বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে চায় যুক্তরাষ্ট্র
ডোনাল্ড লু’র সফর নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত- কূটনৈতিক প্রতিবেদক
- ১৭ মে ২০২৪, ০০:০৫
ভারতের হস্তক্ষেপের কারণে বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কেননা বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যতটুকু স্বার্থ রয়েছে, ভারতে রয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। আর এ কারণে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের সাথে সঙ্ঘাতে যেতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। এখন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে অতীতের অস্বস্তিকর বিষয়গুলোকে পেছনে ফেলে ইতিবাচক দিকগুলো নিয়ে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সদ্য সমাপ্ত সফর নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা এ মত প্রকাশ করেছেন। লু গত বুধবার দুই দিনের সফরে ঢাকা আসেন। এ সময় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের দেয়া নৈশভোজে যোগ দেন। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সাথে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। তবে এবারের সফরে ডোনাল্ড লু কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করেননি, যা ছিল একটি ব্যতিক্রম। সফর শেষে গতকাল সকালে তিনি ঢাকা ছেড়ে গেছেন।
সফর নিয়ে ডোনাল্ড লু গণমাধ্যমের সামনে সীমিত আকারে রাখা বক্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসের ঘাটতি দূর করে সম্পর্ক দৃঢ় করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অহিংস নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র অনেক পরিশ্রম করেছিল। এটা কিছুটা উত্তেজনাও তৈরি করেছিল। এখন আমরা সামনে দেখতে চাই, পেছনে নয়।
এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে বলেন, ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের কিছু আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সুর কিছুটা নরম হয়ে আসছিল বা তাদের সোচ্চার ভূমিকার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। আর এটা ঘটেছিল ভারতের প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আছে ঠিকই, তবে ভারতে তাদের স্বার্থ অনেক বেশি। আর এ কারণে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ভারতের সাথে সঙ্ঘাতে যেতে চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে নির্বাচনটি যে যথাযথ হয়নি সেটা তারা বলেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে, এটা মনে হয় না। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হোক বা না হোক, বাংলাদেশে একটা সরকার এখন ক্ষমতায় আছে। এ প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য যে ইস্যুগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে যেতে হবে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছু অস্বস্তিতো আছেই। বাস্তবতার নিরিখে এখন সেটাকে পেছনে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যেতে চায়। এটাই ডোনাল্ড লুর ঢাকা সফরের মূল বার্তা বলে আমার মনে হয়। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার গঠন হলে সেই সরকারের সাথে তাদের কাজ করতে সুবিধা হবে। এখন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ইতিবাচক যে ইস্যুগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যেতে চায়।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর চাইলেই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারবে না। এ জন্য একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। র্যাবের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুমের অভিযোগ এখন তেমন একটা শোনা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর র্যাব তার আচরন পরিবর্তন করেছে, এটা প্রমাণিত। আর এ কারণে নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা সম্ভব। তবে বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত ভিসানীতি কিছুটা ভিন্ন। এই নীতি অনুসরণ করে কাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে তা যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করে না। একমাত্র কোনো ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার জন্য আবেদন করলেই জানতে পারছে তার ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে কি না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভিসানীতি বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারেনি। সেক্ষেত্রে এই নীতির কার্যকারিতা কতটুকু- জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ক্ষমতাসীন দলকে নির্বাচনে জিতিয়ে আনতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সরকারি কর্মকর্তা বা নিরাপত্তা বাহিনী প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল, তা যে কারণেই হোক না কেন। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার পরোয়া না করেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো তারা করেছে। তাই বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির লক্ষ্য যদি ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য হয়ে থাকে, তবে তা অর্জিত হয়নি।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যে বিশ্বাসের ঘাটতি ছিল, তা দূর হয়ে যায়নি। এই ঘাটতি পূরণের জন্য ডোনাল্ড লুর দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী কাজগুলো এগিয়ে গেলে তখন সফলতার কথা বলা যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক দিক থেকে দেখতে হবে। দু-একটি জায়গায় মতপার্থক্য থাকলেই যে সম্পর্কে টানাপড়েন ঘটবে, ব্যাপারটি তা নয়। আমাদের কিছু বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ আছে। যেমন, গত মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্রতিবেদনকে ‘ক্রটিপূর্ণ’ বলেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। অর্থাৎ এ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু মতপার্থক্য ধরে বসে থাকলে হবে না। বরং তাদের সাথে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে, সেগুলোর দিকে মনোযোগ দিয়ে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
তিনি বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট নিজেদেরই সমাধান করা উচিত। বিদেশী কেউ এসে আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে এ চিন্তা ঠিক নয়। নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড লু দুই দফায় বাংলাদেশে এসেছিলেন। ওই সফরগুলোতে নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। খেয়াল করার বিষয়, এবারের সফরে ডোনাল্ড লুর সাথে রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক হয়নি।
হুমায়ুন কবির বলেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক এখন বিস্তৃত ও গভীর। রফতানি, রেমিট্যান্স, বিনিয়োগ প্রভৃতি বিষয় ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের ‘সময়ের পরীক্ষিত বন্ধু’, করোনা মহামারীর সময় তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশকে করোনা টিকা দিয়ে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথম সারিতে রয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনে ডিজিটাল অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে বাংলাদেশের সাথে কাজে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ অবশ্যই রয়েছে। ডোনাল্ড লুর সফরে সেই ইঙ্গিতই স্পষ্ট।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা