২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পার্লামেন্টের কার্যবিবরণী চাইল পাক সুপ্রিম কোর্ট

৩ মাসে সাধারণ নির্বাচন সম্ভব নয় : নির্বাচন কমিশন; সরকার পরিবর্তন চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
-

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে ওঠা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে পার্লামেন্টের কার্যবিবরণীর নথি চেয়েছে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট।
ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি পার্লামেন্টে উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব যেভাবে বাতিল করেছেন তার বৈধতা নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার শুরু হওয়া শুনানিতে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত ওই নথি তলব করে বলে জানিয়েছে দ্য ডন।
পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ এ বিষয়ে যুক্তিতর্ক শুনছে। ‘এই ইস্যুতে যৌক্তিক আদেশ’ দেয়া হবে বলে সোমবার বলেছিলেন বান্দিয়াল; তবে সেদিন পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও অন্য বিরোধী দলের আইনজীবী ফারুক এইচ নায়েকের যুক্তি শুনে শুনানি মুলতবি করে দেয়া হয়। গতকালের শুনানিতে পিপিপির সিনেটর রেজা রাব্বানি আদালতকে পার্লামেন্টের কার্যপ্রণালীর ‘দায়মুক্তির’ আওতা পরীক্ষা করে দেখতে বলেন। তিনি বলেন, ‘যা হয়েছে তাকে কেবল বেসামরিক মার্শাল ল’ই অ্যাখ্যা দেয়া যায়।’
রোববার ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি অনাস্থা প্রস্তাব বাতিলের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তাকে ‘অবৈধ’ অ্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, কোনো সিদ্ধান্তই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। ‘অনাস্থা প্রস্তাব ভোটে না দিয়ে বাতিল করা যায় না,’ পাকিস্তানের সংবিধানের ধারা ৯৫ উদ্ধৃত করে রাব্বানি বলেন, অনাস্থা প্রস্তাবকে খাটো করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিদেশী চক্রান্তের কথা তোলা হয়েছে।
পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশেন ২১ মার্চ শুরু হয়েছিল এবং মরহুম এক আইনপ্রণেতার জন্য দোয়া শেষে মুলতবি করে দেয়া হয়, অতীতে কখনোই এমনটা হয়নি বলেও জানান রাব্বানি। এই সিনেটর বলেন, রোববার পার্লামেন্টের অধিবেশনে ফাওয়াদ চৌধুরী পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে ওই চিঠি ও বিদেশী চক্রান্তের কথা উল্লেখ করেন, অথচ সে দিনের আলোচ্য সূচিতে এই বিষয়টি ছিলই না। ডেপুটি স্পিকার যেভাবে প্রমাণ ছাড়াই বিরোধীদলীয় আইনপ্রণেতাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ অ্যাখ্যায়িত করেছেন তা ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিরোধীরা পার্লামেন্টের স্পিকার আসাদ কায়সারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল, যা স্পিকারের ক্ষমতা খর্ব করেছিল; অনাস্থা প্রস্তাবের কার্যক্রম চলাকালে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া যায় না বলেও মত তার। তিনি সর্বোচ্চ আদালতকে অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করে ডেপুটি স্পিকার যে আদেশ দিয়েছেন তা খারিজ করে দেয় এবং পার্লামেন্ট পুনর্বহালের অনুরোধ করেন। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের নথি ও ‘হুমকি দেয়া চিঠিটিও’ হাজির করতে বলেন তিনি।
রাব্বানির পর পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএলএন) আইনজীবী মাখদুম আলী খান তার যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি জানান, অনাস্থা প্রস্তাবটি জমা দেয়া হয়েছিল ১৫২ আইনপ্রণেতার স্বাক্ষরে, প্রস্তাবটি উত্থাপনের পক্ষে ছিলেন ১৬১ আইনপ্রণেতা। তিনি বলেন, ‘এরপর এর কার্যক্রম ৩১ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করে দেয়া হয়।’ মাখদুম বলেন, নিয়ম অনুযায়ী, ৩১ মার্চ ওই অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক হওয়ার কথা থাকলেও বিতর্ক হয়নি; ৩ এপ্রিল ভোটও হয়নি।
পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে বিরোধী দলগুলোর জোট বেঁধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পতন যখন অত্যাসন্ন, তখন রোববার নাটকীয় এক পদক্ষেপ নিয়ে অসম্মানজনক বিদায় এড়ান তিনি। প্রথমে জাতীয় পরিষদে আনা অনাস্থা প্রস্তাব ‘সংবিধানসম্মত নয়’ উল্লেখ করে তা বাতিল করে দেন অধিবেশন পরিচালনাকারী ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি। এরপর প্রধানমন্ত্রী ইমরানের প্রস্তাবে জাতীয় পরিষদ বা পার্লামেন্ট ভেঙে দেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। সংবিধান অনুযায়ী, এখন ৯০ দিনের মধ্যে পাকিস্তানে নির্বাচন হতে হবে এবং তা হবে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে নিজেদের মনোনীতদের নাম দেবেন ইমরান খান ও বিরোধী দলীয় নেতা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে পার্লামেন্টের বিলুপ্তি নিয়ে। বিরোধীরা বলছেন, যেখানে পার্লামেন্টই বিলুপ্ত, সেখানে কে প্রধানমন্ত্রী আর কে বিরোধীদলীয় নেতা? ফলে নতুন করে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে দেশটিতে। পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার পর এখন নির্বাচন পরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিভাবে গঠিত হবে, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আবার পার্লামেন্টে আনা অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করার ক্ষেত্রে যে সাংবিধানিক যুক্তি দেখানো হয়েছে, সেটাও আদালতের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতি এখন সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
৩ মাসে সাধারণ নির্বাচন সম্ভব নয় : এ দিকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার পর যে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে আগামী তিন মাসে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)। এর কারণ হিসেবে নির্বাচন আয়োজনের নানা বাধা ও প্রক্রিয়াগত চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়েছে তারা। কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম ডন জানিয়েছে, সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য ছয় মাস লাগবে।
নির্বাচনী এলাকার নতুন সীমা নির্ধারণ, বিশেষ করে ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে খাইবার পাখতুনখোয়ায় আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং জেলা ও নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক ভোটার তালিকাগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ করা প্রধান চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী সীমা নির্ধারণ একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, যেখানে আইনে এ ব্যাপারে শুধু আপত্তি জানানোর জন্যই এক মাস সময় দেয়া হয়েছে। ‘আপত্তি জানানোর পর তা যাচাই-বাছাইয়ে আরো এক মাস প্রয়োজন। আর এই পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে কম পক্ষে তিন মাস লাগতে পারে। তারপর ভোটার তালিকা হালনাগাদের মতো আরেকটি বিশাল কাজ বাকি থাকে।’
ইসিপির ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বরাতে ডন জানায়, পাকিস্তানে নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে নির্বাচনীসামগ্রী সংগ্রহ, ব্যালট পেপারের ব্যবস্থা এবং ভোটগ্রহণ কর্মীদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণও ভোট আয়োজনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, আইন অনুযায়ী ওয়াটার মার্ক সম্বলিত ব্যালট পেপার ব্যবহার করতে হবে যা পাকিস্তানে নেই, আমদানি করতে হবে। এই ‘ওয়াটার মার্কের’ পরিবর্তে ‘নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য’ রয়েছে এমন ব্যালট পেপার সরবরাহের জন্য আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছিল নির্বাচন কমিশন।
দরপত্র আহ্বান, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো যাচাইয়ের জন্যও কিছু সময় লাগবে। প্রায় এক লাখ ভোটকেন্দ্রের জন্য প্রায় দুই মিলিয়ন স্ট্যাম্প প্যাডের প্রয়োজন হবে। ‘এটি কেবল একটি উদাহরণ। কাঁচি এবং বল পয়েন্টসহ বিপুল পরিমাণে অন্যান্য উপকরণও সংগ্রহ করতে হবে’, বলেন তিনি। কিছু আইনি ঝামেলার কথা উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘নির্বাচন আইনের ১৪ ধারা অনুসারে ভোট গ্রহণের চার মাস আগে একটি নির্বাচনী পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হয় ইসিপিকে। ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা এবং বিদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের ভোটাধিকারের বিষয়গুলোও সুরাহা করতে হবে।
‘কমিশন ইতোমধ্যে বেলুচিস্তানে স্থানীয় সরকার (এলজি) নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। সেখানে ২৯ মে ভোটগ্রহণ হবে। পাঞ্জাব, সিন্ধু ও ইসলামাবাদেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে।’ তিনি বলেন, ‘যদি সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করতে হয়, তাহলে আমাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে।’
অভিযোগ অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের : এ দিকে পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এক নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র নেড প্রাইস। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু পাকিস্তানে নয় বরং দুনিয়াজুড়ে গণতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাস করে। তিনি বলেন, পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তনের মার্কিন চেষ্টার যে অভিযোগ করা হচ্ছে তার কোনো সত্যতা নেই। যুক্তরাষ্ট্র সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক নীতি শান্তিপূর্ণভাবে বজায় রাখার পক্ষপাতী। ওয়াশিংটন কখনো কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না বলেও জানান নেড প্রাইস। সম্প্রতি একটি বিদেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টার অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘বিদেশী একটি রাষ্ট্রের’ পক্ষ থেকে তার সরকার একটি ‘হুমকির চিঠি’ পেয়েছে। ইমরান খান বলেন, ওই চিঠিতে অনাস্থা ভোটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ তখনো তা উত্থাপন করা হয়নি। এর অর্থ হলো বিরোধীরা তাদের সাথে যোগাযোগ করছে। এক বৈঠকে এই অনাস্থা ভোট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা সরাসরি হুমকি দিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন ইমরান খান। এরপরই পাকিস্তানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টার অভিযোগ অস্বীকার করলেন নেড প্রাইস।


আরো সংবাদ



premium cement