যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় সাবেক সেনাপ্রধান
গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে- কূটনৈতিক প্রতিবেদক
- ২২ মে ২০২৪, ০০:০৫
গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির মতে, আজিজ আহমেদের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা ক্ষুণœ করতে ভূমিকা রেখেছে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে আজিজ আহমেদ ও পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে অযোগ্য বিবেচিত হবেন।
গতকাল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে এসব কথা জানানো হয়। জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত তিন বছর বাংলাদেশের চিফ অব আর্মি স্টাফ ছিলেন। এর আগে ২০১২ সাল থেকে চার বছর তিনি বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, আজিজ আহমেদ সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে গুরুতর দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশে তার ভাইয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা এড়াতে তিনি সহায়তা করেছিলেন। সামরিক কন্ট্রাক্টগুলো অনিয়মের মাধ্যমে করার ক্ষেত্রে আজিজ আহমেদ তার ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত লাভের জন্য ঘুষের বিনিময়ে তিনি সরকারি নিয়োগ দিয়েছেন।
এতে বলা হয়, এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। সরকারি সেবা আরো স্বচ্ছ ও সাশ্রয়ী করা, ব্যবসায় ও নিয়ন্ত্রক পরিবেশ উন্নত করা, মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) ও অন্যান্য অর্থনৈতিক অপরাধ তদন্ত ও বিচারের ক্ষেত্রে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর সেকশন ৭০৩১(সি), ফরেন অপারেশনস এবং অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন অ্যাক্টের সংশ্লিষ্ট কর্মসূচির আওতায় জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরাতে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ শিরোনামে একটি তথ্যচিত্র প্রচার করা হয়েছিল। এতে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ভাই জোসেফকে একটি খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে মওকুফের জন্য প্রভাব বিস্তার এবং বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মে সহায়তায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেনা সদর ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আল-জাজিরার এই প্রতিবেদনকে মিথ্যা ও অপপ্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল।
গত ১৪ মে দু’দিনের সফরে ঢাকা এসেছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। পরদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ডোনাল্ড লু বলেছিলেন, আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর (ড. হাছান মাহমুদ) সাথে দুর্নীতি প্রতিরোধের বিষয়ে আলোচনা করেছি। সরকারের স্বচ্ছতার জন্য আমরা একসাথে কাজ করতে পারি। এর মাধ্যমে যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতি করছে, তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে পারি। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা কর্মকর্তাদের মধ্যে র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) এবং বর্তমানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র্যাবের সাবেক ডিজি ও পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা রয়েছেন। এ ছাড়া ২০২৩ সালে মে মাসে বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করলে সেই ব্যক্তি ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর যুুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা জানায়। একই বছর সেপ্টেম্বরে এই ভিসানীতি প্রয়োগের কথা সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে অবহিত করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কাদের ওপর ভিসানীতি প্রয়োগ করা হয়েছে, তা প্রকাশ করেনি পশ্চিমা দেশটি।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন জেনারেল আজিজ : যেসব অভিযোগের ভিত্তিতে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গতকাল রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএসে গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে আজিজ আহমেদ বলেন, আমি অবাক হয়েছি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এ নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তিগত হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম। তাই এ ঘটনা সরকারকেও কিছুটা হেয় করে। তিনি বলেন, কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত নয়। যুক্তরাষ্ট্র কিসের ভিত্তিতে আমার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তা তারাই ভালো বলতে পারবে।
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, আল-জাজিরার ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস ম্যান’ তথ্যচিত্রে আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল, তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। যদিও নিষেধাজ্ঞায় আনা অভিযোগে বিস্তারিত বলা হয়নি, তবে জিনিস একই।
আজিজ আহমেদ বলেন, প্রথম অভিযোগ হলো, আমি আমার ভাইকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইনকে পাস কাটিয়ে অপরাধ কর্মকাণ্ডের শাস্তি থেকে রেহাই দিয়ে দেশ ছাড়তে সহযোগিতা করে পদ-পদবি ব্যবহার করেছি, দুর্নীতি করেছি। দ্বিতীয় হলো, আমি সেনাপ্রধান হিসেবে আমার ভাইকে সামরিক কন্ট্রাক্ট দিয়ে ঘুষ নিয়েছি, আমি আরেকটি দুর্নীতি করেছি। প্রথম অভিযোগের বিষয়ে বলব, আমার সেই ভাই, যদিও তার নাম উল্লেখ করা হয়নি, আমি জেনারেল হওয়ার অনেক আগে থেকেই বিদেশে ছিল। নিশ্চয়ই সে বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গেছে। সেখানে দেশ থেকে চলে যাওয়ার বা দেশের প্রচলিত আইন ফাঁকি দেয়ার ক্ষেত্রে আমি পদ-পদবি ব্যবহার করেছি, এই অভিযোগ মেনে নিতে পারছি না, এটা সঠিক না। দ্বিতীয় অভিযোগের ক্ষেত্রে বলব, আমি চার বছর বিজিবি প্রধান এবং তিন বছর সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। এ সময়ে কেউ যদি একটা প্রমাণ দিতে পারে যে আমি আমার ভাই বা আত্মীয়কে বাহিনী দুটিতে কোনো কন্ট্রাক্ট দিয়েছি, তবে যেকোনো পরিণতি মেনে নিতে আমি প্রস্তুত রয়েছি। আমি আমার কোনো আত্মীয়স্বজন বা ভাইকে কোনো কন্ট্রাক্ট দেইনি। শুধু তাই নয়, এই প্রতিষ্ঠান দুটিতে তাদের কোনো ঠিকাদারি লাইসেন্স ছিল, সেটার প্রমাণ দিতে পারলেও আমি সব শাস্তি মেনে নেব।
যুক্তরাষ্ট্র আগেই জানিয়েছিল-পররাষ্ট্রমন্ত্রী : সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব:) আজিজ আহমেদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে পদক্ষেপ নিয়েছে সেটি আগেই ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানানো হয়েছিল বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত ‘মিট দ্য রিপোর্টার্স’ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভিসানীতি কাদের ওপর প্রয়োগ করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে ভিন্ন একটি আইনের অধীনে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপের ব্যাপারে সরকার কোনো ব্যবস্থা নেবে কি না জানতে চাইলে হাসান মাহমুদ বলেন, এটি সেনাবাহিনীর বিষয়, আমি এ মুহূর্তে কিছু বলতে চাই না। ডোনাল্ড লু এসে বলে গেছেন, দুই দেশের মধ্যে অস্বস্তি আছে, এমন বিষয়গুলো পাশে রেখে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চায়। আমরাও তাদের একই কথা বলেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। দুর্নীতি দমন, সন্ত্রাস দমন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা একসাথে কাজ করছি। তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের অনেক সংসদ সদস্যও দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা