২০ মে ২০২৪, ০৬ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫
`


যুদ্ধবিরতিতে ইসরাইলকে ছাড় দেবে না হামাস

ইসরাইলি বর্বরতার মুখে গাড়িতে করে রাফা ছাড়ছেন ফিলিস্তিনিরা : আলজাজিরা -

- বাইডেনের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুমকিতে ক্ষুব্ধ ইসরাইল
- আল-শিফায় তৃতীয় গণকবরের সন্ধান, ৪৯ লাশ উদ্ধার
- গাজায় নজরদারিতে ব্রিটেনের গুপ্তচর বিমান

যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরাইলের সাথে আর কোনো আপস না করার ঘোষণা দিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। বুধবার তারা এ কথা জানিয়েছে। যদিও সাত মাস ধরে চলা ইসরাইলের আগ্রাসন থামানোর লক্ষ্যে কায়রোতে এখনো আলোচনা চলছে। রাফায় হামলা করলে ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছে ইসরাইল। বিবিসি, আলজাজিরা, এএফপি ও রয়টার্স।
ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। টানা সাত মাস ধরে চালানো এ হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩৪ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। এমন অবস্থায় গাজায় যুদ্ধ বন্ধে বাড়ছে বৈশ্বিক চাপ। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সায় দিয়েছে। তবে ইসরাইল বেঁকে বসায় যুদ্ধবিরতি হয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। এমন অবস্থায় যুদ্ধবিরতির জন্য ইসরাইলের সাথে আর কোনো আপস না করার ঘোষণা দিয়েছে হামাস।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আলোচনায় ইসরাইলকে আর হামাস কোনো ছাড় দিতে ইচ্ছুক নয় বলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি বুধবার জানিয়েছে। যদিও সাত মাস ধরে চলা ইসরাইলের আগ্রাসন থামানোর লক্ষ্যে কায়রোতে এখনো আলোচনা চলছে। আর এর মধ্যেই ইসরাইল বুধবার দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে ট্যাংক ও বিমান হামলা চালিয়েছে এবং শহরটিতে বড় ধরনের হামলার হুমকি দিয়েছে।

এ ছাড়া ইসরাইলি বাহিনী গত মঙ্গলবার মিসরের সাথে রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে প্রবেশ করেছে। এটি গাজায় সহায়তা সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথ এবং আহত রোগীদের সরিয়ে নেয়ার জন্যও এটিই ছিল একমাত্র পথ। ইসরাইলি সেটি বন্ধ করে দিয়েছে। হামাস এর আগে গত সোমবার মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে আসা গাজা যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাবে সম্মত হয়। কিন্তু এর পরপরই ইসরাইল জানায়, এই প্রস্তাবের শর্তগুলো তাদের দাবি পূরণ করেনি এবং চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনার পাশাপাশি রাফাতে হামলার ঘোষণা দেয় দেশটি।
এ ছাড়া গত সোমবার ইসরাইলি বাহিনী গাজার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত রাফাতে আকাশ ও স্থল থেকে আক্রমণ চালায় এবং শহরের কিছু অংশ থেকে বাসিন্দাদের ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। মূলত গাজার এ শহরটি এখন ১৪ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির আশ্রয়স্থল।
রয়টার্স বলছে, কাতারে হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সদস্য ইজ্জাত আল-রেশিক বুধবার মধ্য রাতে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীটি গত সোমবার গৃহীত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বাইরে যাবে না। ওই চুক্তির ফলে গাজায় কিছু ইসরাইলি বন্দীর পাশাপাশি ইসরাইলে আটক ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের মুক্তি দেয়া হবে। রেশিক বলেছেন, ‘ইসরাইল কোনো ধরনের চুক্তিতে পৌঁছানোর বিষয়ে আন্তরিক নয় এবং তারা (ইসরাইল) রাফা আক্রমণ ও ক্রসিং দখল করার জন্য যুদ্ধবিরতির আলোচনাকে একটি আবরণ হিসাবে ব্যবহার করছে।’ অবশ্য ইসরাইলের কাছ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে গত সোমবার নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ইসরাইলি কর্মকর্তা বলেন, হামাস যে প্রস্তাবটি অনুমোদন করেছে তা মিসরীয় প্রস্তাবের চেয়ে খুবই দুর্বল এবং এতে এমন কিছু উপাদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা ইসরাইল গ্রহণ করতে পারে না।

এ দিকে মঙ্গলবার থেকে কায়রোতে হামাস, ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, মিসর ও কাতারের প্রতিনিধিদল বৈঠক করছে। ঊর্ধ্বতন একটি সূত্রের বরাত দিয়ে মিসরের রাষ্ট্র-অধিভুক্ত আল কাহেরা টিভি বলেছে, কায়রোতে এই আলোচনা বুধবার অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং তা রাত পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র মঙ্গলবার বলেছে, হামাস তার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সংশোধন করেছে এবং এই সংশোধন চলমান আলোচনায় সৃষ্ট অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারে। হামাসের সর্বশেষ বিবৃতির মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ওয়াশিংটন আরো দাবি করে, দুই পক্ষ (চুক্তি থেকে) খুব বেশি দূরে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, চুক্তির সুযোগ রয়েছে... দুই পক্ষই যথেষ্ট কাছাকাছি রয়েছে এবং চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য যা করা উচিত তাদের তা করা উচিত।’
রাফায় হামলা করলে ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ ছাড়া ইসরাইলের জন্য নির্ধারিত বোমার একটি চালান ইতোমধ্যেই আটকে দিয়েছে ওয়াশিংটন। বুধবার বাইডেন বলেছেন, ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষকে হত্যা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বোমাগুলো ব্যবহার করেছে ইসরাইল। তবে ইসরাইলের দাবি, রাফাতে লুকিয়ে থাকা হাজার হাজার হামাস যোদ্ধাকে পরাস্ত করতে তাদের অবশ্যই সেখানে হামলা করতে হবে। যদিও এ শহরটি বর্তমানে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে। তারা ইসরাইলি আগ্রাসনের কারণে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে রাফা শহরে পালিয়ে এসেছে।

রাফাহ নগরীতে ইসরাইলকে বড় কোনো অভিযান না চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সতর্ক করার পরও সেখানে ভারী গোলাবর্ষণ শুরু করেছে ইসরাইল। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে গত বুধবার দেয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইসরাইল যদি ফিলিস্তিনের গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় বড় ধরনের অভিযান চালায়, তা হলে তিনি দেশটিকে (ইসরাইল) মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেবেন। প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুঁশিয়ারিকে ‘খুবই হতাশাজনক বক্তব্য’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসঙ্ঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরডান।
আল-শিফায় তৃতীয় গণকবর : গাজার আল-শিফা হাসপাতালে মিলেছে তৃতীয় গণকবরের সন্ধান। এই গণকবর থেকে এখন পর্যন্ত ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা আনাদোলু। খবরে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের মেডিক্যাল দলগুলো গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালে তৃতীয় গণকবর আবিষ্কার করেছে বলে বুধবার গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে। মিডিয়া অফিস এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৯ জনের লাশ গণকবর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে এবং আরো লাশের খোঁজে অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা এখনো চলছে।’ আনাদোলুর খবরে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে সাতটি গণকবর পাওয়া গেছে। অন্য দিকে সাত মাসেরও বেশি ধরে ইসরাইল অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটিতে নৃশংস আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
গাজায় নজরদারিতে গুপ্তচর বিমান : ফিলিস্তিনের গাজার বিভিন্ন অবস্থান সম্পর্কে ইসরাইলকে বিস্তারিত তথ্য দিতে অঞ্চলটির আকাশে অন্তত ২০০ গোয়েন্দা নজরদারি মিশন চালিয়েছে ব্রিটেনের রয়্যাল এয়ারফোর্স। এক হাজার ঘণ্টারও বেশি ধরে গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়েছে বিমানগুলো। বুধবার ব্রিটিশ অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম ডিক্ল্যাসিফাইড ইউকের এক রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ডিক্ল্যাসিফাইড ইউকের বরাত দিয়ে লেবাননি সংবাদমাধ্যম আল-মায়েদিন জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার কয়েক দিন পর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই নজরদারি চালিয়েছে ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স। ডিক্ল্যাসিফাইড ইউকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সাইপ্রাসে অবস্থিত ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সের ঘাঁটি আরএএফ আক্রোতিরি থেকে অন্তত ২০০ ফ্লাইট গাজার আকাশে ১ হাজার ঘণ্টার বেশি নজরদারি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ব্রিটিশ বাহিনীর এই প্রচেষ্টা মূলত গাজার বিষয়ে যথেষ্ট নজরদারি প্রচেষ্টাকেই ইঙ্গিত করে। এতে আরো বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে এসব ফ্লাইটকে গাজায় হামাসের হাতে বন্দী জিম্মিদের উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে সহায়তা করা উদ্দেশ্যে পরিচালিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হলেও, পরে এসব তথ্য ইসরাইলি বাহিনী সামরিক অভিযানে ব্যবহৃত হয়েছে বলেও সন্দেহ করা হয়।

গাজায় ত্রাণকর্মীদের ওপর ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় তিন ব্রিটিশ নাগরিক নিহত হওয়ার পর এই সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। ইসরাইলি বাহিনী যখন এ হামলা চালায় তখন রয়্যাল এয়ারফোর্সের একটি নজরদারি ফ্লাইট গাজার আকাশে ছিল। এ বিষয়ে তদন্তের ক্রমবর্ধমান দাবি থাকলেও ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে নজরদারির পরিমাণ আরও বাড়িয়েছে।
ডিক্ল্যাসিফাইড ইউকের অনুসন্ধানে আরো উঠে এসেছে, ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স তাদের নজরদারি বিমান শ্যাডো আর-১ ব্যবহার করে এই নজরদারি চালিয়েছে। এই বিমানগুলো রয়্যাল এয়ারফোর্সের ১৪ নম্বর স্কোয়াড্রন এই বিমানগুলো পরিচালনা করে। প্রতিবেদন অনুসারে, এই বিমানগুলো কোনো অজ্ঞাত কারণে ইতালিও গিয়েছে।
হামাসের হাতে ব্রিটিশ বন্দী থাকার পরও ইসরাইল গাজায় যে হত্যাকা- চালাচ্ছে সে বিষয়ে ব্রিটেনের সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নানা বিতর্ক থাকার পরও ব্রিটিশ সশস্ত্রবাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে এর নজরদারির আওতা বাড়িয়েছে এবং গাজায় নজরদারির বিষয়ে বারবার জানতে চাওয়ার পরও এই বিষয়ে বিস্তারিত ও নির্দিষ্ট কোনো তথ্য দেয়নি ব্রিটিশ সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement