১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

মডেল ঘরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ কৃষকের মধ্যে সাড়া

ক্ষতি ১০ শতাংশে নামানো গেলে আমদানি করতে হবে না
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে মডেল ঘরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন চাষিরা : নয়া দিগন্ত -


এক মণ পেঁয়াজ ঘরে রাখলে স্বাভাবিক নিয়মেই ১৫ কেজি কমে। আর যদি কোনো কারণে পচন ধরে তাহলে তো কথায়ই নেই। ৪০ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয় বা ওজন কমে। তাই ঘরে বেশি দিন পেঁয়াজ সংরক্ষণ করে রাখা যায় না। লাভ তো দূরের কথা, লোকসানে পড়তে হয়। এবার কৃষি বিপণন অধিদফতর একটা ‘মডেল ঘর’ তৈরি করে দিয়েছে। প্রায় ৮৫০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছি। মডেল ঘরে সংরক্ষণ করেছি প্রায় ৪৫০ মণ। বাকি পেঁয়াজ শোয়ার ঘর বা আগের মতোই রেখেছি। দেড় দুই মাস হচ্ছে, মনে হচ্ছে মডেল ঘরের পেঁয়াজ খুব বেশি নষ্ট হবে না। কথাগুলো বলছিলেন, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শানপুকুরিয়া গ্রামে আলফাজ হোসেন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি। চাকরি করলেও তার মন মননে কৃষির প্রতি টান। তাই চাষাবাদও চালিয়ে যান। ১৫ বছর চাকরি করার পর তা ছেড়ে দিয়ে এখন তিনি পুরোপুরি কৃষিতে মনোনিবেশ করেছেন। পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করছেন। পাশাপাশি একজন মৎস্যচাষিও তিনি।

আলফাজ বলেন, অন্যদের চেয়ে আমি একটু আলাদাভাবে চাষাবাদের চেষ্টা করি। ধরেন অন্যরা নরমাল জাত করলেও আমি উচ্চ ফলনশীল জাতের পেঁয়াজ আবাদ করি। প্রতি বিঘায় ৭০-৮০ মণ ফলন পাই। অনেকে আমার কাছে এসে কৃষি পরামর্শ নেয়, তখন ভালো লাগে। এবার প্রায় ৮৫০ মণ পেঁয়াজ পেয়েছি। প্রায় দুই মাস হতে চললো মডেল ঘরে পেঁয়াজ রেখেছি; এখন দেখতে পাচ্ছি, মডেল ঘরে বাইরে থেকে নরমাল বাতাস ঢুকছে। ভেতর থেকে গরম বাতাস বের হয়ে যাচ্ছে। এতে পেঁয়াজের ওজনটা ঠিক থাকবে। পেঁয়াজ ঠোস খাবে না এবং পচবেও না মনে হচ্ছে। আর থাকার ঘরে আমরা যে পেঁয়াজ রাখি, সেখানে তাপমাত্রা কমবেশি হয়। এতে পচন শুধু না, কালারও নষ্ট হয়ে যায়। পেঁয়াজের পচনসহ নানা কারণে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। পোকা পর্যন্ত ধরে। মডেল ঘরে মনে হচ্ছে এটা রোধ হবে। ৪০ শতাংশ থেকে নষ্ট বা ওজন কমার হার ৫-৭ শতাংশে নেমে আসবে।

আলফাজ হোসেনের মতো কৃষি বিপণন অধিদফতরের ‘কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ‘মডেল ঘর’ পেয়েছেন কুমারখালী উপজেলার বহলবাড়িয়া গ্রামের প্রশনজিত মণ্ডল। গত মঙ্গলবার সরেজমিনে তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দেশীয় প্রযুক্তিতিতে বাঁশ, কাঠ, রঙিন টিন, আরসিসি পিলার ও অ্যাবুনাইট শিট দিয়ে আধুনিক এই ঘরটি সরকারি খরচে করে দেয়া হয়েছে। তার ভাষ্য, প্রায় আড়াই শ’ মণ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করেছি। মাস খানেক যাচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, পেঁয়াজ নিয়ে আর টেনশন করতে হবে না। এখন পর্যন্ত পেঁয়াজ ঠিক আছে।
তিনি জানান, আগে আমরা বসতবাড়ির চাতালে পেঁয়াজ ছড়িয়ে রাখতাম। ঘরে এরকম আলো বাতাসের ব্যবস্থা ছিল না। স্বাভাবিক নিয়মেই পেঁয়াজের ওজন কমে যায় মণে প্রায় ১৫ কেজি। আর পচন ধরলে তো কথাই নেই। আমরা যে নিয়মে বাড়িতে পেঁয়াজ রাখি এতে কিছুদিন পর থেকেই ড্যাম হয়ে পচন ধরে। এবার মডেল ঘরে পেঁয়াজ রেখেছি, মনে হচ্ছে পচন ধরবে না। ওজনও ওই অর্থে কমবে না।

দেশে যেসব জেলায় পেঁয়াজ বেশি উৎপাদিত হয় তার মধ্যে কুষ্টিয়া অন্যতম। এ জেলায় প্রায় আড়াই লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। যার মধ্যে সংরক্ষণযোগ্য পেঁয়াজের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টন। সে হিসাবে সংরক্ষণ ঘর প্রয়োজন ১৬ হাজারটি। এর মধ্যে জেলার কুমারখালী উপজেলায় ১৫টি মডেল ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। আগামী বছর এর সাথে যুক্ত হচ্ছে খোকসা উপজেলা। এই উপজেলায় আরো ৩৫টি ঘর নির্মাণ করে দেয়া হবে। কুষ্টিয়া ছাড়াও পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, রাজশাহী, ঝিনাইদহ ও মাগুরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্প রিভাইজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, সেখানে আরো একাধিক জেলা অন্তর্ভুক্ত হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯-২০ সালে হঠাৎই পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা হয়ে যায়। দেশব্যাপী মানুষের মুখে মুখে সমালোচনার জন্ম দেয় পেঁয়াজ ইস্যু। কর্মকর্তারা সিরিজ মিটিং করেন। সমাধানের পথ খোঁজেন। তখন সামনে আসে পেঁয়াজ সংরক্ষণের এই মডেল ঘর। কৃষি বিভাগ বলছে, গত বছর দেশে প্রায় ৩৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। এর আগে প্রায় ৩৬ লাখ উৎপাদন হয়েছে। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৮ লাখ টন। গত বছর আমদানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন। চাহিদার চেয়ে ৬-৭ লাখ টন বেশি উৎপাদন হলেও কেন আমদানি করতে হয়, এ নিয়ে অনেকে প্রশ্নও তোলেন। এ প্রশ্নের সরল হিসাব দেন কৃষি বিপণন অধিদফতরের ‘কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক হেলাল উদ্দিন।

তিনি বলেন, ধরেন, দেশে প্রায় ৩৪ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ২৫-৪০ শতাংশ নষ্ট হয়। সে হিসাবে প্রায় ১০ লাখ টনের বেশি কমতি হয়। তাই যেখানে উদ্বৃত্ত থাকার কথা, সেখানে ঘাটতি পড়ে। আর ওই ঘাটতি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। মডেল ঘরে পেঁয়াজ রাখলে নষ্ট হওয়ার হার ১০ শতাংশ বা তারও নিচে নেমে আসবে আশা করি।
কৃষি বিপণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২৫ কোটি ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে ‘কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। জুলাই, ২০২১ থেকে জুন, ২০২৬ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির অধীন দেশের সাতটি উপজেলার ১২টি উপজেলায় ৩০০টি ‘মডেল ঘর’ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রতিটি ঘরে ৩০০-৪৫০ মণ পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ করা যাবে। প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য কৃষকদের উৎপাদিত পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়নের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকার ১০-১৫ শতাংশ কৃষকের প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করা। অপ্রত্যাশিত বাজার দর বৃদ্ধি রোধে ২৫-৪০ শতাংশ পচনশীলতা রোধ করে স্থায়ীভাবে পেঁয়াজ ও রসুনের বছরব্যাপী মজুদ গড়ে তোলা। গত মৌসুমে মাত্র আটজন কৃষক সংরক্ষণ মডেল ঘরে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ করেন। নষ্ট বা পচনের হার ছিল ৭ শতাংশ। গত দুই অর্থবছরে (২০২-২৩ ও ২০২৩-২৪) ২২০টি মডেল ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে আরো ১৫টি ঘরের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। তবে এরই মধ্যে মডেল ঘর আরো ৬০০টি বাড়ানোর প্রক্রিয়া প্রায় সম্পন্নের পথে। এ জন্য বাজেটও বাড়ছে। অর্থাৎ ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০০টি মডেল ঘর নির্মাণ করবে কৃষি বিপণন অধিদফতর। যুক্ত করা হচ্ছে আরো কয়েকটি উপজেলা। শুধু তা-ই নয়, এই প্রকল্পের আওতায় কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের প্রসেসিং যন্ত্র প্রদান ও বীজ বিপণনে লিংকেজ তৈরি করে দেয়া হচ্ছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক মো: হেলাল উদ্দিন। তার দেয়া তথ্য মতে, ৯০০ মডেল ঘরে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা যাবে প্রায় ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৪ হাজার টন। তবে সারা দেশের কৃষক তথা উৎপাদিত পেঁয়াজ আধুনিক পদ্ধতিতে আনতে হলে প্রায় ২ লাখ সংরক্ষণ মডেল ঘর প্রয়োজন।

প্রকল্প পরিচালক বলছেন, দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ পচনে নষ্ট হয় তা যদি ১০ শতাংশের মধ্যে আনা যায় তাহলে আর বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির প্রয়োজন হবে না। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে; তেমনি কৃষকও লাভবান হবেন।
এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক মো: মাসুদ করিম বলেন, আমরা চাই দেশের প্রত্যেক কৃষকের আঙিনায় এরকম একটা করে ঘর তৈরি করে দিতে। কিন্তু আমাদের তো সেই সাধ্য নেই। এজন্য আমরা নাম দিয়েছি ‘মডেল ঘর’। মডেল মানে হলো আমাদের দেয়া এই ঘরের মতোই একই রকমের ঘর কেউ বানাবে, অনুসরণ করবে। ফলে সে নিজেও উপকৃত হবে, আমাদের সংগ্রহোত্তর ক্ষতিও কমবে। আমাদের যে আমদানি নির্ভরতা, এটা কমে যাবে।
তিনি বলেন, আমরা পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ আছি। সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারলে আমাদের আর পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে না। চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত থাকবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement