যারাই আশ্রমের খোঁজ নিয়েছেন, হয়েছেন হেনস্তার শিকার
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ০৪ মে ২০২৪, ০২:২৩
প্রতারণা ও জালিয়াতির মামলায় গ্রেফতার বহুল আলোচিত চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার মৃত্যুসনদ জাল করেই ক্ষ্যান্ত হননি। আশ্রমের নামে অসহায় মানুষের সাথে অমানবিক আচরণ, অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন এবং যারা তার আশ্রমে চোখ দিয়েছেন তাদের হেনস্তাসহ নানা হয়রানি করেছেন।
মিল্টন সমাদ্দার এখন তিন দিনের রিমান্ডে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছে মানবপাচারের, আরেকটি মামলা হয়েছে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জাল মৃত্যুসনদ তৈরির অভিযোগে। এ ছাড়া তিন নম্বর মামলায় তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে আটকে রেখে ভয়ভীতি দেখানো ও হুমকি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। গত বুধবার রাতে মানবপাচারের অভিযোগে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে প্রথম মামলাটি দায়ের করেন ধানমন্ডির বাসিন্দা এম রাকিব। বাকি দু’টি মামলা করা হয়েছে বৃহস্পতিবার সকালে। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে জাল মৃত্যুসনদ তৈরির অভিযোগে মামলা করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মিরপুর জোনাল টিমের এসআই মো: কামাল পাশা। আর অবৈধভাবে আটকে রেখে ভয়ভীতি দেখানো ও হুমকি দেয়ার অভিযোগে মামলার বাদি মিরপুরের বাসিন্দা মতিউর রহমান মল্লিক।
মিরপুর মডেল থানার ওসি মুন্সী ছাব্বীর আহম্মদ বলেন, দুটি মামলায় আসামি শুধু মিল্টন সমাদ্দার। আরেকটি মামলায় মিল্টনের পাশাপাশি চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের ম্যানেজার কিশোর বালাকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি মামলায় ৪-৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। তবে কিশোর বালা পলাতক রয়েছেন। এর আগে গত বুধবার রাতে রাজধানীর মিরপুর থেকে মিল্টনকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। পরে রাতেই এ বিষয়ে মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ডিএমপির গোয়েন্দা প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদ। মিল্টনের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগ সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানান তিনি।
অভিযোগে যা রয়েছে : মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে দায়ের করা মামলায় বাদি এম রাকিব উল্লেখ করেছেন, ২০২০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের সামনে দুই বছরের এক শিশুকে পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। তখন শেরেবাংলা নগর থানায় বিষয়টি জানান। কিন্তু থানাপুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে ফোন করলে মিল্টন সমাদ্দার ওই শিশুকে সেখান থেকে নিয়ে যান। বাদি রাকিব এজাহারে আরো উল্লেখ করেন যে, তিনি অভিভাবক হয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে ১০ হাজার টাকা দেন এবং শিশুটিকে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে ভর্তি করান। এরপর মিল্টন সমাদ্দার রাকিবকে জানান, আদালতের মাধ্যমে শিশুটিকে দত্তক নেয়া যাবে। এজাহারে বাদি আরো উল্লেখ করেন, ২০২১ সালের কোনো একদিন মিল্টন ফোন করে তাকে জানান, আমি (রাকিব) যেন ওই প্রতিষ্ঠানে আর না যাই এবং শিশুটির খোঁজ খবর না নেই। এরপর আরো বেশ কয়েকজন ফোন করে আমাকে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখান। প্রাণভয়ে আমি আর সেখানে যাইনি। সম্প্রতি একটি খবর চোখে আসার পর গত ২৪ এপ্রিল চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে যাই। কিন্তু শিশুটিকে সেখানে পাওয়া যায়নি। শিশুটি কোথায় আছে, সে ব্যাপারেও তাদের কাছ থেকে সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বাদির অভিযোগ, ২০২১ সালের যেকোনো সময় শিশুটিকে পাচার করা হয়েছে।
জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মৃত্যু সনদ তৈরির অভিযোগে দ্বিতীয় মামলায় বাদি গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) কর্মরত এস আই কামাল পাশা। অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে মিল্টন নিজেই মৃত্যুসনদ দিতেন। এমন তথ্য পেয়ে তার প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালালে সেখান থেকে এ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি সিল উদ্ধার করা হয়। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মৃত্যুসনদ তৈরি করতেন মিল্টন সমাদ্দার।
তৃতীয় মামলায় দলগতভাবে হামলা, মামলা ও হত্যার হুমকির অভিযোগ আনেন বাদি মতিউর রহমান মল্লিক। এই মামলায় বলা হয়েছে, মতিউর তিন বছর আগে মিরপুর-১ নম্বরের দক্ষিণ বিশিলে মোতালেব হোসেন নামের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বৃদ্ধকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেন। তিনি এ ব্যাপারে দারুস সালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে অসহায় ওই বৃদ্ধকে সুচিকিৎসা ও দেখভাল করার জন্য মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানটিতে দেন। পরে তিনি (মতিউর রহমান) খোঁজ নিতে গিয়ে জানতে পারেন, মিল্টন সমাদ্দার ওই ব্যক্তিকে তার স্বজনদের কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে ওই আশ্রয়কেন্দ্রে গেলে মিল্টন সমাদ্দার ও তার সহযোগীরা মতিউর ও তার দুই বন্ধুকে লাঠিপেটা করে আহত করেন। হামলাকারীরা এ সময় তার (মতিউর) কাছে থাকা জিডির কপি ও মোতালেবের বিষয়ে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার থেকে যে কাগজ দেয়া হয়েছিল, তা ছিনিয়ে নেন। মিল্টন ও তার সহযোগীরা তাদের মোবাইলফোন থেকে মারধর করার ভিডিও মুছে ফেলেন এবং সাদা কাগজে তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেন।
চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার আশ্রমের চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার অনলাইন-অফলাইনে একজন পরিচিত মুখ। অনলাইনে তার অনুসারী দেড় কোটির বেশি। তবে সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে কয়েকটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। এর পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। যদিও কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মিল্টন সমাদ্দার।
মিল্টনের দাবি, মিরপুরে যে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার আশ্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি সেখানে আশ্রয়হীন বৃদ্ধ ও শিশুদের আশ্রয় দেয়া হয়। সম্প্রতি সাভারে জমি কিনে আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য স্থায়ী নিবাস বানানো হয়েছে। সেটা নিয়েই একটি চক্র তার বিরোধিতা করছে। মিল্টন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অসহায় বৃদ্ধ ও শিশুদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে নিয়মিত প্রচারণা চালান। এ সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র দেন। ফেসবুকে তাকে অনুসরণ করেন ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ।
এর আগে মিরপুর থেকে মিল্টনকে গ্রেফতারের পর বুধবার রাতে ডিবিপ্রধান জানান, তার (মিল্টন) বিরুদ্ধে মানবপাচার, অবৈধভাবে লাশ দাফন, টর্চার সেল, আয়ের উৎসসহ বেশ কিছু অভিযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ৯০০ লাশের ৮৩৫টির ডকুমেন্ট দেখাতে পারেননি মিল্টন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা