১৬ জুন ২০২৪
`

মুসলিম সংস্কৃতির উপর প্রাধান্য হিন্দু সংস্কৃতিকে

নতুন শিক্ষা ক্রমের অন্তরালে
-


নতুন কারিকুলামে শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ের বেশির ভাগ গল্পে হিন্দু সংস্কৃতিকে সচেতনভাবেই মুসলিম সংস্কৃতির উপরে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আমাদের বাঙালি জাতির গোড়াপত্তনের ইতিহাস তথা বহু প্রাণের ত্যাগের ঘটনা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকেও ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলন বা শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে শহীদ মিনারের বেদীতে ফুল দেয়ার রেওয়াজকে হিন্দু মুসলিম সব ধর্মের শিক্ষার্থীর উপর বাধ্যতামূলক করে মুসলিম পরিবারের সন্তানদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে খাটো করা হয়েছে। আবার নৃত্যকলার নামে বাদ্যযন্ত্রসহ নাচ কিংবা গান শেখানোকেও ক্লাসরুমে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নবম শ্রেণীর শিল্প সংস্কৃতি বইয়ে সংস্কৃতি বিষয়ের আলোচনায় বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির ধারাবাহিক আলোচনায় মুসলিম শিক্ষার্থীদের ধর্ম বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করা হয়েছে।
ষষ্ঠশ্রেণীর শিল্প সংস্কৃতি বইয়ের ১০ নং পৃষ্ঠায় আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের ভূমিকায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে বাংলা ভাষা রক্ষার আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যদি এই ভাষা আন্দোলন আমাদের বাংলা ভাষা রক্ষার কোনো মামুলি আন্দোলন ছিল না। প্রকৃত অর্থে ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার একটি যুগপৎ আন্দোলন। এটাই স্বতঃসিদ্ধ সত্য ও প্রকৃত ঘটনা।

আবার একই শ্রেণীর ১২ পৃষ্ঠায় বর্ণনায় বলা হয়েছে ভাষা আন্দোলন তথা শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য ক্লাসের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্কুলে তৈরি শহীদ মিনারের বেদীতে নিজেদের তৈরি ফুলে তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা তারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের স্থান থেকে কোনো বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে না চাইলে তাদের বাধ্য করা যাবে না। কিন্তু নিজ নিজ ধর্মীয় কাজে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ না করে বরং ক্লাসের শিখন কাজের অংশ হিসেবে এসব কাজকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এটা ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে যায় না। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের বিশ্বাস ও আকিদার পরিপন্থী কাজে সব শিক্ষার্থীকে এভাবে বাধ্য করার এখতিয়ার কাউকে দেয়া হয়নি। তবে হ্যাঁ, এসব কাজে বড়জোর শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেয়া যেতে পারে, কিন্তু কাউকে জোর করে বা বাধ্য করা যাবে না। বরং এটা অনেকটা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার শামিল।
নবম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে সংস্কৃতির আলোচনায় বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতির আলোচনায় একপর্যায়ে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া বা যোগ দেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসীদের জন্য এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বা অংশ নেয়া ধর্ম বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। আবার স্কুল থেকে এমন নির্দেশনা শিক্ষার্থীদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপেরও শামিল।

অপর দিকে ষষ্ঠ শ্রেণীর আমাদের শিল্পকলা অধ্যায়ের বর্ণনায় দৃশ্যমান শিল্পকর্মের মধ্যে ভাস্কর্য মৃৎশিল্প এবং চলচ্চিত্রকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আবার অদৃশ্যমান শিল্পকর্মের মধ্যে সংগীত নৃত্য ও অভিনয়ের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ৯১ শতাংশ মুসলমানদের এই দেশে ভাস্কর্য সংস্কৃতি আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে কোনোমতেই যায় না। সোজা কথায় বলতে গেলে এই সংস্কৃতি আমাদের ইমলাম ধর্মের মূল আকীদার পরিপন্থী। এ দেশের সব ওলামা মাশায়েখ ও আলেমরা এ মর্মে একমত যে, ভাস্কর্য সংস্কৃতি আমাদের ইমলাম ধর্ম সমর্থন করে না। সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে দেশজুড়ে আন্দোলন সংগ্রামও হয়েছে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে পাতায় পাতায় আমাদের ধর্ম বিশ্বাসের পরিপন্থী এই বিতর্কিত বিষয়গুলো জুড়ে দিয়ে কোমলমতি শিশুদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়েছে।
যদিও বিতর্কিত এই ভাস্কর্য নিয়ে প্রসিদ্ধ হাসিদ গ্রন্থে বহু হাদিসে বিশদ বিষয়ে বর্ণনা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের বর্ণনায়, তিনি (ইবরাহীম আ.) বললেন, ‘তোমরা তো মূর্তিগুলোকে আল্লাহর পরিবর্তে গ্রহণ করেছ কেবল পার্থিব জীবনে পারস্পরিক বন্ধুত্ব বজায় রাখার জন্য। কিন্তু কিয়ামতের দিন তোমরা একে অপরকে অস্বীকার করবে এবং একে অপরকে অভিসম্পাত দিবে। তোমাদের আবাস হবে জাহান্নাম এবং তোমাদের কোনো সাহায্যকারী থাকবে না।’ -সূরা আনকাবূত (২৯) : ২৫
অপর এক বর্ণনায় বলা হয়েছে, আমি কি তোমাকে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করব না, যে কাজের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে প্রেরণ করেছিলেন? তা এই যে, তুমি সব প্রাণীর প্রতিকৃতি বিলুপ্ত করবে এবং সব সমাধি-সৌধ ভূমিসাৎ করে দেবে।

অন্য বর্ণনায় এসেছে এবং সকল চিত্র মুছে ফেলবে। -সহীহ মুসলিম, হাদিস ৯৬৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৩২১৮; সুনানে নাসাঈ, হাদিস ২০৩১
মক্কাবিজয়ের সময় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-কে আদেশ দিলেন, তিনি যেন কাবা ঘরের সব প্রতিকৃতি মিটিয়ে দেন। সব ছবি মোছার আগ পর্যন্ত তিনি কাবায় প্রবেশ করেননি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪১৫৬; সহীহ ইবনে হিববান, হাদিস : ৫৮৫৭
সহিহ আল মুসলিমের হাদিস নং: ৮৩২, ৯৬৯ সহীহ আল বুখারীর হাদিস নং: ৫৯৫০, ৭৫৫৭ নং হাদিসের বর্ণনায় এ বিষয়ে আরো অনেক আলোচনা এসেছে। এরপর সহিহ বুখারির ৭৫৫৮, ৫৯৬২ নং সহ আরো অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এ বিষয়ে হাদিসের বর্ণনা পাওয়া যায়।
যদিও ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের বিভিন্ন বর্ণনায় নৃত্য গান ও বাদ্যযন্ত্র বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্য হিসেবে একটি অধ্যায়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। যদিও মুসলিমদের জন্য কুরআন এবং হাদিসের বর্ণনায় এই বাদ্যযন্ত্রকে সরাসরি হারাম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর নায়েবে আমির ও আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশ এর মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী নয়া দিগন্তকে বলেন, পাঠ্যপুস্তকে যেভাবে ইসলাম বহির্ভূত কিছু বিতর্কিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাতে আমাদের সন্তানরা ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে চলে যাবে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনা করে কিন্তু এখানে দেখতে হবে কোন ধর্মের শিক্ষার্থীর হার বেশি এবং সেই অনুযায়ীই পাঠ্যক্রমের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে হবে। আমরা শুরু থেকেই ইসলাম বহির্র্ভূত বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। ইতোমধ্যে আমরা শিক্ষামন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের সময় চেয়েছি। আমরা সাফ জানিয়ে দেব এসব বিতর্কিত বিষয় ও ইসলাম সমর্থনযোগ্য নয় এবং বিষয় পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী বরাবরেও আবেদন করে দেখা করে পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের দাবি জানাব।
ইসলাম ধর্মের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে থাকবে এটা কোনোমতেই মেনে নেয়া যায় না।


আরো সংবাদ



premium cement