজের নাম সিয়াম বলে জানান। পরে তার আসল পরিচয় জানা যায়।
এমপি অপহরণ তদন্ত সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্র বলছে, আনোয়ারুল আজিমসহ কয়েকজনের অবৈধ সোনা ব্যবসা রয়েছে। দুবাই কেন্দ্রিক স্বর্নের ব্যবসায় শাহীনসহ কয়েকজনের বিনিয়োগ রয়েছে। এ ছাড়া দেশের একজন ডায়মন্ড ব্যবসায়ীর সাথে আজিম পার্টনার ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হলে আনোয়ারুল আজিমকে বাদ দিয়ে ওই ব্যবসায়ী একাই ডায়মন্ডের ব্যবসা শুরু করেন। নিহত এমপি ভারতে যে গোপালের বাসায় উঠেছিলেন তার সঙ্গেও ডায়মন্ড ব্যবসায়ীর সখ্যতা রয়েছে। এ ছাড়া দুবাই থেকে আসা সোনা আজিম ভারতে বিভিন্নভাবে সরবরাহ করতেন। সূত্রটি জানিয়েছে, কলকাতায় চিকিৎসার নাম করে আনার সেখানে গেলেও আসলে তিনি সেখানে কোনো চিকিৎসা করাননি। সোনা নিয়ে পার্টনারদের মধ্যে গণ্ডগোল দেখা যায়। এই ঝামেলাকে কেন্দ্র করেই হত্যাকাণ্ড হতে পারে। এ ছাড়া সীমান্ত কেন্দ্রিক চোরাচালানের রুট নিয়ন্ত্রণও খুনের আরেক কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। সীমান্তে চোরাচালানের পথঘাট নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের বন্ধুত্বে কয়েক মাস আগে ফাটল ধরেছিল। দুবাই থেকে আসা স্বর্ণের চালান সীমান্ত পার করার বিষয়টি দেখভাল করতেন এমপি আজিম। এ জন্য তিনি নিতেন বড় কমিশন। এই কমিশন বাড়ানো নিয়ে বছরখানেক ধরে সৃষ্টি হয়েছিল দ্বন্দ্ব। এর জের ধরেই আনারকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা হতে পারে। স্থানীয় ও গোয়েন্দা সূত্র মতে, যশোরের চৌগাছা, ঝিনাইদহের মহেশপুর, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত এলাকার চোরাচালানসহ সব কারবারের একক নিয়ন্ত্রণ ছিল আজিমের। সম্প্রতি আনারের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে ও সিন্ডিকেটের আগের পাওনা প্রায় ১০০ কোটি টাকার জন্য তাকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় চোরাচালান মাফিয়ারা।
জানা গেছে, পুরো কিলিং মিশনে সবার সামনে ছিলেন শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানউল্লাহ। হত্যার পর তার হাত-পাসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টুকরো টুকরো করে আলাদা করে হত্যাকারীরা। ৫৮ সেকেন্ডের একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে গেছে, ভারতীয় সময় ১৪ মে বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে দু’জন ব্যক্তি একটি পেস্ট কালারের ট্রলি ব্যাগ ও তিন থেকে চারটি পলিথিন ব্যাগে করে কিছু একটা বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দাদের ধারণা ওই ব্যাগে করেই নেয়া আনারের লাশের টুকরোগুলো ফেলার জন্য নেয়া হচ্ছিল। আর ভিডিওতে যে দু’জনকে বের হতে দেখা যায় তারা হলেন- আমানউল্লাহ ও সিয়াম ওরফে কসাই জিহাদ। সিসি ক্যামেরায় যা দেখা গেছে তা স্বীকারও করেছেন ডিবির হাতে গ্রেফতার আমান। অন্য দিকে ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন কসাই জিহাদ।
জিজ্ঞাসাবাদে আমানের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কীভাবে এমপি আনারকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পর হাত-পাসহ শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে আলাদা করা হয়। যেন কোনোভাবেই আনারের চেহারা দেখে কেউ পরিচয় শনাক্ত করতে না পারে, সে জন্যই খুনিরা এ পরিকল্পনা করে। এরপর একটি ট্রলি ব্যাগ ও তিন-চারটি পলিথিন ব্যাগে করে ১৪ মে বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে বের করা হয়। এরপর এগুলো ফেলে দেয়া হয় কলকাতার হাতিশালা বর্জ্য খালে। আমানের স্বীকারোক্তির পর ভারতীয় পুলিশ ২৩ মে রাতে হাতিশালা বর্জ্য খালে তল্লাশি চালায়। তবে অন্ধকার হওয়ায় সে দিন কিছু খুঁজে পায়নি পুলিশ। গতকাল শুক্রবার আবারো তল্লাশি চালিয়েছে। ডিবির দাবি, যেহেতু হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেফতার রয়েছেন এবং তথ্য দিয়েছেন সেহেতু লাশের সন্ধান মিলবে। নিজের নাম পাল্টে শুরুতে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলেও ব্যাপক জ্ঞিাসাবাদের পর আমান স্বীকার করেন তিনিই শিমুল ভূঁইয়া। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি আমানউল্লাহ নামেই পাসপোর্ট বানিয়েছেন, সেই পাসপোর্টে কলকাতায় গিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকা থেকে পাসপোর্টটি করা হয়েছিল। পাসপোর্ট করতে একই নামে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রও (এনআইডি) তৈরি করেন। কীভাবে তিনি শিমুল ভূঁইয়া থেকে আমানউল্লাহ হলেন এবং ভুয়া পাসপোর্ট ও এনআইডি তৈরি করলেন, এখন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, রাজনৈতিক, আধিপত্য বিস্তার ও অর্থনৈতিক নানা কারণে তিনি খুন হতে পারেন। তাকে হানিট্র্যাপও করা হতে পারে। তদন্ত করা হচ্ছে। সব বিষয় বেরিয়ে আসবে।
গত ১২ মে চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সীমান্ত দিয়ে কলকাতায় যান আনার। প্রথম দিন তিনি তার বন্ধু গোপালের বাসায় থাকেন। পর দিন ১৩ মে কৌশলে এমপি আনারকে নিউটাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যান হত্যাকারীরা। এরপর আমান তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ মিলে এমপিকে চাপাতির মুখে জিম্মি করেন। একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করে অজ্ঞাতস্থানে ফেলে দেয়।
নিউটাউন লাগোয়া ভাঙড়ের খালে ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি
আমাদের কলকাতা প্রতিনিধি জানান, আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডে কসাই জুবের ওরফে জিহাদ হাওলাদারকে বেঙ্গল এফটিএফ বনগাঁ সীমান্ত এলাকা থেকে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করে সিআইডির হাতে তুলে দেয়। গতকাল শুক্রবার জিহাদকে বারাসাত আদালতে হাজির করে সিআইডি ১৪ দিনের হেফাজত চেয়েছিল। বিচারক ১২ দিনের সিআইডি হেফাজত দেন। এরপর এ দিনই জিহাদকে নিয়ে সিআইডি, বিপর্যয় মোকাবেলা দফতর ও পোলেরহাট থানা জিরেনগাছা ও কৃষ্ণমাটি বাগজোলা খালপাড় এলাকায় নিয়ে আসে। জিহাদের বর্ণনা অনুযায়ী সিআইডি জানতে পেরেছে ১৩ মে আনারকে খুন করা হয়। তার পর ১৪ মে একটি অ্যাপ ক্যাবে করে বাগজোলা খালপাড়ের জিরেনগাছা ও কৃষ্ণমাটি ব্রিজের কাছে নির্জন জায়গা দেখে রাতের অন্ধকারে প্লাস্টিক ব্যাগে ভর্তি লাশের টুকরো খালে ছুড়ে ফেলেছিল। এ দিন তারই দেখানো জায়গায় ডুবুরি নামিয়ে তল্লাশি চালানো হয় বাগজোলা খালে। কিন্তু দুই ঘণ্টার ওপর তল্লাশি চালানোর পর সিআইডির টিম কিছুই খুঁজে পাইনি। যেহেতু রাতের অন্ধকারে জিহাদের অপরিচিত ওই জায়গায় ঠিক কোথায় লাশের টুকরো ছুড়ে ফেলেছিল, তা নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। কখনো সে বলে বাঁশগাছের পাশ দিয়ে ছুড়ে ফেলেছি, কখনো সে বলে জঙ্গলে দাঁড়িয়ে প্লাস্টিক প্যাকেট ছুড়ে ফেলেছি। দীর্ঘক্ষণের চেষ্টায় কিছু না পেয়ে সিআইডি টিম এ দিন ফিরে যায়। আজ আবার ওই এলাকায় তল্লাশি চালানো হবে বলে জানা গেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা