দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ০৫ মে ২০২৪, ০০:০০, আপডেট: ০৫ মে ২০২৪, ০০:৩৩
দ্য ঢাকা ফোরাম আয়োজিত ‘রাজনীতি অর্থনীতি : বাংলাদেশ এখন’ শীর্ষক এক সেমিনারে দেশের বিশিষ্টজনরা বলেছেন, রাষ্ট্র গণতন্ত্রের পরিবর্তে এখন এক ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান তাদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়েছে। উন্নয়নের কথা বলা হলেও যেটি হয়েছে সেটি ঋণনির্ভর অর্থনীতি। এ ছাড়া এখন দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। নীতিই তৈরি করা হচ্ছে দুর্নীতি করার চিন্তা থেকে। এতে সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে যাদের ক্ষমতার ব্যালান্স করার কথা ছিল নির্যাতন-নিপীড়নে তারাও কোনঠাসা হয়ে গেছে। এ অবস্থায় তাদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ ও সাধারণ জনগণকেও সোচ্চার হতে হবে।
গতকাল রাজধানীর ব্রাক ইন-এ এই সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে দ্য ঢাকা ফোরামের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে আলোচনা করেন, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রীয়াজ, দ্য ঢাকা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি ও সিইও সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, দ্য ঢাকা ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সিরাজুল ইসলাম, সাবেক রাষ্ট্রদূত এফ এ শামীম আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত আহমদ মাহমুদুর রেজা চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত ইফতেখারুল করিম, সাবেক রাষ্ট্রদূত মাসুদ আজিজ, সাবেক রাষ্ট্রদূত শাহেদ আকতার, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিক্যাল এডুকেশনের সিনিয়র অ্যাডভাইজার প্রফেসর ডা: মোজাহেরুল হক, প্রফেসর আনিসুজ্জামান চৌধুরী, ড. রাশেদ তিতুমীর, ড. দিলারা চৌধুরী প্রমুখ।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনীতি ও অর্থনীতির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান শাসক গোষ্ঠী রাজনীতির গতি ধীর করে উন্নয়নের নতুন ধারণার কথা বলছে। এ কারণে দেশে রাজনীতির অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের প্রকৃত চিত্র অনুপস্থিত। মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। এর কোনো জবাবদিহিতাও নেই। অন্যদিকে উন্নয়নের কথা বলা হলেও সেখানে ঋণ নির্ভর হয়ে গেছে। অদক্ষতার কারণে উন্নয়ন ব্যয় বহুগুণ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রবণতা বেড়েছে। আর দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে নীতিমালাই করা হচ্ছে দুর্নীতি করার জন্য। এজন্য দুর্নীতি ধরা পড়লেও তাদের কোনো বিচার হচ্ছে না। দেশে বিরোধীদল দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও তারা মূল জায়গায় যেতে পারছে না। আমরা যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতায় বাস করছি, সেখান থেকে মুক্তি পেতে যারা শাসন করছে তাদের নিজেদের মধ্যে চিন্তার পুনর্মূল্যায়ন দরকার। একই সাথে বিরোধীদলের প্রতিবাদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ কর্মসূচিরও পুন:মূল্যায়ন প্রয়োজন।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এখন বলা হচ্ছে বছরে চার বার বিদ্যুতের দাম বাড়বে। কিন্তু জনগণের আয় কি চারবার বাড়বে? বিদ্যুতের ভর্তুকির ৮১ ভাগই ক্যাপাসিটি চার্জ। এটা হচ্ছে অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে। এক্ষেত্রে জনগণ অসহায়। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এত বেশি যে মানুষ কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এ অবস্থা পরিবর্তনে জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। যেভাবে কোটাবিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছিল সেভাবেই রাজনীতি-অর্থনীতি পরিবর্তনের আন্দোলন করতে হবে। জনগণ কার নেতৃত্বে এগিয়ে যাবে তা জানি না; তবে জনগণ এগিয়ে এলে এক সময় সফল হবেই। অবশ্য সেটি শান্তিপূর্ণ হবে কি না জানি না। তবে বসে থাকলে চলবে না। দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়। বিএনপির স্থানীয় নির্বাচন বর্জন সঠিক সিদ্ধান্ত হয়নি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে যে নির্বাচন হচ্ছে তাকে নির্বাচন না বলে সিলেকশন বলা যায়। এখন প্রতিযোগিতা একদলের মধ্যেই হচ্ছে। দেশে একশ্রেণীর লোকের অগণিত টাকা ও ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বেশির ভাগ মানুষ অসহায়। সবচেয়ে বড় শঙ্কার জায়গা হলো দেশের সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ডিসফাংশনাল করে দেয়া হয়েছে। যদি এখন ক্ষমতার পরিবর্তনও হয় তাহলে এটি ঠিক করতে আরো ৫৩ বছর লেগে যেতে পারে। রাজনীতি-অর্থনীতি সব মনোপোলাইজড হয়ে গেছে। এখানে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ নেই। চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি চলছে। নাগরিক সমাজ ক্রাইসিসে আছে। গণমাধ্যম সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তারা সাহস হারিয়েছে। এ অবস্থায় ঐক্যবদ্ধ হলে পরিণাম কি হবে তা নিয়ে জনগণ শঙ্কিত। সবাই মনে করতে শুরু করেছে ‘আমার ঘাড়ে কয়টা মাথা’। রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের মধ্যেও আন্তঃযোগাযোগ কমে গেছে।
আলী রীয়াজ বলেন, দেশে এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বৈরতন্ত্র চলছে। সংবিধান পরিবর্তন, নতুন আইন, তিনটি সাজানো নির্বাচন, বিরোধীদল দমন, সুশীলদের নীরব করা হয়েছে। দল ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি। পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা ভয়াবহ আকারে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের জন্য এই ব্যক্তিই অপরিহার্য এমন বোঝানো হচ্ছে। এর বাইরে কেউ থাকতে পারবে না। তথাকথিত নির্বাচন ও প্রশাসন তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে কাজ করছে। একব্যক্তি কেন্দ্রিক হওয়াতে ক্ষমতাসীনদের মধ্যেও এলিট শ্রেণী কমে গেছে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো আগে থেকেই ক্ষয়িঞ্চু ছিল, আস্তে আস্তে আরো ক্ষয়ে গেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দেশের অর্থনীতি জটিল অবস্থায় রয়েছে। উন্নয়ন হচ্ছে ঋণনির্ভর। জিডিপি কমে গেছে। রাজনৈতিক জবাবদিহিতা না থাকার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে জনগণ ভোটের অধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। এর জন্য বিরোধীদলেরও কিছু দায় রয়েছে। তাদের অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভরতা ও তারা নির্বাচিত হলে কী করবেন তা জাতির সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, ২০০৮ সালের এক সভা থেকে বিএনপিকে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেই নির্বাচন বর্জনের আহবান জানানো হয়েছিল। এরপর তাদের উপর গত ১৭/১৮ বছর ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে অত্যাচার-নির্যাতন চালানো হয়েছে। তারপরও এখন যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে বিএনপি ৯০ শতাংশ ভোট পাবে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, বিএনপি গত কয়েকটি যে বড় ধরনের আন্দোলন করেছে তা আমি এর আগে কখনো দেখিনি। দেশে এক ব্যক্তির শাসন চলছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যে ভুয়া নির্বাচন হচ্ছে তা কি ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্পে ছিল? ঢাবিতে গত ১৫ বছরে সব কিছু রাজনীতিকরণ করা হয়েছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, এখন সেখানে শিক্ষকরা নির্বাচন করতেও ভয় পায়। শুধু কথা বলার অপরাধে ১২ জন শিক্ষককে শাস্তি দিয়েছে ঢাবি।
রাষ্ট্রদূত সিরাজুল ইসলাম বলেন, দেশে গত ৭ জানুয়ারি তথাকথিত নির্বাচন হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠান এখন দলীয়করণ করা হয়েছে। জনগণের সব রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি-অনিয়ম চলছে। বড়রা অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আর ছোট অপরাধে ছোটদের ধরা হচ্ছে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার চরম অভাব দেখা দিয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে ভাষা ও ভূমির দিক থেকে একটি একক রাষ্ট্র। অথচ আমাদের বিভক্ত করে দেয়া হয়েছে। একসময় কৃষকের ছেলেও বড় পদে যেতে পারত। কিন্তু এখন ধনীর ছেলে ধনী হচ্ছে। এমপির ছেলে এমপি হচ্ছে।
দেশে এক ব্যক্তির শাসনের কারণে সঙ্কট দেখা দিয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সেক্টরে কোনো সমন্বয় নেই। সুবিধা আদায়ে নিয়ম-নীতি সব পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। দেশের এ অবস্থার পরিবর্তনে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম সবার ভূমিকা রাখতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা