বৈধতাদানের প্রয়াস নিষিদ্ধ সম্পর্ককে
- শাহেদ মতিউর রহমান
- ২৩ মে ২০২৪, ০০:০৫
নতুন শিক্ষাক্রমে কিশোর-কিশোরীদের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তাদের সহজাত আকর্ষণকে দেয়া হয়েছে বৈধতা। ইসলাম ধর্ম বা যেকোনো ধর্ম বিশ্বাস কিংবা আমাদের বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট বা রীতিনীতিতে যেসব বিষয়কে গোপনীয় ও অনুচিত হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবার পাঠ্যবইয়ের আলোচনায় সেসব বিষয়কে দূষণীয় নয় বলে কোমলমতি শিশুদের শেখানো হচ্ছে। আবার গ্রুপ ডিসকাশনের নামে কিংবা গ্রুপ ওয়ার্কের নামে ছেলেমেয়েদের দেয়া হয়েছে অবাধে মেলামেশার সুযোগ।
নতুন শিক্ষাক্রমে অষ্টম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ২৫ পৃষ্ঠায় শারীরিক ফিটনেস অধ্যায়ে একটি ছবিতে ছেলেমেয়েদের একটি খেলার ছবি দিয়ে বোঝানো হয়েছে তাদের মধ্যে (ছেলে বা মেয়ের) কোনো ব্যবধান থাকবে না। একই খেলা বা একই ধরনের কোনো ইভেন্ট তারা নিজেদের স্বাধীন মতো করতে পারবে। যদিও মেয়ে এবং ছেলেদের শারীরিক গঠন বা ফিটনেস প্রকৃতিগতভাবেই ভিন্ন এবং আলাদা। অথচ পাঠ্যবইয়ের ধারাবাহিকতায় (পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়) ছেলে এবং মেয়েদের আড্ডা দেয়া, কানামাছি খেলা, দাবা খেলা, বেডমিন্টন খেলা, ইয়োগা করা এসব বিষয়ে ছেলেমেয়ের একসাথে সময় কাটানোর বিষয়ে দূষণীয় বা কোনো অসুবিধা নয় বলেও সাফাই গাওয়া হয়েছে।
আবার সপ্তম শ্রেণীর একটি গল্পে বলা হয়েছে আমরা বেড়ে উঠি মন ও মননে। এখানে বন্ধুদের সাথে এক সাথে বেড়ে উঠার নানা ইতিবাচক প্রভাব বর্ণনা করা হয়েছে। সমবয়সীদের সাথে সহযোগিতা এবং সহকর্মী মনোভাব তৈরির জন্যও শিক্ষার্র্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যদিও এতে দূূষের কিছুই ছিল না। তবে ছেলে এবং মেয়েদের পৃথকভাবে বসা কিংবা কোনো অ্যাসাইনমেন্ট করার ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়েও বাধানিষেধের বালাইমাত্র নেই।
সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে সমবয়সীদের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর নানা ধরনের ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে। ছেলে বা মেয়ের ক্ষেত্রে মেলামেশায় এখানে আলাদা কোনো সীমারেখা রাখা হয়নি। বরং বলা হয়েছে এই বয়সে তোমাদের মধ্যে গভীর ও আন্তরিক বন্ধুত্ব গঠনের একটি উত্তম ক্ষেত্র তৈরি হয়। এখানে নিজেদের মধ্যে আনন্দ, দুঃখ, পাওয়া না পাওয়া, একে অপরের সাথে সহজে শেয়ার করা যায়। অতি সহজে একে অপরের সাথে মনের কথাও বলা যায়। দঃখজনক হলো এই শ্রেণীতে কিছু কিছু অধ্যায়ে গ্রাফিক্সের মাধ্যমে কিছু বক্তব্য এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, যা প্রকৃত অর্থেই বিপরীত লিঙ্গের দিকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের মুসলিম সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির বাইরে বয়ফ্রেন্ড আর গার্লফ্রেন্ড সংস্কৃতিকে স্বাধীন ও বাধাহীন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
অষ্টম শ্রেণীর একটি গল্পের নাম মনের যতœ। এই গল্পে ছেলেমেয়েদের মনের গোপন কথা পরস্পরের সাথে শেয়ার করার কথা বলা হয়েছে। আবার এই শ্রেণীর ১১৬ নং পৃষ্ঠায় একটি গল্পে (ঘটনা ১) অলকা ও রাজু নামের দু’জন ছেলেমেয়ের গানের একটি অনুষ্ঠানের জন্য দু’জন দু’জনের কাছে গিয়ে গানের চর্চা করার অভিপ্রায়ে আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর একটি ছেলে ও মেয়েকে পরস্পরের কাছে গিয়ে স্বাধীনতা দিবসের গান রপ্ত করতে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। এখানে যদি দু’জনই তাদের পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের সহযোগিতা নিয়ে অথবা তাদের বাবা-মাসহ একে অপরের কাছে গিয়ে গানের এই অনুশীলন করার ধারণা উপস্থাপন করা হতো তা হলে বিষয়টি আমাদের সমাজ সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইতো।
আবার একই শ্রেণীর ১০২ নং পৃষ্ঠায় পঙ্কজ ও রাহেলার গল্পে (গল্প নং ২) পঙ্কজের বন্ধুদের নিয়ে আয়োজিত পিকনিকে রাহেলাকে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা কিসের ইঙ্গিত বহন করছে? যদিও রাহেলার এই পিকনিকে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না, তবুও তার বন্ধু পঙ্কজ রাগ করতে পারে এই ভেবে রাহেলা তার বন্ধু পঙ্কজের সাথে পিকনিকে যায় এবং পিকনিক থেকে ফিরতেও অনেক রাত হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে অষ্টম শ্রেণীর একজন মেয়ে শিক্ষার্থী যখন বন্ধুদের সাথে পিকনিকে যায় এবং রাত করে বাসায় ফিরে এটা কি আমাদের সমাজ সংস্কৃতি আর সভ্যতার সাথে কোনোক্রমেই মানান সই হচ্ছে? নাকি আমাদের ঘরের কিশোরী মেয়েদের বন্ধুদের সাথে বাইরে অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতার নামে পরোক্ষভাবে উসকানি দেয়া হচ্ছে।
পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ক্লাস সিক্স থেকেই পাঠ্যবইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় এমন গল্প ও ছবি ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে ছেলেমেয়েদের অবাধে মেলামেশাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আমাদের সমাজ সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক এমন আলোচনা ও ছবি বিনা প্রয়োজনেই পাঠ্যবইয়ে ঢুকানো হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর বইয়ে ছেলে ও মেয়েদের একই ব্যায়াম ও খেলাধুলার ছবিরও বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যা স্বাভাবিকভাবেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি পরস্পরকে আকর্ষণ করবে।
এসব বিষয়ে সম্মিলিত উলামা মাশায়েখ পরিষদের মহাসচিব ও বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ড. খলিলুর রহমান মাদানী মনে করেন নতুন কারিকুলামে যেসব শিক্ষা আমাদের সন্তানদের দেয়া হচ্ছে এটা কোনো মতেই আমাদের কৃষ্টি-কালচার বা সমাজ-সংস্কৃতির সাথে যায় না। ভিনদেশী কালচার আমাদের সমাজে চালু করার হীন উদ্দেশ্যেই এই শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেয়া হচ্ছে। আমি মনে করি বস্তুবাদ ও সমাজতন্ত্রের মতবাদ আমাদের উপরে চাপিয়ে দেয়ার জন্যই এই শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, যে দেশে ৯৩-৯৪ ভাগ মুসলমান রয়েছে সেই দেশে এই ধরনের শিক্ষা প্রকৃত অর্থে আমাদের সমাজে নির্লজ্জতাকেই আরো প্রসারিত করবে। এখানে শুধু ইসলাম ধর্মই নয়, বরং যে কোনো ধর্মের মৌলিক গুণাবলীর সাথেও এই শিক্ষাব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূূর্ণ নয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে আমরা গত দুই দশক ধরেই এই ধরনের একটি শিক্ষাব্যবস্থা সমাজে চাপিয়ে দেয়ার জোরালো ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম। তাই শুরু থেকেই এ দেশের ইসলামপ্রিয় তৌহিদি জনতা নানা ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠেও সোচ্চার ছিলেন।
অবশ্য একটি কথা এখানে উল্লেখ না করলেই নয় আর সেটি হলো জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক এবং মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (র:) সহ দেশের শীর্ষ ইসলামিক স্কলারদের নেতৃত্বে ২০০৭ সাল থেকেই পর্যায়ক্রমে এ দেশে কুরআন ও সুন্নাহবিরোধী কুদরতি খুদা শিক্ষাব্যবস্থা সংশোধনের দাবিসহ সুপারিশ অব্যাহত গতিতেই চলছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দেশের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন আলেম মৃত্যবরণ করার পর ২০১৩ সালের পর থেকে আমাদের সেই আন্দোনের গতিতেও ভাটা পড়ে। তবে আশার কথা হচ্ছে মানুষ বর্তমানে কিন্তু আবারো সচেতন হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের আদরের সন্তানদের সুনাগরিক ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাদেরকে অবশ্যই তথাকথিত স্যাকুলার শিক্ষার বাইরে রাখতে হবে। নতুন যে কারিকুলাম চালু করা হয়েছে এই শিক্ষাব্যবস্থা সংশোধন করতে হবে। এটাই হবে সময়ের দাবি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা