১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বন্ধুত্বের আড়ালে কিশোর কিশোরীর প্রেমের শিক্ষা

নতুন শিক্ষাক্রমের অন্তরালে: ২
- প্রতীকী ছবি


প্রাথমিকের পাঠ চুকিয়ে মাধ্যমিকের মাঠে পদচারণা শুরু মাত্র। এরই মধ্যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে প্রেম ভালোবাসার আহ্বান। ষষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর নামই নির্ধারণ করা হয়েছে ‘চলো বন্ধু হই’। পুরো এই অধ্যায় পাঠের পর মূল বিষয় হলো বন্ধুত্বের নাম দিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাল্য প্রেমের প্রসার ঘটানো। এ জন্য এই অধ্যায়ের নামই যেন সঠিকভাবেই নির্ধারণ করা হয়েছে ‘চলো বন্ধু হই’। পুরো অধ্যায়জুড়েই রয়েছে বন্ধুত্বের আড়ালে কিশোর-কিশোরীর মধ্যে প্রেম আর ভালোবাসার আহ্বান।
ষষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৮৯ পৃষ্ঠায় পাশাপাশি দু’টি ছবিতে দেখানো হয়েছে ছেলেমেয়ের কাছে আসার চিত্র। ছেলেমেয়েদের মনের কথা বলার চিত্র দিয়ে বুঝানো হয়েছে, তাদের মধ্যে ভাব প্রকাশের ভঙ্গিমা। সেখানো বলা হয়েছে ‘প্রয়োজনে না বলি, কি চাই তা বলি, অনুভুতি প্রকাশ করি’ এমন একটি সেøাগান। আবার পাশের আর একটি ছবিতে দেখানো হয়েছে ছেলেমেয়ের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছেলের কাঁধে হাত দিয়ে একটি মেয়ের দাঁড়ানোর প্রেমময় আবেগের এক ভঙ্গিমা। মূলত এই অধ্যায়ের সারাংশ হলো একটি সময়ে ছেলে কিংবা মেয়ে তাদের প্রত্যেকেরই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। তাদের মনের মধ্যে একটি আবেগ তৈরি হয়। তারপর বলা হচ্ছে বন্ধু হও। বিশ্লেষকদের মতে একজন ছেলে কিংবা মেয়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি যে আকর্ষণ তৈরি হয় এই বয়সে সেই আকর্ষণকে যেখানে দমানোর বা নিভৃত করার দরকার ছিল সেখানে বরং পাঠ্যবইয়ের আলোচনায় ছেলেমেয়েদের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণকে আরো উসকে দেয়া হয়েছে।

গল্পের ভেতরে প্রবেশ করে কিছু অংশ পড়লেই বুঝা যাবে এই গল্প শিশুদের জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো টেক্সট বই, নাকি রসালো কোনো প্রেমের উপন্যাস। সত্যিকার অর্থে আমাদের সন্তানদের নৈতিকভাবে ধ্বংস করার হীন উদ্দেশ্যেই এমন পাঠ আমাদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যে বয়সে আমাদের আদরের সন্তানদের টেবিলে বসে বা স্কুলের ক্লাসরুমে বসে পড়ালেখায় মনোযোগী হওয়ার কথা সেই বয়সে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশায় উসকানি দেয়া হচ্ছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় মনের যতœ ইনসার্টে একটি ছবিতে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে তাদের মধ্যে ভালো অনুভূতিগুলো প্রকাশের মাধ্যমে পরস্পরপরকে উৎসাহ দিচ্ছে। বলা হচ্ছে মন ভালো থাকার উপায় হলো নিজের অনুভূতি বন্ধুর সাথে শেয়ার করা। অথচ এখানে বলা দরকার ছিল তোমাদের ভালো লাগা কিংবা খারাপ লাগার অনুভূতিগুলো বাড়িতে তোমরা তোমাদের মা-বাবা কিংবা ভাই অথবা বোনদের সাথে শেয়ার করেও মনে প্রশান্তির খোঁজ করতে পারো। কিন্তু তা না করে বরং ছেলেমেয়েদের মধ্যে মনের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যমে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব, প্রেম বা ভালোবাসার মেলবন্ধন তৈরিতে উসকানি দেয়া হচ্ছে। একই অধ্যায়ের আরেকটি অংশের ছবিতে একটি ছেলে একটি মেয়েকে স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাইরে গিয়ে সময় কাটাতে সাইকেল চালানোর বুদ্ধি ফিকির করছে। ছেলেটি মেয়েকে প্রস্তাব দিচ্ছে স্কুল ফাঁকি দিতে আর মেয়েটি স্কুল ফঁাঁকি দিয়ে বাইরে যেতে না চাইলেও স্কুল ছুটির পর বাইরে যেতে মেয়েটির আপত্তি নেই বলেও সে সায় দিচ্ছে। এটা কিসের ইঙ্গিত? স্কুল ফাঁকি দিয়ে বাইরে গিয়ে একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের সময় কাটানোর এই সংস্কৃতি কি আমাদের সমাজ আর পারিবারিক রীতিনীতির মধ্যে পড়ে? মোটেই না। অথচ কোমলমতি শিশুদের তাদের পাঠ্যবইয়ে এসব বিষয়ই যুক্ত করে আধুনিক শিক্ষার সবক দেয়া হচ্ছে।

অপর দিকে সপ্তম শ্রেণীর একই বিষয়ের পাঠ্যবইয়ে সমবয়সীদের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর মাধ্যমে নিজের সম্পর্কের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে কিভাবে বন্ধুদের সাথে গভীর ও আন্তরিক বন্ধুত্ব গঠনের ক্ষেত্র তৈরি হয় এবং একসাথে সুন্দর সময় কাটানো যায়। পরস্পরের মধ্যে মনের কথা ও ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে আনন্দ আর দুঃখ শেয়ার করা যায়। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে নতুন কারিকুলামের পাঠ্যবইয়ে সপ্তম শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের মধ্যেই গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড সংস্কৃতি চালু করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। সপ্তম শ্রেণীর একটি গল্পের ঘটনা ২ এ যেভাবে নিরা ও অতুল নামের দুইজন ছেলেমেয়ের পাশাপাশি সিটে বসে ক্লাস করার কথা বর্ণনা করা হয়েছে এটাও আমাদের সমাজ সংস্কৃতির সাথেও খাপ খায় না কোনোমতেই । ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেভাবে মান অভিমান হওয়ার কথা সেখানে নিরা ও অতুল দুই ক্লাসমেটকে কি তাহলে বন্ধুর পরিবর্তে স্বামী স্ত্রী হিসেবে তুলনা করা হচ্ছে?

অপর একটি গল্পে ফাহিম ও অন্তরার সম্পর্কের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও তারা দুইজন দুইটি ভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করে । কিন্তু তাদের মধ্যে প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হতো। বিষয়টি তাদের মা-বাবা জানার পর দু’জনের পরিবারই তাদেরকে শাসন করে। কিন্তু পারিবারিক এই শাসনকে সপ্তম শ্রেণীর গল্পে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গল্পে ফাহিম এবং অন্তরার এই বন্ধুত্ব ও তাদের মধ্যে যোগাযোগ বা দেখা সাক্ষাতকে স্বাভাবিকভাবে দেখানো হয়েছে। যদিও আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের ক্লাসরুমের বাইরে এই যোগাযোগ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

অষ্টম শ্রেণীর একটি গল্পে অলকা ও রাজু স্বাধীনতা দিবসে একটি গান গাওয়াকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে দু’জনের বুঝাপড়ার সুযোগে পরস্পরের কাছে আসার কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। আবার অপর একটি গল্পে পঙ্কজ ও রাহেলার মধ্যে পিকনিকে দায়িত্ব বণ্টন নিয়েও দু’জনের প্রতি দু’জনের আকর্ষণ দেখানো হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র বন্ধুদের পিকনিকে একমাত্র মেয়ে বান্ধবী রাহেলাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। পঙ্কজ নিজে একজন ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তার বান্ধবী হওয়ার সুবাধে কিভাবে সে ছেলেদের পিকনিকে একজন মেয়ে বান্ধবীকে নিয়ে যেতে চাইলো? এটা কি আমাদের অভিভাবকদের আবেগ অনুভূতির সাথে মিলল?

নতুন কারিকুলামে নবম শ্রেণীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের তিনটি অধ্যায়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব বাড়ানোর নানা কৌশল বিস্তৃত হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে শুরু করে সপ্তম অষ্টম এবং নবম শ্রেণীতে বন্ধ্যত্ব ও ছেলেমেয়েদের মনোজগতের নানা কল্পনার রঙিন ফড়িং উড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নবম শ্রেণীর ২৯ থেকে ৪০ পৃষ্ঠায় সব বাধা পেরিয়ে চলো যাই এগিয়ে অধ্যায়, ৭৫ থেকে ৮৪ পৃষ্ঠায় মন জাহাজের নাবিক এবং ৯৭ পৃষ্ঠা থেকে ১০৭ পৃষ্ঠায় মনোবন্ধু অধ্যায়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব বাড়ানো, তাদের সাথে মনের কথা বলা, সহযোগিতা করা ও পাশে থাকার অভিব্যক্তি তুলে ধরা হয়েছে। বইয়ের ৯৮ নং পৃষ্ঠায় ছবিতে একটি সেøাগানে দেয়া হয়েছে ‘আমরা সবাই বন্ধু হবো, সবাই সবার পাশে দাঁড়াব’। এই সেøাগানে অন্যদের বন্ধু বানানোর কথা হয়তো ভালো লাগত যদি তারা সমলিঙ্গের বন্ধু হতো। কিন্তু এখানে রাহেলা ও চন্দনের মতো বিপরীত লিঙ্গের দুই বন্ধুকেই কাছে টানতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
গবেষনা বলছে ক্লাস সিক্স সেভেন বা এইটের ছেলেমেয়েদের যাদের বয়স ১০ বছর থেকে ১৩ বছর (ঊধৎু ধফড়ষবংপবহপব, ১০-১৩ ুবধৎং) তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের নামে এভাবে অবাধ মেলামেশার ফলে বাল্যপ্রেম (ঈধষভ খড়াব) মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়। এই (ঈঝঊ) এর কারণে আমেরিকাতে এই বয়সী (১০ থেকে ১৩ বছর) ৩৬ শতাংশ কিশোর কিশোরী অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়। (ঈধৎাবৎ বঃ ধষ. ২০০৩)। আর বয়স ১৫ বছর হওয়ার পর এই হার ৫০ শতাংশ হয়ে যায়। (ঈধৎাবৎ, খড়ুহবৎ, ধহফ টফৎু ২০০৩)। আর এর প্রধানতম কারণ হলো বা মূল চালিকা শক্তিই হলো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ ও যৌনতা বুঝতে পারা (ঝবরভভমব-কৎবহশব ২০০৩)। ফলে যা ঘটার তাই ঘটে যায়। কিশোরী গর্ভধারণের হার হাজারে ৪৩ জন। এবং গর্ভপাতের হারও ঐসব দেশে অনেক উচ্চ। আবার পরিনত বয়সের আগেই এই অসময়ে (ঙভভ ঃরসব) রোমান্টিক সম্পর্ক্য (ষধঃব পযরষফযড়ড়ফ ধহফ বধৎষু ধফড়ষবংপবহপব) পরবর্তীতে উগ্র আচরণ ও অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট মারাত্মকভাবে ধ্বসের কারণ হয়। (ঋঁৎসধহ বঃ ধষ. ২০০৮, তরসসবৎ-এবসনবপশ বঃ ধষ. ২০০১)। আবার ঘন ঘন সঙ্গী পরিবর্তন, সম্পর্ক গড়তে সমস্যা হওয়া, সংসার জীবনে অসুখী হওয়া ইত্যাদির জন্যও দায়ী এই কাঁচা বয়সের প্রেমের সম্পর্ক।


বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের মতো মুসলিম প্রধান দেশে এবং আমাদের মুসলমান সমাজে সন্তানদের এই ধরনের পরিণতি কোনোভাবেই মেনে নেবে না। অর্থাৎ এই কম্প্রিহেনসিভ যৌনশিক্ষার কুফল ছাড়া আমাদের সমাজে বিন্দুমাত্র সুফল নেই। আমাদের পরিবারের আদরের সন্তানরা যদি স্কুলে পড়তে এসে অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট খারাপ করে এবং সেই জায়গায় উল্টো সন্তানরা প্রেম ভালোবাসা কিংবা ডেটিং করে বেড়ায় তাহলে স্কুলে দিতে কোনো অভিভাবকই আর নিরাপদ বোধ করবেন না।

 


আরো সংবাদ



premium cement