সুশাসন জবাবদিহিতা হারিয়ে এখন ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৪ মে ২০২৪, ০১:০২
দেশের আর্থিক খাত ব্যাংকনির্ভর। দেশের উন্নয়নে এ খাতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। অথচ সেই ব্যাংকিং খাতে ভঙ্গুরতা দেখা দিয়েছে। সুশাসন-জবাবদিহিতার হরণ ঘটেছে। ঋণ অনুমোদন, পুনঃতফসিল, অবলোপন সবই নিজেদের মতো করে করা হচ্ছে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যাংক খাতে অলিগার্ক (ব্যাপক অর্থ-বিত্তের অধিকারী) তৈরি করা হয়েছে। এ প্রবণতা আমানতকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। ব্যাংকে আমানত রেখে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানুষ। গত দুই বছরে দেশে মূল্যস্ফীতির হার যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় ব্যাংক আমানতের সুদহার বাড়েনি। ব্যাংকে টাকা রেখে মানুষ মুনাফা তো পাচ্ছেই না, উল্টো ক্ষতি হচ্ছে তাদের।
রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে গতকাল ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সামনে কী অপেক্ষা করছে’ শীর্ষক সিপিডি আয়োজিত সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন। সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় সংলাপে অংশ নিয়েছেন সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতা ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক ব্যাংকার মোহাম্মদ নূরুল আমিন, সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, আইসিসির সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান, সাবেক সিএজি মুসলিম চৌধুরীসহ আরও অনেকে।
মূল প্রবন্ধে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকগুলোর অনুমোদন দেয়া হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে। ব্যাংকিং খাতের উপর মানুষের আস্থা উঠে যাচ্ছে। এই খাতকে ঠিক রাখতে হলে সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেন, ২০১২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ ৪২ হাজার ৭১৫ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। সাথে পুনঃ তফসিল ঋণসহ খারাপ ঋণ যোগ করা হলে তার পরিমাণ তিন লাখ ৭৭ হাজার ৯২২ কোটি টাকায় দাঁড়াবে। অন্য দিকে অর্থঋণ আদালতে ৭২ হাজার ৫৪৩টি মামলার বিপরীতে অনাদায়ী আছে এক লাখ ৭৮ হাজার ২৭৭ কোটি টাকার ঋণ। সেগুলো যোগ করলে মোট অনাদায়ী ও মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ লাখ ৫৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের পরিমাণ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকেও বাড়ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে যে আইনি কাঠামো দরকার, সেটা বাংলাদেশে নেই। ঋণখেলাপির মামলাগুলো সহজে নিষ্পত্তি হচ্ছে না, যথেষ্ট বিচারক নেই সেখানে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাইরের চাপে কিংবা নিজেরা ইচ্ছা করে স্বাধীনভাবে কাজ করছে না। এ অবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। তিনি বলেন, ভুল তথ্য প্রকাশিত হলে নীতি ভুল হয়। উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে রিয়েল টাইম তথ্য দেয়া হয়। অথচ আমাদের এখানে সেটা নিশ্চিত না করে উল্টো তথ্য সংগ্রহের দরজা বন্ধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতে কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। সংস্কার ছাড়া এই খাতকে পুনরুদ্ধার সম্ভব না। আর এসবের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
সিপিডি বলছে, ব্যাংকগুলোর সব তথ্য জনসন্মুখে প্রকাশ পাচ্ছে না। যারা প্রকাশ করে না, তারা লক্ষ্য পূরণ করতে পারে না। যতটুকু প্রকাশিত হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। আর একটি বিষয় হচ্ছে তথ্যের দরজা ক্রমান্বয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া। আমরা তথ্যের জন্য মিডিয়ার ওপরে নির্ভর করতাম, সেটাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তথ্যের অভাবের কারণে ভুল নীতি গৃহীত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। দুর্বল ও সবল ব্যাংক একীভূতকরণ প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, সরকারি ব্যাংকগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার থেকে বহুবার অর্থ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকে বার বার দেয়া হচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংক পদ্মা ব্যাংককে টেনে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সেটা রক্ষা হয়নি। এরূপ অবস্থায় সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়া এগিয়ে যদি নিতেই হয়, তাহলে পৃথিবীর স্বনামধন্য এসেসমেন্ট কোম্পানিকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিয়ে আসুন। তারা বলেন, যদিও বাংলাদেশের ব্যাংকিং স্বাস্থ্য বিবেচনায় নিলে তারা আগ্রহী হবে কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। আর মার্জ করার বিষয়ে যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সেটা যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কি না দেখা দরকার।
সিপিডির হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যাংক আমানতের প্রকৃত সুদহার ছিল শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। মার্চে তা শূন্যের কোঠায় নামার পর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকৃত সুদহার ঋণাত্মক। ২০২২ সালের আগস্ট ও ২০২৩ সালের মে মাসে তা সর্বোচ্চ মাইনাস ৫ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত নেমেছিল। এরপর মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে তা সব সময় ওঠানামা করেছে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তা ছিল মাইনাস ৪ দশমিক ৭ শতাংশ।
সুদহার ছয়নয় করার পর ঋণের সুদহারের পাশাপাশি আমানতের সুদহারও কমে গিয়েছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৮ আগস্ট মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে মেয়াদি আমানতের সুদহার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন বলা হয়, আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম হবে না। কিন্তু অনেক ব্যাংকই তা দিতে পারেনি। এরপর ঋণের সুদহারের সীমা তুলে নেয়া হয় এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আমানতের সুদহারের সীমাও তুলে নেয়া হয়। এরপর ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহারও বাড়িয়েছে। এখন আবার অনেক ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করতে সুদহার বাড়িয়েছে। কিন্তু সিপিডির এই গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রায় চার বছর ধরে মানুষ ব্যাংকে টাকা রেখে ক্ষতির মুখে পড়ছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আইনের সংস্কার করতে গিয়ে উল্টো পথে যাচ্ছি। আগে নিয়ম ছিল, যে গ্রুপ ঋণখেলাপি হবে তারা কোনোভাবেই ঋণ পাবে না। কিন্তু এখন গ্রুপ ঋণখেলাপি হলেও তার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে ঠিকই ঋণ দেয়া হচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার ব্যর্থতা। তিনি বলেন, ড. সালেহউদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলেই ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে। আমরাও চালিয়েছি, এত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করিনি, এত সার্কুলার দেইনি। এখন কেউ খেলাপি হলে তার একটি প্রতিষ্ঠান ঋণ পাবে না, তবে অন্যগুলো পাবে- এটা কী, আমার বুঝে আসে না। আমরা রিজার্ভ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলে এখন মাথায় হাত। আমাদের পলিসিটা আগে ঠিক করতে হবে, কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ড. সালেহউদ্দিন বলেন, এখন ব্যবসার মতোই খেলাপি ঋণ মডেলে পরিণত হয়েছে। সুশাসনের অভাব ও রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক চাপের কারণে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এত খারাপ অবস্থায় আগে কখনো যায়নি। এ অবস্থায় অবশ্যই কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সুশাসন আনতে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে। তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যতই ক্যাশলেস সোসাইটি, সঙ্কোচনমূলক মুদ্রানীতি, কলিংপেগ দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করতে চায়, সেটা কোনোভাবেই সম্ভব না।
এম এ মান্নান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তথ্যপ্রবাহে বাধা এসেছে। আমরা অবাধ তথ্যপ্রবাহে বিশ্বাসী। তিনি বলেন, জাতীয় ইস্যুতে আমাদেরকে বুদ্ধিভিত্তিক ঐকমত্যে থাকা দরকার। তিনি বলেন, আইএমএফের যে টিম বাংলাদেশে আসে মিডিয়াকে তাদেরকে বেশি ফোকাস করে। তারা হলো আন্তর্জাতিক সরকারি কর্মচারী। তারা তো আমাদের জন্য টাকা নিয়ে আসে না। তিনি বলেন, গ্রামের ও সাধারণ মানুষ দেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে চিন্তিত।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং খাতকে এই অবস্থা থেকে টেনে তুলতে হলে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বিগত দিনে আমরা দেখেছি লাভের ব্যক্তিকরণ এবং ক্ষতির রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, বাংলাদেশে ব্যাংক তৈরি করা হয় না। বিতরণ করা হয় রাজনৈতিকভাবে। এখন প্রয়োজন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে আনা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা