গাজার যুদ্ধবিরতি আলোচনায় অগ্রগতির লক্ষণ নেই
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:৪১
- দুর্ভিক্ষ রোধে ইসরাইলি বাধার সম্মুখীন জাতিসঙ্ঘ
- ২৪ ঘণ্টায় আরো ৫৬ ফিলিস্তিনিকে হত্যা
যুদ্ধের দীর্ঘ ছয় মাস গড়িয়েছে, তবু গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে নেই কোনো অগ্রগতির লক্ষণ। কাতার ও মিসরের নেতৃত্বে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাস ও ইসরাইল নিজ নিজ অবস্থানে অটল থাকায় এখনো কোনো অগ্রগতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। যুদ্ধবিরতি আলোচনার অন্যতম মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুর রহমান আলে সানি বলেছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা একটি ‘সংবেদনশীল পর্যায়ে’ রয়েছে। আলজাজিরা ও রয়টার্স।
গতকাল বুধবার শেখ মোহাম্মদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘গাজা সংক্রান্ত আলোচনা বারবার হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে এবং আমরা দুর্ভোগের অবসান ঘটাতে এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি।’ এ দিকে, জাতিসঙ্ঘের একজন জ্যেষ্ঠ সহায়তা কর্মকর্তা বলেছেন, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে এখনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন তারা। ইসরাইলের সাথে সমন্বয়ে কিছুটা উন্নতি হলেও গাজায় সাহায্য বিতরণে এখনো সমস্যায় পড়ছে সংস্থাটি।
গাজা উপত্যকায় ত্রাণ সরবরাহে এখনো বিধিনিষেধ বজায় রেখেছে ইসরাইল। তবে এ ধরনের বিধিনিষেধ বেআইনি বলে মনে করে জাতিসঙ্ঘ। মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ নিয়ে কথা বলেন জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক দফতরের মুখপাত্র রাভিনা সামদাসানি। রাভিনা সামদাসানি বলেন, ‘ইসরাইল মানবিক সহায়তা প্রবেশ ও বিতরণে বেআইনি বিধিনিষেধ আরোপ করে চলেছে এবং বেসামরিক অবকাঠামোর ওপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।’ অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে জাতিসঙ্ঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় প্রধান আন্দ্রেয়া ডি ডোমেনিকো বলেছেন, গাজায় পাঠানো সাহায্য অঞ্চলটিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চেকপয়েন্ট বিলম্বের সম্মুখীন হয়েছে। গত সপ্তাহে উত্তর গাজায় সাহায্য বিতরণের জন্য ত্রাণ প্রবেশের অনুরোধ জানিয়েছিল জাতিসঙ্ঘ। তখন সংস্থাটির করা অনুরোধের ৪১ শতাংশেই প্রত্যাখ্যান করা হয়।
সাংবাদিকদের ডি ডোমেনিকো বলেন, ‘আমরা এমন একটি পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি যেখানে আমরা এক ধাপ এগিয়ে গেলে আরো দুই ধাপ পিছিয়ে যাই অথবা দুই ধাপ এগিয়ে গেলে আরো এক ধাপ পিছিয়ে যাই। এ কারণে আমাদের সবসময় একই বিন্দুতে আটকে আছি।’ এসময় তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের দেয়া প্রতিটি নতুন সুযোগের সাথে সাথে আমরা নতুন আরো চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন হবো। তাই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো আমাদের পক্ষে সত্যিই কঠিন।’
দীর্ঘদিন ধরে গাজায় সাহায্য পৌঁছাতে এবং সেখানে সেগুলো বিতরণে বাধা পাওয়ার অভিযোগ করেছে জাতিসঙ্ঘ। তবে পয়লা এপ্রিল ইসরাইলি বিমান হামলায় গাজায় ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেনের সাহায্য কর্মী নিহত হওয়ার পর অঞ্চলটির মানবিক সঙ্কট নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ বেড়েছে। সেখানে ২৩ লাখ মানুষ মানবিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। ডি ডোমেনিকো আরো বলেন, ‘সমস্যাটা শুধু খাবার নিয়ে নয়। এটি অনেক জটিল একটি সমস্যা- এই দুর্ভিক্ষ রোধে পানি, স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্য একটি মৌলিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
শরণার্থী শিবির-আবাসিক ভবনে ইসরাইলি হামলা : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে নির্বিচার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। এরই মধ্যে ভূখণ্ডটির একটি শরণার্থী শিবির ও আবাসিক বাড়িতে হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। পৃথক এই হামলায় নিহত হয়েছেন ১৮ জন। এর মধ্যে মধ্যগাজার মাগাজি শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় নিহত হয়েছেন ১১ জন। অন্যদিকে রাফাহতে আবাসিক বাড়িতে হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন সাতজন। উভয় হামলাতেই নিহতদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। গতকাল বুধবার এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ছয় মাসের যুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ৩৩ হাজার ৮৯৯ জনে পৌঁছেছে। মঙ্গলবার থেকে ২৪ ঘণ্টায় আরো ৫৬ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৮৯ জন আহত হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় যোগ করেছে। অব্যাহত হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৭৬ হাজার ৬৬৪ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৪ হাজার ৫২০টিরও বেশি শিশু এবং ১০ হাজার নারী রয়েছে।
মাগাজি শরণার্থী শিবিরটি ঘনবসতিপূর্ণ এবং ইসরাইল গাজায় আক্রমণ শুরু করার পরে ভূখণ্ডটির উত্তরে হাজার হাজার পরিবার তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়ার পরে এই শিবির আরো ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আলজাজিরার হানি মাহমুদ রাফাহ থেকে জানিয়েছেন, মাগাজি শরণার্থী শিবিরে মানুষের কাজ ও ব্যস্ততার সময়ে ইসরাইল এই হামলাটি চালায়। তিনি বলেন, হামলার সময় সেখানকার একটি খেলার মাঠেও আক্রমণের ঘটনা ঘটে যেখানে প্রায়শই বাস্তুচ্যুত শিশুরা চলাচল করে।
এছাড়া ইসরাইলি এই হামলায় ‘কয়েকজন’ আহত মানুষকে আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও মাহমুদ জানিয়েছেন। এদিকে গাজার রাফাহ শহরের একটি বাড়িতে পৃথক ইসরাইলি হামলায় আরো সাতজন নিহত হয়েছেন। ওয়াফা নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজা উপত্যকার রাফাহ শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি বাড়িতে ইসরাইলি বিমান হামলায় চার শিশুসহ ওই সাতজন নিহত হন।
৫ হাজার ফিলিস্তিনি ‘প্রাণ’ : গাজার একটি ফার্টিলিটি ক্লিনিকে ইসরাইলি গোলার আঘাতে অন্তত চার হাজার ভ্রুণ এবং এক হাজার শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নমুনা ধ্বংস হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বরে ইসরাইলি হামলায় গাজার সবচেয়ে বড় ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ সেন্টার আল-বাসমায় আঘাত হানে ইসরাইলি বাহিনীর একটি গোলা। সেই হামলায় ক্লিনিকটিতে থাকা ভ্রুণ ও শুক্রাণু সংরক্ষণকারী পাঁচটি নাইট্রোজেন ট্যাংকের ঢাকনা ভেঙে যায়। ইসরাইলি হামলার নাইট্রোজেন ট্যাংকের ঢাকনা ভেঙে যাওয়ার কারণে এর ভেতরের তাপমাত্রা আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ফলে এর ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে চার হাজারের বেশি ভ্রুণ এবং এক হাজারের বেশি শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নমুনা ধ্বংস হয়। রয়টার্স বলছে, ইসরাইলি এই হামলার ফলাফল সুদূরপ্রসারী। এই হামলা মূলত নিহত ফিলিস্তিনিদের অদৃশ্য সংখ্যা, যারা জীবন পাওয়ার আগেই ঝরে গেছে। একই সাথে এই পাঁচ হাজার সম্ভাব্য ফিলিস্তিনি অঞ্চলটির হাজারো বন্ধ্যা দম্পতির আশার আলো হতে গিয়েও নিভে গেল।
উত্তর ইসরাইলে হামলা : ইসরাইলের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য আরব আল-আরামশে উত্তর বেদুইন গ্রামে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন নিক্ষেপ করেছে হিজবুল্লাহ। ইসরাইলের আরুৎজ শেভা মিডিয়ার জানিয়েছে, হামলায় অন্তত সাতজন আহত হয়েছে, এর মধ্যে দু’জনের অবস্থা গুরুতর। তাদের নাহারিয়ার ইসরাইলের গ্যালিলি মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।
আরেকটি যুদ্ধ সহ্য করার ক্ষমতা নেই মধ্যপ্রাচ্যের : মধ্যপ্রাচ্য আরেকটি যুদ্ধ সহ্য করার সক্ষমতা রাখে না। তাই এখানে উত্তেজনা প্রশমন করাই হবে সবার অগ্রাধিকার। এমন মন্তব্য করেছেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সাউদ। গাজায় যুদ্ধবিরতিরও আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা পুরোটাই অপর্যাপ্ত। গাজার জনগণের দুর্দশার ইতি ঘটাতে আমাদেরকে আরো অনেক কিছু করতে হবে।
মার্কিন সমর্থনের নিন্দা : কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) গাজায় ইসরাইলের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মার্কিন সরকারের অব্যাহত সমর্থনের নিন্দা করেছে। সিএআইআর-এর কমিউনিকেশন ডিরেক্টর ইবরাহিম হুপার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘মানবতার বিরুদ্ধে এই ইসরাইলি অপরাধগুলো প্রতিদিন- এমনকি প্রতি ঘণ্টায় - বাইডেন প্রশাসনের সক্রিয় সমর্থনে সংঘটিত হচ্ছে।’ ‘গাজায় গণহত্যা, জাতিগত নির্মূল এবং জোরপূর্বক অনাহার বন্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ না নিলে বিশ্ব মঞ্চে আমাদের দেশের সুনাম অপূরণীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা